১৯৬৩ সালে মঞ্চে অভিনয়ের মাধ্যমে ফকরুল হাসান বৈরাগীর পথচলা। স্বাধীনতার আগেই রেডিওতে কাজ করেছেন। এরপর চলচ্চিত্রে সহকারী পরিচালক, পরে পরিচালক ও অভিনেতা। বরেণ্য পরিচালক ঋত্বিক ঘটকের সঙ্গে ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ ছবিতে সহকারী হিসেবে কাজের সুযোগ পান। এরপর নিজেই পরিচালক হিসেবে যাত্র শুরু।
কত বছর ধরে আড়ালে আপনি, এখন কোথায় থাকেন?
ফকরুল হাসান বৈরাগী : ঢাকার পাশেই কেরানীগঞ্জের আঁটিবাজার এলাকায়। সন্তান, নাতিদের সঙ্গে থাকি। ১২ বছর ধরে আড়ালে। চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট কোথাও যাই না। এখানেই আমার সুন্দর সময় কেটে যায়।
প্রথম আলো :
একসময়ের ব্যস্ত আপনার এমন জীবনের সিদ্ধান্ত কি ভেবেচিন্তে নেওয়া?
ফকরুল হাসান বৈরাগী : এটা একান্তই আমার নিজের সিদ্ধান্ত। একদিন সুন্দর সকালে মনে হয়, আমি এই জীবন আর চাই না। তাই সব ছেড়েছুড়ে এই জীবনটা কাটাচ্ছি। আমি যে এই পেশায় এসেছি, তা কেউ আমাকে বলেনি। ভালো লেগেছে, ইচ্ছায় এসেছি। আসার সময় যেমন কেউ কিছু বলেনি, ছেড়ে দেওয়ার সময়েও কেউ কিছু বলেনি।
প্রথম আলো :
তাহলে কি ধরে নেব, আনন্দের ছন্দপতন হয়েছিল?
ফকরুল হাসান বৈরাগী : আমি যদি শিল্পমাধ্যমে কাজ করাটাকে জব স্যাটিসফেকশন হিসেবে দেখি। যদি বলি, ছাড়ার সময় সেটা ছিল না। কাজ ভালো লাগছিল না। ভালো গল্প পাচ্ছিলাম না। তবে এটা কিন্তু একমাত্র কারণ নয়।
প্রথম আলো :
এখন কেমন আছেন? কীভাবে সময় কাটে আপনার?
ফকরুল হাসান বৈরাগী : আমার যে বয়স সে অনুযায়ী ভালোই আছি। হাঁটুতে জোর কম, চলাফেরায় কষ্ট হয়। মাঝেমধ্যে মাথা ঘোরে, নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলি। ২৫ বছর ধরে ডায়াবেটিস আছে—এসব নিয়েই বেঁচে আছি। ২০১৩ সাল থেকে ধীরে ধীরে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছি। আগের দিনগুলো এখন আর মনে পড়ে না, মনে পড়ুক চাইও না। যেটা ভালো লেগেছে, সেটাই করেছি। যখন মনে হয়েছে অনেক হয়েছে, তখন সব ছেড়ে দিয়েছি। এখন ইউটিউবে নাটক দেখি, টিভিতে খবর দেখি—এ পর্যন্তই।
আপনি যখন অভিনয় শুরু করেন, তখন অভিনয়কে সমাজ কীভাবে দেখত? এখন কীভাবে দেখে, আপনার মতে?
ফকরুল হাসান বৈরাগী : সাধারণ মানুষ যাঁরা, তাঁরা অভিনয় দেখে উপভোগ করতেন। পারিবারিক বলয়ে, আব্বার বন্ধুবান্ধব যাঁরা ছিলেন, যাঁরা চাকরিবাকরি করতেন—তাঁরা যে পছন্দ করতেন, তা কিন্তু নয়। যার জন্য আমি একটু আলাদা থাকতাম। আলাদা মানে, বাড়ি একই, সময়টা কাটাতাম আলাদা। তখন আমরা ধানমন্ডিতে থাকতাম। নাটকের বন্ধুবান্ধব, তাদের সঙ্গে ওই সময়টা কাটত বেশি।
প্রথম আলো :
তখন আপনার বন্ধু কারা ছিলেন?
ফকরুল হাসান বৈরাগী : আমি যখন মঞ্চে কাজ শুরু করি, তখন তো অনেকেই ছিল, সবাই পরিচিত ছিল। সিনিয়র যত আর্টিস্ট আছেন—ফতেহ লোহানী, আনোয়ার হোসেন, গোলাম মুস্তাফা, খান আতা—এঁদের সবাই ছিলেন। কেউ ছিলেন বন্ধুর মতো, কেউ ভাইয়ের মতো। আমরা তখন আড্ডা মারতাম একসঙ্গে।
পারিবারিক পরিবেশে শিল্পচর্চার কোনো অনুপ্রেরণা ছিল কি?
ফকরুল হাসান বৈরাগী : আমার আম্মা ছিলেন গৃহিণী, বাবা বুয়েটের হিউম্যানিটস বিভাগের প্রধান ছিলেন। ভাইবোনদের কেউ এই অঙ্গনে কাজ করেনি। আমার বংশে আমিই প্রথম অভিনয় করি, আমার পরেও আর কেউ করেনি।
প্রথম আলো :
আপনি কি পরিবারের বড় সন্তান ছিলেন?
ফকরুল হাসান বৈরাগী : আমি বড় সন্তান। তিন ভাই, দুই বোনের মধ্যে ছিলাম সবার বড়। দুই বোন ছিল পিঠাপিঠি, তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর। মেজ ভাই নাজমুল হাসান বুয়েট থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে কিছুদিন দেশে চাকরি করে, এরপর অস্ট্রেলিয়া চলে গেল, এখন আইটি বিশেষজ্ঞ। একদম ছোট ভাই মইনুল হাসান বাংলাদেশ থেকে ডিপ্লোমা শেষ করে দেশের বাইরে দীর্ঘ সময় চাকরি করেছে। এখন দেশে পারবারিক ব্যবসায় সময় দিচ্ছে। আমার তিন ছেলে, এক মেয়ে। মেয়ে পড়াশোনা শেষ করে বিবাহিত। বড় ছেলে বিকম পাস করেছে। পরের ছেলে ইন্টারমিডিয়েট শেষ করে, ছোট ছেলে অনার্স শেষ করল।
প্রথম আলো :
ছোটবেলায় কেমন স্বপ্ন দেখতেন? কখনো ভাবতেন অভিনয় করবেন?
ফকরুল হাসান বৈরাগী : আমি অন্য কোনো স্বপ্ন দেখতাম না। আমার নিজের ইচ্ছা ছিল না, কোনো লক্ষ্যও ছিল না। ভালো লাগত, তাই অভিনয় করতাম। স্কুলজীবন থেকে অভিনয়ের শুরু। এর বাইরে আমার কোনো ধরনের শখ বা নেশা ছিল না।
কোথায় পড়াশোনা করেছেন? শিক্ষাজীবনে কোনো শিক্ষক বা বন্ধু কি আপনাকে শিল্পের পথে উৎসাহ দিয়েছেন?
ফকরুল হাসান বৈরাগী : আমার স্কুলজীবন ঢাকার কলেজিয়েট স্কুল। ইন্টারমিডিয়েট নটর ডেম কলেজ। এরপর বুয়েটে ভর্তি হই। সেকেন্ড ইয়ারে ওঠার পর আমার আর পড়াশোনা হয়নি। এর আগে টেলিভিশনে ইনভলভ হয়ে গেলাম বেশি। মঞ্চও চলছিল। রেডিওতেও কাজ করছিলাম। টেলিভিশনের যাত্রা শুরুর কয়েক দিন পর আমি অভিনয় করি। সুনির্দিষ্ট করে কেউ আমাকে উৎসাহ দেয়নি। তবে এমনিতে সবাই বলত, আমার অভিনয় ভালো লাগে তাদের।
প্রথম আলো :
পরিবারের কেউ ছিলেন না, কিন্তু অভিনয়ের প্রতি আগ্রহ জন্মায় কীভাবে?
ফকরুল হাসান বৈরাগী : ১৯৬৩ সালের কথা, তখন ক্লাস এইটে পড়ি। আমরা বন্ধুরা মিলে নাটক করেছিলাম। ওটাই শুরু। এর পর থেকে অভিনয় কেন জানি ভালো লাগত। তখন মঞ্চ ছাড়া আর কিছু ছিল না। আমরা তখন থাকতাম ঢাকার পুরানা পল্টনে, সেখানেই আমার জন্ম। তবে আমার স্থায়ী পৈতৃক নিবাস ঢাকার ধানমন্ডির ভূতের গলিতে। স্কুলে পড়ার সময় নিয়মিত নাটকের মহড়ায় অংশ নিতাম।
প্রথম আলো :
একটা সময় তো বিয়ে করলেন। সংসার হলো আপনার। বাবা–মায়ের সংসারে অভিনয়ের সমর্থন বা উৎসাহ সেভাবে না পেলেও আপনার স্ত্রী কীভাবে আপনার শিল্পীজীবনকে দেখতেন? কতটা সমর্থন পেয়েছেন?
ফকরুল হাসান বৈরাগী : সেখানে কোনো সমস্যা হয়নি। পুরোটাই সমর্থন পেয়েছি। একটা সময় তো এমনও হয়েছে, আমি সাত দিন বাসায়ই ফিরিনি। আউটডোর ১০–১৫ দিনও কাজ করেছি। এ সময় সংসারের কোনো কিছু নিয়ে আমাকে ভাবতে হয়নি। সবকিছু আমার স্ত্রী ম্যানেজ করেছে। সব সে একা হাতেই করত। আমার সন্তানদের বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে পুরোটা সময় ওদের মা সব করেছে।
আপনার সন্তানদের নিয়ে কথা হচ্ছিল, তাঁরা কি কেউ আপনার পথ অনুসরণ করেননি?
ফকরুল হাসান বৈরাগী : তারা কেউই অভিনয়ের ব্যাপারে আগ্রহী হয়নি। আমিও চাপিয়ে দিতে চাইনি। আমি এটা মনে করি, এটা এমন একটা কাজ, যেটা মানুষকে মন থেকে করতে হয়। কেউ বলে দিলে অভিনয় হয় না। এটা মনের উপলব্ধি থেকে হতে হয়।
প্রথম আলো :
পরিবারে আপনার অনুপস্থিতির প্রভাব, দীর্ঘ অভিনয়জীবনে পরিবার থেকে দূরে থাকতে হয়েছে—তা নিয়ে কোনো আফসোস আছে?
ফকরুল হাসান বৈরাগী : একদমই আফসোস হয়নি। হয় না। এটা জীবনের অংশ, আফসোস করে আর কী হবে।
প্রথম আলো :
নিজের ভেতর অভিনেতা, না পরিচালক—কোন পরিচয়টিকে আপনি বেশি অনুভব করেন? কেন?
ফকরুল হাসান বৈরাগী : এটা আলাদা কিছু নেই। আমি সবকিছুই করতাম, যখন যেটার সুযোগ হতো। কোনোটার প্রতি আলাদা তাড়না অনুভব করি না।
প্রথম আলো :
আপনি যখন পরিচালনা করতেন, তখন গল্প বেছে নেওয়ার মাপকাঠি কী ছিল?
ফকরুল হাসান বৈরাগী : আমার মনে হতো, যে গল্পে আমি কনভিন্স হব, সেটাতে মানুষও কনভিন্সড হবে।
প্রথম আলো :
দেশের অনেক পরিচালকের সঙ্গে কাজ করেছেন। নিজে পরিচালনাও করেছেন। আবার ঋত্বিক ঘটকের মতো পরিচালকের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে খুব কাছ থেকে তাঁকে দেখেছেন—একজন নির্মাতা হিসেবে তাঁর সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য কী ছিল বলে আপনার মনে হয়?
ফকরুল হাসান বৈরাগী : সৈয়দ হাসান ইমাম ভাইয়ের মাধ্যমে ঋত্বিক ঘটকের সঙ্গে পরিচয়। আমার জীবনে ঋত্বিক ঘটক একটা দুঃখের অধ্যায়। এটাই আমার জীবনের একটা বড় দুঃখ। কারণ, উনার যে কাজের ধারা, কাজ করতে করতে বোঝার সময়টাই হয়নি। একটা মানুষকে তো বুঝতে সময় লাগে, কাজ করছি হয়ে গেছে—বিষয়টা মোটেও এমন নয়। ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ ছবির শুটিং একসময় শেষ হয়ে গেল। ভাবলাম যে ওনাকে বলব, আমি বুঝতে পারলাম না, তিনি হয়তো বলবেন, ঠিক আছে পরের ছবিতে কাজ করলে বুঝতে পারবে। আমিও হয়তো ওনার যে গুণ আছে, যোগ্যতা আছে, স্টাইল—সব বুঝতে পারব। ধারণা হবে তাঁর সম্বন্ধে। কিন্তু সেই সুযোগটা আমার জীবনে আর আসেনি। ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ শেষ করার পর তিনি কলকাতায় চলে গেলেন। এরপর একটা ছবি করলেন, তার কিছুদিন পর তিনি মারা গেলেন। তাই আমার পক্ষে তাঁর সাহাচার্য পাওয়া আর সম্ভব হয়নি। সেভাবে বিচার–বিশ্লেষণ করার মতো অবস্থা হয়নি। আমার জীবনে এই একটাই আফসোস, এটাই অনুশোচনা। যত দূর মনে পড়ে, শুটিংয়ের শুরুটা হয়েছিল ভৈরবের দিকে, তারপর কাজটা হয়েছে মানিকগঞ্জের শিবালয়ে। একটা মানুষের সঙ্গে পরিচয় হবে, তাঁর সঙ্গে ভাবের আদান–প্রদান হবে, তারপরই না হয় বৈশিষ্ট্য জানা যাবে। কিন্তু কাজ নিয়ে এতটাই ব্যস্ত ছিলাম যে সেভাবে জানার সুযোগটাই হয়নি। তারপরও বলতে হয়, টেকনিক্যালি তিনি খুবই সাউন্ড এবং তাঁর চোখ দুটো খুবই মারাত্মক ছিল।
আপনি এক যুগ ধরে আড়ালে, এই সময়ে আপনি কি আত্মজিজ্ঞাসার সুযোগ পেয়েছেন?
ফকরুল হাসান বৈরাগী : না, আমি যত দিন কাজ করেছি, কন্টিনিউ করেছি। কোনো বিরতি ছিল না। যার ফলে ওই সুযোগ হয়নি। আমি এত ছবি করেছি। একটার পর একটা করে গেছি। যখন কাজ করেছি, কাজের মধ্যেই ছিলাম। যখন কাজ ছিল না, করিনি। অবসর। আমার সময় কিন্তু কেটে যায়। প্রধানত ৯ বছর বয়সী একটা নাতি আছে, জন্মের পর থেকেই সে আমার সঙ্গে আছে। ওর সঙ্গে আমার দারুণ বন্ধুত্ব। ওর সঙ্গে সময় কেটে যায়। আর টেলিভিশন আছে, মোবাইল আছে, ইউটিউব তো আছেই। তা ছাড়া আমার সেভাবে উপলব্ধির কিছু আছে বলে মনে হয় না। যে জীবন কাটিয়ে এসেছি, সেটা একরকম সুন্দর ছিল। এখন যে জীবন কাটাচ্ছি, তা অন্য রকম সুন্দর।
প্রথম আলো :
একটুখানি যদি ফিরে যাওয়া যেত—কোন বয়সে, কোন সময়ে ফিরতে চাইতেন?
ফকরুল হাসান বৈরাগী : আমি পেছনে তাকাই না। যেটা গেছে। যে দিন চলে যায় তার দিকে তাকিয়ে কোনো লাভ হয় না। অনেকে নস্টালজিক হয়। কিন্তু আমার কাছে তা কোনো অর্থ বহন করে না। ভালো লাগছে, সবার দোয়ায় কাজ করে গেছি। ননস্টপ কাজ করেছি।