ছবিতে মাসুম আজিজের শৈশব, সংগ্রাম ও বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ার

গাজীপুরের পুবাইলে একটি নাটকের শুটিং। পরিচালক যথারীতি মুঠোফোনে জানিয়ে দিয়েছেন, সকাল ১০টায় কল টাইম। অভিনেতা ঠিক সময়মতো হাজির। এই অভিনেতা এবার কস্টিউম কোনটি পরবেন, সেটা দেখিয়ে দিতে রূপসজ্জা রুমে গেলেন নাটকের সহকারী পরিচালক। সহকারী পরিচালক তো মাসুম আজিজের কস্টিউম দেখে অবাক। এই পোশাক গল্পের সঙ্গে যাবে না। সঙ্গে সঙ্গে পরিচালক এসে হাজির। পরিচালক দেখেন, অভিনেতা মাসুম আজিজ চরিত্রের জন্য পুরোনো লুঙ্গি, গামছা, পাঞ্জাবি, সেন্ডেল এসব এনেছেন। তখন পরিচালক বললেন, ‘আপনার চরিত্র তো অফিসারের, কোর্ট–টাই লাগবে।’ এসব শুনে মাসুম আজিজ বললেন, ‘তুমি তো বাবা সেই কথা আমাকে আগে বলো নাই। চিত্রনাট্যও দাও নাই। কস্টিউম নিয়ে শুধু সময়মতো চলে আসতে বলেছ। আর পুবাইলের শুটিংয়ে গরিব, কৃষক এই চরিত্রের জন্যই বেশি ডাকে। আমাকে নিয়ে এর বেশি আর ভাবতে পারে না।’ তাঁর কথা শুনে পরিচালকসহ রূপসজ্জা রুমে থাকা অন্যরা হেসে কুটি কুটি। ঘটনাটি শোনা অভিনেতা সাজু খাদেমের কাছ থেকে। সেদিন আবার মাসুম আজিজ বাড়ি থেকে পোশাক আনার ব্যবস্থা করেছিলেন। ঠিকমতো কস্টিউম দিয়েই তাঁর শুটিং হয়েছিল। সাদামাটা জীবনের নিভৃতচারী এই অভিনেতা ছিলেন অভিনয়পাগল মানুষ। অসুস্থ শরীর নিয়েই অভিনয় করে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। আসুন ছবিতে দেখে নিই তাঁর জীবনী।
১ / ৯
১৯৫৩ সালের ২২ অক্টোবরে মাসুম আজিজের জন্ম হবিগঞ্জের বানিয়াচং-এ। তবে এই অভিনেতার স্থায়ী ঠিকানা পাবনা। মাসুম আজিজের বাবা পুলিশে চাকরি করতেন। সেই সূত্রে বৃহত্তর সিলেট, কুমিল্লা, নোয়াখালীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় তাঁর শৈশব কেটেছে।
ছবি: ফেসবুক
২ / ৯
শৈশব থেকেই তিনি ছিলেন দুরন্ত। এ জন্য প্রচুর বাবার হাতের পিটুনি সহ্য করতে হতো। কিন্তু তাঁর সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে থাকতে ভালো লাগত। বোনের গান শুনেই এই পাগলামির শুরু। তখন থেকেই বাড়িতে হারমোনিয়াম, তবলা বাজাতেন। সুযোগ পেলেই বাড়ি থেকে দূরে কোথাও ছুটে যেতেন। প্রথমে তিনি কুমিল্লায় একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ভর্তি হন। পরে আবার তাঁর বাবা বদলি হয়ে নোয়াখালীতে চলে যান। সেখানে একটি স্কুলে বাংলায় চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তি হন। পড়াশোনায় কখনোই মনোযোগী ছিলেন না।
ছবি: ফেসবুক
৩ / ৯
মাসুম আজিজ চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতেন। সেই সময় আন্তহল নাটক প্রতিযোগিতা হতো। একবার মাসুম আজিজকে আলাওল হলের প্রভোস্ট বললেন, নাটকের ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক করতে। মিউজিক করতে গিয়ে তিনি দেখেন, নাটকের প্রধান চরিত্রের অভিনেতা নেই। হলের প্রভোস্টের কথায় বাধ্য হয়ে সাত দিন প্রধান অভিনেতার জায়গায় প্রক্সি দেন মাসুম আজিজ। শেষ মুহূর্তেও সেই অভিনেতা অনুশীলনে না আসায় হল প্রভোস্টের কথায় প্রথম অভিনয় করেন মাসুম আজিজ। প্রতিযোগিতায় তিনি সেরা অভিনেতা হয়েছিলেন। পরের বছর তিনি আন্তহল থেকে নাটক নির্মাণ করে সেরা পরিচালক হন।
ছবি: ফেসবুক
৪ / ৯
পরপর দুবার সেরা অভিনেতা ও পরিচালক হয়ে তাঁর অভিনয়ের প্রতি ভালোবাসা জন্মে। কিছুদিন চট্রগ্রামে থিয়েটার চর্চা করেন। পরে পড়াশোনা শেষ করে চট্রগ্রাম থেকে ঢাকায় আসেন। যোগ দেন পদাতিক থিয়েটারে। শুধু মঞ্চ নাটকই তাঁর করে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল। তবে অর্থনৈতিক সংকটে সেখানে কিছুটা বাধা পড়ে। কিন্তু দমে যাননি এই অভিনেতা।
ছবি: ফেসবুক
৫ / ৯
জীবন চালাতে একসময় তাঁকে হিমশিম খেতে হয়েছে। ঢাকায় প্রথম দিকে তাঁর ঠিকমতো থাকা–খাওয়ার জায়গা ছিল না। এমনও হয়েছে, না খেয়ে ছাদে ঘুমিয়েছেন। বিয়ের পর আরও বেশি সংকটে পড়ে যান। দুই হাজার টাকা বেতনের চাকরির জন্যও অনেকের দ্বারস্থ হন। অবশেষে চাকরি পান ঢাকা আহ্‌ছানিয়া মিশনে, ভালো বেতন ছিল। তখন মঞ্চে অভিনয় একেবারে ছেড়ে দেন। এটাই ছিল তাঁর জীবনের টার্নিং পয়েন্ট। পরে অবশ্য চাকরি ছেড়ে আবার অভিনয়ে ফিরেছিলেন।
ছবি: ফেসবুক
৬ / ৯
১৯৮৫ সালে প্রথম বাংলাদেশ টেলিভিশনে অভিনয় করেন। তার পর থেকে মঞ্চ ও টেলিভিশনে নিয়মিত অভিনয় করে গেছেন। কিন্তু অভিনয় নিয়ে দীর্ঘ ক্যারিয়ারে তাঁর আশা পূরণ হয়নি। তাঁকে শুধু একই ঘরানার কাজে ব্যবহার করা হয়েছে। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘অভিনয় জেনে বসে থাকা অনেক কষ্টের। আমার পছন্দমতো চরিত্রের এখনো তেমন দেখা পাইনি। তবে কিছু চরিত্র আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে।’
ছবি: ফেসবুক
৭ / ৯
এই অভিনেতার সর্বাধিক পছন্দের চরিত্র ছিল, ‘একজন আয়নাল লস্কর’ ও ‘ঘানি’ সিনেমায়। মাসুম আজিজকে সেরা পার্শ্বচরিত্রে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার এনে দিয়েছিল ‘ঘানি’ সিনেমা। এ ছাড়া ‘গহিনে শব্দ’ তাঁর পছন্দের কাজ। হ‌ুমায়ূন আহমেদের ‘উড়ে যায় বকপক্ষী’ তাঁকে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা দিয়েছে।
ছবি: ফেসবুক
৮ / ৯
তবে মাসুম আজিজ তাঁর ক্যারিয়ারের সেরা প্রাপ্তি হিসেবে মনে করেন ভক্তদের ভালোবাসা। সেই ভালোবাসা তিনি জীবদ্দশায় পেয়েছিলেন। একবার রংপুরে একটি নাটকের শুটিংয়ে গিয়েছিলেন। হঠাৎ তিনি দেখতে পান, এক বৃদ্ধ মহিলাকে কেন্দ্র করে বড় জটলা। ওই মহিলা মাসুম আজিজের সঙ্গে দেখা করবেন। এই অভিনেতা এগিয়ে গিয়ে দেখেন, সেই মহিলা টিফিন ক্যারিয়ারে কিছু খাবার নিয়ে এসেছেন। মাসুম আজিজের কাছে এসে সেই মহিলা বলেন, ‘আমি অনেক দূর থেকে এসেছি। মুরগির গোশত দিয়ে আপনাকে ভাত খাওয়াব।’ মাসুম আজিজ সেদিন প্রশ্ন করেছিলেন, ‘কেন?’ সেই মহিলা জানিয়েছিলেন, ‘আপনি খাইতে পান না, এ জন্য।’ শুনে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন মাসুম আজিজ। পরে তিনি বুঝতে পারেন, একটি নাটকে খাইতে পান না, খাবার কষ্ট করেন, এমন দৃশ্য ছিল। সেই দৃশ্যগুলোকেই এই মহিলা সত্য মনে করেছিলেন। এটা তাঁর ক্যারিয়ারের সেরা প্রাপ্তি।
ছবি: ফেসবুক
৯ / ৯
তিনি নিজেকে গানের মানুষ পরিচয় দিতে ভালোবাসতেন। দীর্ঘ ক্যারিয়ারে তিনি একই সঙ্গে ছিলেন অভিনেতা, চিত্রনাট্যকার ও পরিচালক। দীর্ঘ কর্মজীবনে তিনি চার শর বেশি নাটকে অভিনয় করেছেন। কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ শিল্পকলায় অবদানের জন্য এই বছর তাঁকে একুশে পদক দেওয়া হয়।
ছবি: ফেসবুক