জাহিদ হাসানের মেসজীবনের গল্প ও জন্মদিনের স্মৃতি
আশির দশকের শেষ দিক। ধানমন্ডির ১৫ নম্বরের একটি মেস। চার–পাঁচজন তরুণ ভাগাভাগি করে থাকেন সেখানে। রান্নাঘরে প্রতিদিনের মেনু—ডাল–ভাত–ভর্তা, যার স্বাদ কখনো অতি নোনতা, কখনো আবার একেবারেই লবণহীন। টানাটানির কারণে এক প্লেট খিচুড়িও ভাগাভাগি করে খেতে হতো। সাবান বা শ্যাম্পুর বোতল মাঝেমধ্যেই উধাও হয়ে যেত।
সেই ছোট্ট মেসে একজন তরুণ প্রতিদিন ভাবতেন—একদিন তাঁর নাম সবাই জানবে, তাঁকে দেখবে টেলিভিশনের পর্দায়, প্রশংসা করবে অভিনয়ের জন্য। তরুণটির নাম ছিল পুলক। আজকের জনপ্রিয় অভিনেতা জাহিদ হাসান। আজ তাঁর জন্মদিন। ১৯৬৭ সালের আজকের দিনে সিরাজগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন জাহিদ হাসান। বেড়ে ওঠাও সেখানে।
মেসজীবনের গল্প
পড়াশোনা বা চাকরি—যেকোনো স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য তরুণ বয়সে যাঁরা ঢাকা শহরে আসেন, তাঁদের অনেকের সঙ্গেই হোস্টেল ও মেসজীবনের নিবিড় সম্পর্ক থাকে। জাহিদ হাসানের জীবনেও সেই অভিজ্ঞতা রয়েছে। মা–বাবার আদরের ছেলে হয়েও একসময় তাঁকে কাটাতে হয়েছিল টানাপোড়েন ভরা মেসজীবন। সিরাজগঞ্জ থেকে আশির দশকের শেষ দিকে ঢাকায় এসে তিনি ধানমন্ডি ১৫ নম্বরে এক মেসে ওঠেন। চার–পাঁচজনের সঙ্গে ভাগাভাগি করে থাকতে হতো একটি ঘরে। মেসের খাবারের অভিজ্ঞতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমরা একটা ঘরে চার–পাঁচজন থাকতাম। বুয়া রান্না করতেন। প্রায় সময়ই খাবার মুখে তোলা যেত না। পরে নিজেরা ভাজিটাজি রান্না করে খেয়ে নিতাম। তবে কষ্টের মধ্যেও একধরনের শান্তি আছে, আবার অশান্তিও আছে। জীবনে কোনো কিছুই সহজে পাওয়া যায় না। তাই কষ্টের পরের সুখটা আসলে অন্য রকম।’
জন্মদিনের স্মৃতি
মেসজীবনের মধ্যেও নিজের জন্মদিন নিয়ে একটি ঘটনার কথা আজও মনে রেখেছেন তিনি। জাহিদ হাসান বলেন, ‘আমি পরিবারের ছোট ছেলে। তাই আলাদা একটা নজর সবারই ছিল। ছোটবেলায় জন্মদিনে মা পায়েসসহ কত সুন্দর সুন্দর খাবার বানাতেন। কেক আনা হতো, চানাচুর, কলা—আরও কত কী! ঢাকায় আসার পর মেস ও হলজীবন শুরু হলো। ১৯৮৯ সালে একদিন মেসের ঘর ঝাড়ু দিচ্ছিলাম। তখন এক সঙ্গীর বাবা বেড়াতে এলেন। তিনি আইনজীবী ছিলেন। জন্মদিনের কথা শুনে বলেছিলেন, “মন খারাপ কোরো না পুলক, এমন একটা দিন আসবে, যেদিন সারা দেশের মানুষ তোমার জন্মদিন উদ্যাপন করবে।” এখন যখন জন্মদিনে রেডিও, টেলিভিশন, পত্রিকায় আমাকে নিয়ে আলোচনা হয়, তখনই ওই আঙ্কেলের কথা মনে পড়ে।’
১৯৮৯ সালে একদিন মেসের ঘর ঝাড়ু দিচ্ছিলাম। তখন এক সঙ্গীর বাবা বেড়াতে এলেন। তিনি আইনজীবী ছিলেন। জন্মদিনের কথা শুনে বলেছিলেন, “মন খারাপ কোরো না পুলক, এমন একটা দিন আসবে, যেদিন সারা দেশের মানুষ তোমার জন্মদিন উদ্যাপন করবে।” এখন যখন জন্মদিনে রেডিও, টেলিভিশন, পত্রিকায় আমাকে নিয়ে আলোচনা হয়, তখনই ওই আঙ্কেলের কথা মনে পড়ে।
জীবনের শিক্ষা
কষ্টের দিনগুলোই তাঁকে গড়ে দিয়েছে। জাহিদ হাসান মনে করেন, জীবন তাঁকে শিখিয়েছে ভাগাভাগি, ছাড় দিতে জানা, কম্প্রোমাইজ করা। ‘মেসজীবনের শুরুতে এমনও দেখেছি যে বাথরুমে সাবান, শ্যাম্পু রেখে আসতাম, পরে আরেকজন এসে বলত, “বাথরুমে রেখে এসেছ কেন, আরেকজন তো ব্যবহার করবে।” আমি বলতাম, “করুক। সমস্যা কী?” অথচ সাবান পাতলা কাগজের মতো হয়ে যেত। শ্যাম্পু বোতলে থাকত না।’
তিনি জীবনকে ব্যাখ্যা করেন এভাবে—‘জীবনটা আসলে আয়নার মতো। আয়নায় আমি ভেংচি কাটলে আয়নাও ভেংচি কাটবে। হাসলে আয়নাও হাসবে। আবার অনেক সময় জীবনটা কাঁঠালের মতো, কোনো কিছুই ফেলনা নয়।’
কথা প্রসঙ্গে জাহিদ হাসান আরও বলেছেন, ‘এই জীবনে দুঃখকষ্ট, ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, অবহেলা, তাচ্ছিল্য—সবই পেয়েছি। সবাই পায়, কমবেশি। সঠিকভাবে সামলে নিতে পারলেই হয়। কম্প্রোমাইজ করা, শেয়ার করা, ক্ষমা করে দেওয়া, মানুষের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করা—এসবই শিখেছি। এটাই করে যাওয়ার চেষ্টা করছি। তবে হতাশও হয়েছি। আবার কাটিয়ে উঠেছি। তাচ্ছিল্য যেমন অনেক পেয়েছি, লড়াইও করেছি। এই তাচ্ছিল্য বা অবহেলার সময় কেউ না কেউ সঙ্গী হয়ে আসে। হয় মানুষ, না হয় বই কিংবা একটা গান। ’
জাহিদ হাসান স্মৃতিচারণে ছিল এমন গল্পও, ‘৮৮ সালের বন্যার সময় টিএসসি থেকে হেঁটে হেঁটে রামপুরায় যাই। কারণ, পকেটে টাকাপয়সা নেই। পানি মাড়িয়ে ওখানে যাই। বলা যায়, আমার দীনহীন অবস্থা। ৯০-৯১ সালে মানসিকভাবেও জর্জরিত অবস্থা। এরপর কোথায় যেন কী পড়লাম, তারপর আর হতাশ হইনি।’
এই জীবনে দুঃখকষ্ট, ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, অবহেলা, তাচ্ছিল্য—সবই পেয়েছি। সবাই পায়, কমবেশি। সঠিকভাবে সামলে নিতে পারলেই হয়। কম্প্রোমাইজ করা, শেয়ার করা, ক্ষমা করে দেওয়া, মানুষের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করা—এসবই শিখেছি। এটাই করে যাওয়ার চেষ্টা করছি। তবে হতাশও হয়েছি। আবার কাটিয়ে উঠেছি।
থিয়েটারের শুরুর দিনগুলো
সিরাজগঞ্জে থাকতেই থিয়েটারে যুক্ত ছিলেন জাহিদ হাসান। ঢাকায় এসে শুরুটা ছিল আরও কঠিন। থিয়েটারচর্চা শুরুর দিকের স্মৃতিচারণা করে এ অভিনেতা বলেন, ‘সিরাজগঞ্জে যাঁরা অভিনয় শেখাতে যেতেন, ঢাকায় এসে তাঁদের সঙ্গে দেখা করি। থিয়েটারে যোগ দেওয়ার ইচ্ছার কথা জানাই। তাঁরা বললেন, “আমরা জুনিয়র ছেলেদের নিই না।” মনটা খারাপ হয়ে গেল। কিন্তু আমি হাল ছাড়িনি। ধীরে ধীরে আবারও কাজ শুরু করি। একটাই চিন্তা ছিল, ভালো করতে হবে। একসময় ভালো করতে থাকলাম। তখন তাঁরাই আবার এসে বলা শুরু করলেন, “জাহিদ তো আমার আত্মীয়, ওর সঙ্গে তো আমার সিরাজগঞ্জ থেকে পরিচয়”।’
তিনি জীবনকে ব্যাখ্যা করেন এভাবে—‘জীবনটা আসলে আয়নার মতো। আয়নায় আমি ভেংচি কাটলে আয়নাও ভেংচি কাটবে। হাসলে আয়নাও হাসবে। আবার অনেক সময় জীবনটা কাঁঠালের মতো, কোনো কিছুই ফেলনা নয়।
ঢাকার নাট্যদলে যুক্ত হওয়ার পর নিয়মিত অনুশীলনে আসতেন জাহিদ হাসান। অনেকে তখন ব্র্যান্ডের দামি পোশাক পরে আসতেন। কিন্তু এই অভিনেতার কোনো ট্র্যাকস্যুট, ট্রাউজার বা ভালো পোশাক ছিল না। ছিল শুধু একটা সাধারণ প্যান্ট। সেই প্যান্টেও হাঁটুর কাছে ছেঁড়া ছিল। সেভাবেই মহড়ায় যেতেন এই অভিনেতা।
স্মৃতিচারণা করে জাহিদ হাসান আরও বলেন, ‘আমি একটা সাধারণ গেঞ্জি আর সাধারণ ছেঁড়া প্যান্ট পরে রিহার্সালে আসতাম। মাঝেমধ্যে বড় টিচাররা এসে অভিনয়ের বিভিন্ন দিক নিয়ে লেকচার দিতেন। সেগুলো লেখার জন্য সবাই বড় বড় ডায়েরি নিয়ে আসত। অভিনয়ের খুঁটিনাটি শিক্ষকদের কাছ থেকে শুনে নোট করে রাখত। লেখার জন্য আমার কাছে থাকত খাতার একটা পেজ আর কলম। সেই এক পেজে আমার লেখা হতো না। তাই অল্প জরুরি কথা শব্দে টুকে রাখতাম। নিজেকে বোঝাতাম অভিনয় তো আর থিওরিটিক্যাল না, এটা প্র্যাকটিক্যাল। অভিনয় বোধের বিষয়।’ বেশভূষা দেখে অনেকেই জাহিদ হাসানকে সেভাবে মূল্যায়ন করতেন না। তিনি জানান, যাঁরা থিয়েটারে মোটরসাইকেল, বেবি ট্যাক্সি নিয়ে আসতেন, তাঁদের সমীহের চোখে দেখা হতো। তিনি বলেন, ‘আমরা যারা অতি সাধারণভাবে আসতাম, তাদের নিচু চোখে দেখা হতো। তখন মনে কষ্ট পেতাম। অথচ শেখ সাদি কিন্তু বলে গেছেন, পোশাকেই মানুষের পরিচয় নয়। তারপরও মানুষ মানুষকে পোশাক দেখে মূল্যায়ন করে। কিন্তু মানুষের ভেতরে কী আছে, তার মূল্যায়ন এখনো খুব কমই হয়।’
অভিনয় ও জনপ্রিয়তা
মঞ্চনাটকের মাধ্যমেই ১৯৮৪ সালে টেলিভিশনের পর্দায় আসেন জাহিদ হাসান। ১৯৮৬ সালে বড় পর্দায় অভিষেক ঘটে ‘বলবান’ ছবিতে। নব্বইয়ের দশকে নাটকে অভিনয় করে বিপুল জনপ্রিয়তা পান। বিশেষ করে হুমায়ূন আহমেদের নাটক ও চলচ্চিত্রে তাঁর অভিনয় তাঁকে পৌঁছে দেয় শীর্ষে।
চলচ্চিত্রেও রেখেছেন সাফল্যের ছাপ। ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’, ‘মেড ইন বাংলাদেশ’, ‘প্রজাপতি’ তাঁর উল্লেখযোগ্য সিনেমা। সর্বশেষ মুক্তিপ্রাপ্ত ‘উৎসব’ সিনেমায় ‘খাইস্টা জাহাঙ্গীর’ চরিত্রে অভিনয় করে নতুন করে আলোচনায় আসেন। এর আগে ওয়েব সিরিজ ‘আমলনামা’য় তাঁর অভিনয়ও প্রশংসিত হয়েছে।
অভিনয়ের পাশাপাশি নির্মাতা হিসেবেও খ্যাতি পেয়েছেন জাহিদ হাসান। তাঁর পরিচালিত ধারাবাহিক নাটক ‘লাল নীল বেগুনী’ এবং ‘টোটো কোম্পানি’ দারুণ জনপ্রিয় হয়। আরও নির্মাণ করেছেন ‘ঘুঘুর বাসা’, ‘চোর কুটুরি’, ‘একা’ ও ‘ছন্নছাড়া’। টেলিছবির মধ্যে রয়েছে ‘রুমঝুম’, ‘বোকা মানুষ’, ‘ব্যবধান’, ‘স্বপ্নের গ্রহ’, ‘অপু দ্য গ্রেট’, ‘প্রাইভেট ডিটেকটিভ’ ও ‘বাউন্ডুলে এক্সপ্রেস’।
ব্যক্তিগত জীবনে জাহিদ হাসান বিয়ে করেছেন মডেল ও নৃত্যশিল্পী সাদিয়া ইসলাম মৌকে। তাঁদের দুই সন্তান রয়েছে—মেয়ে পুষ্পিতা এবং ছেলে পূর্ণ। জাহিদ হাসানের নিজস্ব প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ‘পুষ্পিতা প্রোডাকশন লিমিটেড’।
(প্রথম আলোতে দেওয়া জাহিদ হাসানের সাক্ষাৎকার থেকে তথ্য নেয়া)