তিনি জ্ঞানী, এটা বোঝানোর চেষ্টা করতেন না: সুবর্ণা মুস্তাফা

মানুষ হিসেবে জাকী ভাইয়ের লক্ষ্য সব সময় সঠিক ছিল। তিনি পড়াশোনা করেছেন ফিজিকসে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তারপর সিনেমার প্রতি ভালোবাসা। বিভিন্ন ফিল্ম সোসাইটির সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করা। পুনেতে পড়তে গেলেন। সৈয়দ সালাহউদ্দিন জাকী নামটার সঙ্গে আমার পরিচয় তাঁকে দেখার অনেক আগে।

সৈয়দ সালাহউদ্দিন জাকীর সঙ্গে সুবর্ণা মুস্তাফা
ছবি : সুবর্ণার মুস্তাফার ফেসবুক

বাবার (গোলাম মুস্তাফা) মাধ্যমে। এরপর ঢাকা থিয়েটারে যখন গেলাম, তখন আলাপ হলো, তিনি তো প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। তখনই জানি যে জাকী ভাই তখন পুনেতে ফাইনাল ইয়ারে পড়ছেন। ফিরে আসবেন। এরপর সিনেমা বানাবেন। সেই সিনেমায় আমি অভিনয় করব। আমিও ম্যাট্রিক পরীক্ষার পর শুটিং করব। বাবাও তা–ই বললেন।

সত্যি কথা বলতে, এই মুহূর্তে কথা গুছিয়ে বলার মতো অবস্থায় নেই। কিছু মানুষ জীবনের অংশ হয়ে যান, আমার জীবনে জাকী ভাই তেমনই একজন ছিলেন। তাঁর সঙ্গে প্রথম জীবনে ‘ঘুড্ডি’ করেছি। আমাদের সবারই প্রথম কাজ। এখনো যখন ‘ঘুড্ডি’ দেখি, মনে হয় যে সময়ের অনেক আগের ছবি, যা তিনি ৪০ বছর আগে বানিয়েছিলেন। এখনকার প্রজন্মও এই ছবির সঙ্গে সুন্দরভাবে একাত্ম হতে পারে। জাকী ভাই মানুষ হিসেবে অসাধারণ ছিলেন।

সৈয়দ সালাহউদ্দিন জাকী পরিচালিত ‘ঘুড্ডি’ সিনেমার গানের দৃশ্যে রাইসুল ইসলাম আসাদ ও সুবর্ণা মুস্তাফা
ছবি : সংগৃহীত

এত জ্ঞানী, কিন্তু কখনোই নিজেকে জাহির করতেন না। তিনি অসাধারণ ছিলেন, মানুষের সঙ্গে তাঁর ব্যবহারে। একদম শিশু–কিশোর থেকে শুরু করে বিজ্ঞজন—সবাইকে সহজভাবে আপন করে নেওয়ার ক্ষমতা জাকী ভাইয়ের ছিল। এটা সবার থাকে না আসলে। তিনি জ্ঞানী, এটা বোঝানোর চেষ্টা করতেন না। শিশুসুলভ একটা ব্যাপারও তাঁর মধ্যে ছিল। এখন তো সবাই নিজেকে জাহির করতে ব্যস্ত, তিনি তার ধারেকাছেও ছিলেন না।

যাঁরা শিল্পচর্চার মধ্যে থাকেন বা এই কাজ করতে ভালোবাসেন, তাঁদের তিনি সব সময় শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন। সম্মান করতেন। যেকোনোভাবে কেউ তাঁর কাছে কোনো সাহায্য চাইলে, হোক সেটা বইয়ের রেফারেন্স কিংবা ঘটনা—সব সময় আন্তরিকভাবে এগিয়ে আসতেন। এই তো কিছুদিন আগেই, একদিন হাসপাতাল থেকেই আমাকে ফোন করলেন।

‘ঘুড্ডি’ ছবির দৃশ্যে রাইসুল ইসলাম আসাদ ও সুবর্ণা মুস্তাফা
ছবি: সংগৃহীত

তিনি হাসপাতালে, এর মধ্যে তিনি আফজাল হোসেনকে নিয়ে চিন্তিত। আমাকে বললেন, ‘ওকে বল, এত প্রেশার না নিতে।’ আমিও বললাম, ‘আপনিও নেবেন না জাকী ভাই।’ কোনো কিছুই জাকী ভাইকে দমিয়ে রাখতে পারে না। শেষ দুটি ছবির শুটিং তিনি হুইলচেয়ারে বসেই করেছেন। এই যে ভালোবাসা, প্যাশন, শ্রদ্ধা—আমরা যারা তাঁর কাছের, তারা আমাদের একজন শিক্ষক ও ভালোবাসার মানুষ হারালাম।

তাঁর সঙ্গে আমার সম্পর্কটা কখনো বন্ধু, কখনো বড় ভাই, কখনো শিক্ষকের মতো। তাঁর কাছে আমার সব সময় একটা অবারিত এক্সেস ছিল। তিনি একজন আদর্শ মানুষ। আধুনিক মানুষের সংজ্ঞা। জগতে সময়োত্তীর্ণ কিছু মানুষ থাকেন, যাঁরা সব সময়ের জন্য চিরন্তন, সব সময়ের জন্য আধুনিক—তিনি তেমনই। এখনই হঠাৎ মনে হলো, যখন তিনি বিটিভিতে ছিলেন ডিজি হিসেবে, যখনই আমার রেকর্ডিং থাকত, এ রকম হয়নি যে জাকী ভাই স্টুডিওতে আসেননি। দেখা করতেন। এটা স্নেহ। আর আমার বাবাকে তো বলতেন, ‘আমার বাতিঘর’।

‘ঘুড্ডি’ বানানোর আগে জাকী ভাই শিশু একাডেমির একটা ছবি বানিয়েছিলেন। নাম ‘গল্প বাবুর দেশে’। এত সুন্দর বাস্তব ঘটনার একটা ছবি। আমি তো মুগ্ধ। আমাদের দেশে তো কিছুই আর্কাইভে থাকে না। জানি না এই ছবি কোন অবস্থায় আছে।

জাকী ভাই অসম্ভব আবেগপ্রবণ মানুষ। এটা একজন পরিচালকের জন্য কখনো কখনো ভালো। কখনো এটার কারণে ব্যত্যয়ও ঘটে। কিন্তু তাঁর ছবি করতে গিয়ে দেখেছি—প্রতিটি ফ্রেম, প্রতিটি শট, প্রতিটি চরিত্র তাঁর কাছে একদম পরিষ্কার। তিনি জানতেন কী চাইছেন। তাঁর লক্ষ্য ঠিক থাকত। যে কারণে এটা একধরনের আশীর্বাদও যে তিনি আমৃত্যু তাঁর কাজের ভেতরই ছিলেন। জাকী ভাইকে নিয়ে কথা বলতে গিয়ে আরেকজন মানুষের কথা বলতে হয়, তিনি তাঁর স্ত্রী। কোনো রকম অভিযোগ ছাড়াই তিনি জাকী ভাইয়ের পাশে ছিলেন, পূর্ণ সমর্থন দিয়ে গেছেন। এটা রীতিমতো উদাহরণ। সৃজনশীল মানুষের এ রকম সঙ্গীর দরকার হয়। এমনটা আমি আমার মা–বাবাকে দেখেছি। আমার মা সব সময় বাবার সৃজনশীল কাজের সঙ্গে ছিলেন।

‘ঘুড্ডি’ ছবির নির্মাতা সৈয়দ সালাউদ্দীন জাকী এবং ইমপ্রেস টেলিফিল্ম ও চ্যানেল আইয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফরিদুর রেজা সাগর
ছবি : চ্যানেল আইয়ের সৌজন্যে

জাকী ভাইয়ের কথা বলতে গিয়ে আরেকজনের কথা বলতে চাই, ফরিদুর রেজা সাগর—যিনি কী না জাকী ভাইকে অনেক অনেক সাপোর্ট করেছেন। অনেক উৎসাহ দিয়েছেন। অনেক যত্ন করেছেন। এটা খুবই চমৎকার একটা ব্যাপার।