অমন পরিশীলিত সুরেলা কণ্ঠের দেখা মেলা ভার

মিতা হকের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন সংগীত, চলচ্চিত্র, নাটকসহ নানা অঙ্গনের মানুষকোলাজ

রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী মিতা হক আজ রোববার সকাল ৬টা ২০ মিনিটে রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। তাঁর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন সংগীত, চলচ্চিত্র, নাটকসহ নানা অঙ্গনের মানুষ। তাঁরা ফেসবুকে গভীর শোক প্রকাশ করে স্মরণ করেছেন এই রবীন্দ্রসংগীতশিল্পীকে।
     
মিতা হক ছিলেন অভিনয়শিল্পী খালেদ খানের সহধর্মিণী। বেশ কয়েক বছর আগে খালেদ খান মারা যান। তারপর থেকেই মিতা হক কিছুটা ভেঙে পড়েন। ক্রমে সেটা স্বাভাবিক হয়ে আসে। তিনি নিজের মতো করে গান নিয়ে থাকতেন।

রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী মিতা হক
ছবি: সংগৃহীত

এই রবীন্দ্রসংগীতশিল্পীর প্রয়াণের খবর শুনে নাট্যজন ও নির্মাতা নাসির উদ্দীন ইউসুফ ফেসবুকে লিখেছেন, ‘আনন্দের মাঝেই জীবন উথলিয়া ওঠে, এ কথা মিতাকে দেখলেই মনে হতো। দুঃখকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে জীবনের আনন্দে শিশুর মতো করতালি দিত। মিতার মতো জীবনকে ভালোবাসতে আমি কাউকে দেখিনি। এমনভাবে কাউকে জীবন উদ্‌যাপন করতে দেখিনি। শত কষ্ট-দুঃখের মাঝে কলকলিয়ে এভাবে হাসতেও দেখিনি কাউকে। অমন পরিশীলিত সুরেলা কণ্ঠের দেখা মেলা ভার। আর মিলবে কি না, জানি না। জীবন ও শিল্পের এমন শুদ্ধতম মিলন কালেভদ্রে ঘটে।’

নাসির উদ্দীন ইউসুফ
ছবি: সংগৃহীত

নাট্যজন আতাউর রহমান ফেসবুকে লিখেছেন, ‘মিতা, তুমিও আমাদের ছেড়ে চলে গেলে? আর কত সইব, এই বয়েসে, এই মহা দুঃসময়ে? তোমার কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথের গান ভিন্ন দ্যোতনায় অনুরণিত হতো। আর কখনো শুনব না তোমার কণ্ঠের গান। আর দেখব না তোমাকে। অনন্তলোকে ভালো থেকো।’

পাঁচ বছর ধরে মিতা হক কিডনির রোগে ভুগছিলেন। নিয়মিত চিকিৎসাও নিচ্ছিলেন। কিন্তু করোনার কাছে হারতে হলো তাঁকে। তিনি সমসাময়িক ও তরুণ প্রজন্মের কাছে সমান জনপ্রিয় ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর খবরে অভিনয়শিল্পী চঞ্চল চৌধুরী লিখেছেন, ‘উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী মিতা হক। আমাদের প্রাণের মানুষ মিতা আপা। তিনি চলে গেলেন সবাইকে ছেড়ে। আর কোনো দিন শুনতে পাব না আপনার গান। দেখতে পাব না আপনার হাসিমুখখানা।’

অপি করিম
ছবি: সংগৃহীত

সংগীতে দীক্ষা নিয়ে ১৯৯০ সালে বিউটি কর্নার থেকে প্রকাশিত হয় মিতা হকের প্রথম রবীন্দ্রসংগীতের অ্যালবাম ‘আমার মন মানে না’। তারপরে একে একে ২০০টি রবীন্দ্রসংগীতে কণ্ঠ দিয়েছেন। সেসব সংগীত তাঁকে পরিচিত করে তুলেছে অন্যতম একজন রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী হিসেবে। অভিনেত্রী অপি করিম ফেসবুকে লিখেছেন, ‘একটা একটা করে প্রিয় মানুষগুলো আমার জীবন থেকে ঝরে পড়ছে। মিতা আপা, এখন যুবদার সঙ্গে, একসঙ্গে অনেক ভালো থাকবেন আপনারা। আব্বার সাথে দেখা হলে “ওগো ঘুমভাঙানিয়া তোমায় গান শোনাবো” শুনিয়ে দেবেন কষ্ট করে, প্লিজ?’
সম্প্রতি এই অভিনেত্রী তাঁর বাবাকে হারিয়েছেন।

জয়া আহসান। ছবি: ইনস্টাগ্রাম

ভারত ও বাংলাদেশ থেকে তাঁর একে একে ২৪টি অ্যালবাম বের হয়েছে। তিনি গানের জন্য পশ্চিমবঙ্গের সংগীত অঙ্গনে বিশেষভাবে পরিচিত ছিলেন। তিনি ২০১৬ সালে শিল্পকলা পদক লাভ করেন। সংগীতে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁকে ২০২০ সালে একুশে পদক প্রদান করে। এই গানের মানুষ করোনায় আক্রান্তের আগপর্যন্ত গান নিয়ে সময় কাটিয়েছেন। তাঁর প্রিয় গানগুলো তাঁকে অনেক দিন এ দেশের মানুষের মধ্যে বাঁচিয়ে রাখবে। ঢালিউড অভিনেত্রী জয়া আহসান লিখেছেন, ‘মিতা হক আছেন। তাঁর গানের মধ্যে। আমাদের বুকের গভীরে।’
‘মিতা আপা, চোখ ভিজে যাচ্ছে, আর আপনার মায়াময় কণ্ঠস্বর মনে পড়ছে।’ লিখেছেন অভিনয়শিল্পী সংঘের সাধারণ সম্পাদক আহসান হাবীব নাসিম। তিনি আরও লিখেছেন, ‘তিনি যেমন সবাইকে সহযোগিতা করতেন, তেমন ছিলেন ভালো মানুষ। আদরমাখা ভালোবাসার কথা ছাড়া কখনো তাঁর মুখে অন্য কথা শুনিনি। আপার চলে যাওয়ায় সংগীতাঙ্গনে শূন্যতা তৈরি হলো।’ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সাধারণ সম্পাদক জায়েদ খান লিখেছেন, ‘আপনার জায়গা কখনো পূরণ হওয়ার নয়। আল্লাহ আপনাকে শান্তিতে রাখুক।’

চঞ্চল চৌধুরী। ছবি: ফেসবুক থেকে

‘সুরতীর্থ’ নামে একটি গানের স্কুলও রয়েছে তাঁর। একসময় ছায়ানটের রবীন্দ্রসংগীত বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এই সময়ে তাঁর কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে অনেকেই এখন নিয়মিত গান করছেন। মিতা হকের কাছে গান শিখেছেন অণিমা রায়। এই রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী লিখেছেন, ‘টানা ১৭-১৮ বছর আপনার ছায়ায় জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় পার করেছি মিতা আপা। আপনার মতো বলিষ্ঠ, উদার আর মমতাময়ী মানুষ পাইনি একজনও, শিক্ষক তো অনেক দূরের কথা। আপনি অনন্য মিতা আপা। আপনি বেঁচে থাকবেন তত দিন, যত দিন মানুষ রবীন্দ্রসংগীত গাইবে।’

মা–বাবাকে ছেড়ে প্রথম থিয়েটার করতে একা ঢাকায় এসেছিলেন অভিনেত্রী রুনা খান। তাঁর সেই আশা পূরণ করার জন্য কাছের বা দূরের কোনো আত্মীয়ের কাছে তিনি আশ্রয় পাননি। তাঁকে আশ্রয় দিয়েছিলেন খালেদ খান ও মিতা হক দম্পতি। সেই পরিবারের সঙ্গে কেটেছে ১৮ বছর। মিতা হকের স্মরণে রুনা খান লিখেছেন, ‘২০০৩ সালে তোমাদের বাড়িতে আশ্রয় হলো, আরাম হলো। তারপর থেকে কত স্মৃতি। আজকে তোমাকে রেখে আসার সময় মনে মনে শুধু বারবার বলেছি, তোমার শেষ আশ্রয়ে বসবাস আরামদায়ক হোক।’ রুনা খান আরও লিখেছেন, ‘আমার জীবনের একটা বড় অধ্যায়ের সমাপ্তি হলো ভোরে...। এই অধ্যায়ে আর কখনো কোনো নতুন স্মৃতি তৈরি হবে না...।’

রুনা খান
সংগৃহীত

মিতা হককে আরও স্মরণ করেছেন, তানভীন সুইটি, ইরেশ যাকের, মিথিলা, আনিসুর রহমান মিলন, শাহনাজ খুশী, সাজু খাদেম, ঊর্মিলা শ্রাবন্তীকরসহ আরও অনেকে। মিতা হকের জন্ম ১৯৬২ সালের সেপ্টেম্বরে, ঢাকায়। তাঁর চাচা দেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অগ্রপথিক ও রবীন্দ্রগবেষক ওয়াহিদুল হক। শৈশব থেকেই তাঁর সংগীতের ছোঁয়ায় বেড়ে ওঠা।

অণিমা রায়
ছবি: সংগৃহীত