‘শিল্পচর্চায় মেঘ ঘনীভূত হচ্ছে’

টিকে থাকতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে টেলিভিশন নাটক। বিষয়টি নিয়ে আর চুপ থাকতে চায় না টেলিভিশন অভিনয়শিল্পীদের সংগঠন অভিনয় শিল্পী সংঘ। কীভাবে আবার আশার আলো জাগানো যায়, সেই পথ খুঁজতেই গতকাল শনিবার সকালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির সেমিনারকক্ষে আয়োজিত হয়েছিল ‘সাম্প্রতিক কাহিনিচিত্র ও অভিনয় বাস্তবতা’ শীর্ষক সেমিনার। সেখানে অংশ নিয়েছিলেন পরিচালক, প্রযোজক, টেলিভিশনের কর্মকর্তা, অভিনয়শিল্পীসহ সংশ্লিষ্টজনেরা।
প্রতিনিয়ত নাটকের ভাষাবিকৃতি ঘটেছে। শিল্পীরা দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে সরে যাচ্ছেন। একপক্ষ শিল্পকে পণ্য বানিয়ে পকেট ভারী করছে, নীতিনির্ধারকদের অনীহা আর সিন্ডিকেটই নয়, শিল্পের দায় থেকে বহুদূরে এখন নাটক, খোদ নাটকের শিল্পীরাই এসব কথা বলেছেন।

সেমিনারে প্রথমেই মূল ধারণা পাঠ করেন অভিনেতা ও পরিচালক তৌকীর আহমেদ। তাঁর পাঠে উঠে আসে ব্রিটিশ শাসন থেকে বর্তমান বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক চর্চা। স্বাধীনতার পর দেশের গল্প, কাহিনিতে নিজস্ব ভাবধারা তৈরি হয়েছিল। জীবনঘনিষ্ঠ সেই গল্পগুলো যেন এখন ভাষা হারিয়েছে। নাটকে সস্তা বিনোদন, অরুচিকর বিষয়বস্তু, ভাষাবিকৃতি, অশ্লীল ইঙ্গিত দৃশ্যের আগমন, ভিউয়ের অতিরিক্ত মাতামাতিতে কমেডির পরিবর্তে ভাঁড়ামো জায়গা করে নিয়েছে।

টেলিভিশন, এজেন্সির অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি; সিন্ডিকেটে আটকে নাটকের মান তলানিতে ঠেকছে বলে মনে করেন তৌকীর আহমেদ। তাঁর দীর্ঘ বিশ্লেষণের প্রশংসা করেন মামুনুর রশীদ, জাহিদ হাসান, সালাহউদ্দিন লাভলু, জয়া আহসান, চঞ্চল চৌধুরী, আহসান হাবীব নাসিম, অপূর্বসহ উপস্থিত সবাই।

অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন অভিনেতা সাজু খাদেম। তিনি বর্তমান সময়ের শিল্পীদের প্রসঙ্গে বলেন, ‘এখন অনেক শিল্পী শুধু ভিউয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ। আমি এমন শুনেছি, কাউকে রাজাকারের চরিত্র করতে বললে “না” করেন। এর কারণ এতে তাঁর ভিউ কমে যাবে। শিল্পী তাঁর দায়িত্ব থেকে সরে যাচ্ছেন। কাহিনিচিত্রের নামে এখন চলছে কপি–পেস্ট, ভাষা বিকৃত করে দর্শক কী খায়, সেই নাটকের প্রচলন।’ দেশের নাটকের ভাষাবিকৃতি প্রসঙ্গে সাজু প্রশ্ন করেন নাট্যকার বৃন্দাবন দাসকে। হঠাৎ যেন আকাশ থেকে পড়েন এই নাট্যকার। থতমত ভঙ্গিতে বৃন্দাবন বলেন, ‘এই বিষয়ে অনেকেই তো আমাকেই বলে গ্রামের নাটকে আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করে ভাষা বিকৃত করছি। এখন নাটক লিখতেও কিছুটা আতঙ্কে থাকি। এর আগে যুদ্ধের একটি গল্প লিখলাম। চ্যানেল দেখে পরিচালককে বলেছে, গল্পে একজন নায়িকা লাগবে। অপ্রত্যাশিত এই বাধাও আমাদের মোকাবিলা করতে হয়।’

বর্তমান অভিনয়শিল্পীরা নাটককে পেশা হিসেবে নিচ্ছেন। সেখানে অনেকেই সৃজনশীলতার কথা না ভেবে নিজের পকেট ভারী করছেন। নেই মেধার পেছনে বিনিয়োগ, শিল্পীকুশলীদের মধ্যে নেই আদবকায়দা। প্রায়ই ফোনে জাহিদ হাসানকে শুনতে হয়, ‘বস, এক দিন লাগবে।’ কিছুটা মন খারাপ করে এই অভিনেতা বলেন, ‘বিশৃঙ্খলা ও দায়িত্বহীন বিষয়গুলো দিন দিন প্রকট হয়ে উঠছে। পরিচালক বলছেন, “জাহিদ, এটা গল্প...আপনি এর ওপর দুই মিনিট অভিনয় করবেন।” নিজেকেই ডায়ালগ বানিয়ে দিতে হচ্ছে। আবার তরুণেরা কিছু না শিখেই অভিনেতা হচ্ছেন। এভাবে শিল্পচর্চা করা নাটককে নিচে নামিয়ে দিচ্ছে।’

চঞ্চল চৌধুরী তাঁর অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করে প্রশ্ন তোলেন, নাটক–সিনেমা এখন শিল্পের জায়গায় আছে কি না? ‘২০ বছর ধরে দেখছি, নাটকের বাজেট কমছে। এখন চুক্তিভিত্তিকে চলে গেছে কাজ। একটা সময় লাভলু ভাইয়ের নাটকে কাজ করে দুই দিনও অতিরিক্ত সময় পেয়েছি। এখন এক দিন বৃষ্টি হলে বা ট্রাফিক জ্যামে শিল্পী আটকে থাকলে পরিচালককে চিন্তায় পড়তে হয়। কারণ, কাজগুলো এখন হয় চুক্তিভিত্তিক। বিভিন্ন শুটিং সেটের মনিটরের সামনে থাকা নির্মাতাকে দেখে কন্ট্রাক্টর মনে হয়। আমি নিজে এখানে কোনো বিজনেস করতে আসিনি। শিল্পচর্চায় মেঘ ঘনীভূত হচ্ছে।’ শিল্পীদের ‘স্বার্থপর’ অভিহিত করে পরিচালক সালাহউদ্দিন লাভলু বলেন, এখন বেশির ভাগ শিল্পী নিজের কাজ শেষ হলে সহকর্মীদের কথা ভাবেন না। অন্যের পাশে থাকার প্রয়োজনীয়তা কেউ মনে করেন না। শিল্পীরা মনন মেধায় এগিয়ে না থেকে শিল্পকে ভর করে এগোচ্ছেন। এভাবে শিল্পী কীভাবে শিল্পের দায় নেবেন?
টেলিভিশনের কর্তাব্যক্তিরা নাটকের বাজেট কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে বিজ্ঞাপন থেকে আয় কমে যাওয়াকে দায়ী করেন।

দেশে ৩৪টা চ্যানেল দরকার আছে কি না, একই সঙ্গে অনুষ্ঠানের সঙ্গে নিউজ মিশ্রণ চ্যানেল কতটা প্রয়োজন রয়েছে, সেসব নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। পে চ্যানেলের কথাও বলেন কেউ কেউ। মাছরাঙা টেলিভিশনের ইনচার্জ প্রোগ্রাম আরিফুর রহমান বলেন, নাটকের বাজেট ও চরিত্র নির্মাতারাই কমিয়েছেন। অন্যকে দোষারোপ করে লাভ নেই।

প্রযোজক মনোয়ার পাঠান বলেন, আর দশটা ব্যবসার মতো সৃজনশীল এই মাধ্যম নয়। এখানে সবাইকে নিজ জায়গা থেকে দায়িত্ব পালন করতে হবে। সবশেষে সাংস্কৃতিক অঙ্গন কোন পথে যাচ্ছে, সেগুলো নিয়ে দায়িত্বশীলদের সচেতনতার কথা বলেন মামুনুর রশীদ। তিনি মনে করেন, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে লড়াই করে শিল্পকে টিকে থাকতে হবে। সংস্কৃতিতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। শিল্পীদের শাসন নয়, তাঁদের মধ্যে সততা, বিবেকবোধ জাগ্রহ করতে হবে। সর্বোপরি বড় পরিসরে সরকারি ও টেলিভিশন নীতিনির্ধারকদের দায় নিতে হবে। ধুঁকে চলা সংস্কৃতির জন্য এগিয়ে আসতে হবে।
অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন ইলিয়াস কাঞ্চন, নরেশ ভূঁইয়া, তারিন, রওনক হাসান, নাট্যকার হারুন রশিদ, এজাজ মুন্না, গ্লোবাল ও গ্রিন টিভির সিইও ইশতিয়াক রেজা ও আলী হায়দার। এ ছাড়া ছিলেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, বিঞ্জ, বঙ্গের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ সাংস্কৃতিক অঙ্গনের মানুষেরা।