ঈদে যাদের জন্য অপেক্ষা থাকত

>উত্সবভিত্তিক কিছু নাটকের চরিত্র দর্শকের খুব আপন হয়ে উঠেছিল। ঈদ এলেই ‘জব্বর আলী’, ‘আরমান ভাই’দের দেখার জন্য মানুষজন উদগ্রীব হয়ে উঠত। ভীষণ জনপ্রিয়তা পাওয়া তেমনই কিছু ঈদভিত্তিক নাটক ও চরিত্র নিয়ে এই প্রতিবেদন। লিখেছেন আমাদের প্রতিবেদক মনজুরুল আলম
জব্বর আলী নাটকের দৃশ্য
জব্বর আলী নাটকের দৃশ্য

জব্বর আলী প্রচারের পরদিন বের হওয়া যেত না

আশির দশকের কথা। ঈদের দিন সন্ধ্যা হলেই শহর–গ্রামের রাস্তা ফাঁকা হয়ে যেত! মনে হতো কারফিউ চলছে। কিন্তু বাস্তবতা ছিল সবাই তখন টেলিভিশনের সামনে গিয়ে স্থির, অপেক্ষা ঈদের নাটক জব্বর আলী দেখার। নাটকটি ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনের ঈদ অনুষ্ঠানমালার অংশ হিসেবে প্রথম প্রচারিত হয়। নাটকের পরিচালক এবং নাম ভূমিকায় অভিনয় করতেন বরেণ্য চলচ্চিত্র নির্মাতা আমজাদ হোসেন। তাঁর স্ত্রীর ভূমিকায় ছিলেন জাহানারা আহমেদ। ২০১১ সালে প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আমজাদ হোসেন জানিয়েছিলেন, ঈদ অনুষ্ঠানমালায় যেদিন জব্বর আলী প্রচার হতো, এর পরদিন রাস্তায় বের হওয়া যেত না, মানুষ তাঁকে ঘিরে ধরতেন। ‘টেকা দ্যান দুবাই যামু’, ‘জবা কুসুম রোকন দুলালের মা’–এর মতো নাটকের অনেক সংলাপ দর্শকদের মুখে মুখে ঘুরত। প্রতি ঈদের আগে নাটকটি হবে কি না, তা জানার জন্য একের পর এক দর্শকের ফোন আসত। নাটকের গল্পে উঠে আসত সমাজের বিভিন্ন স্তরের সামাজিক-প্রশাসনিক দুর্নীতি এবং উৎসবের মধ্য দিয়ে সেই গল্পের সমাপ্তি হতো।

তারা তিনজন নাটকে ফারুক আহমেদ, এজাজুল ইসলাম, স্বাধীন খসরু
তারা তিনজন নাটকে ফারুক আহমেদ, এজাজুল ইসলাম, স্বাধীন খসরু

তারা তিনজন

একটা সময় ছিল যখন ঈদ এলেই টিভি পর্দায় হুমায়ূন আহমেদের নাটক দেখার অপেক্ষায় থাকতেন দর্শক। তেমনই একটি নাটক ছিল পক্ষীরাজ। এই নাটকে অভিনয় করেন ফারুক আহমেদ, এজাজুল ইসলাম, স্বাধীন খসরু। নাটকটিতে এই তিন অভিনেতার রসায়ন নির্মাতা ও কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের খুব পছন্দ হয়। তখনই নির্মাতা সিদ্ধান্ত নেন এই তিনজনকে নিয়ে একটি নাটক বানাবেন। পরের ঈদের জন্য নির্মাণ করেন তারা তিনজন। ২০০০ সালের এক ঈদে নাটকটি প্রথম প্রচারিত হয়। বিপুল জনপ্রিয়তা পায় এই নাটক ও নাটকের তিন চরিত্র। পরে দর্শক চাহিদার কারণেই তৈরি হয় তারা তিনজন–এর সিকুয়েল। একে একে তারা তিনজন টি-মাস্টার, তারা তিনজন ঝামেলায়, তারা তিনজন হে পৃথিবী বিদায়, তারা তিনজন, ঝুনু খালাসহ এই সিরিজের ১১টি নাটক প্রচারিত হয়। প্রতিটি নাটকই উৎসবভিত্তিক অনুষ্ঠানমালার অংশ ছিল। অনেক দর্শক উৎসবের দিনগুলোতে অপেক্ষা করতেন ‘তারা তিনজন’–এর নাটক দেখার জন্য। এই সিকুয়েল দিয়ে তারা তিনজন চরিত্রের অভিনেতাদের অভিনয়জীবনের বাঁক বদলে যায়, ক্যারিয়ারে যোগ হয় ভিন্ন মাত্রা।

জনি ডেপের কারণে বন্ধ হয় আরমান ভাই!
জনি ডেপের কারণে বন্ধ হয় আরমান ভাই!

জনি ডেপের কারণে বন্ধ হয় আরমান ভাই!

২০০৮ সালের কথা। হঠাৎ একদিন নির্মাতা সাগর জাহান এলেন একটি চিত্রনাট্য নিয়ে। গল্পটি ঢাকাইয়া ভাষায়। চরিত্রের নাম আরমান। যাকে দেখা যাবে পান খেতে, রংচঙা পাঞ্জাবি পরতে, চোখে সুরমা দিতে—এভাবে ‘আরমান ভাই’ চরিত্রের কথা মনে করলেন জাহিদ হাসান। তিনি জানান, শুরুতে এই চরিত্র নিয়ে একটু দোটানায় ছিলেন তিনি। কিন্তু পরে যখন নাটকটি বাংলাভিশনে প্রচারিত হয়, ‘আরমান ভাই’ হয়ে ওঠে জাহিদ হাসানের অভিনয়জীবনের অন্যতম জনপ্রিয় চরিত্র। এই অভিনেতা বলেন, ‘আসলে চরিত্রের যৌক্তিক বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন, অভিনয়ের ভাষায় আমরা যাকে বলি “মেক বিলিভ”, এটি অর্জন করতে পেরেছিল আরমান ভাই।’ টানা চার বছর ঈদ অনুষ্ঠানমালায় একের পর এক আরমান ভাই সিরিজের নাটক আসতে থাকে। প্রতিটিই দর্শকের মধ্যে সাড়া ফেলে। পরিচিত হয়ে ওঠে নাটকের চরিত্র আর সংলাপগুলো। কিন্তু পঞ্চম বছরে এসে থেমে যায় আরমান ভাই। কারণ হিসেবে জাহিদ বলেন, ‘পাইরেটস অব দ্য ক্যারিবিয়ান ছবির শেষ পর্বটি দেখে জনি ডেপের অভিনয় আমার ভীষণ একঘেয়ে মনে হয়েছিল। তখনই আমার মনে হয়, এটা তো আমার সঙ্গেও ঘটতে পারে। তাই মনে হলো, সবার ভালোবাসা বজায় থাকতে থাকতেই সিরিজটি বন্ধ করা উচিত।’

প্রচারের পর দেখেছিলেন নাটকের নাম সিকান্দার বক্স
প্রচারের পর দেখেছিলেন নাটকের নাম সিকান্দার বক্স

প্রচারের পর দেখেছিলেন নাটকের নাম সিকান্দার বক্স

মোশাররফ করিম নাটকে এতটাই স্বাভাবিক অভিনয় করেছিলেন যে শুটিংয়ের সময় ক্যামেরার পেছনের কুশলীদের হাসি নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে যেত। দৃশ্য ধারণের সময়ই হেসে গড়িয়ে পড়তেন সহশিল্পী থেকে সেটের সবাই। ২০১৪ সালে সিকান্দার বক্স নামে একটি একক নাটকের প্রস্তাব পান মোশাররফ করিম। গল্প পছন্দ হলেও ব্যক্তির নামকেন্দ্রিক নাটকে অভিনয় করা নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন না এই অভিনেতা। নির্মাতা সাগর জাহানকে বলেছিলেন নাটকের নাম বদলাতে। নির্মাতাও প্রথমে রাজি হন। পরে দেখা যায়, নাটকটির নাম সিকান্দার বক্সই রয়ে গেছে। প্রথম পর্ব প্রচারের পরই ভক্তদের মুখে মুখে চলে আসে ময়মনসিংহের আঞ্চলিক ভাষায় লেখা সংলাপগুলো—আমি কিতা করাম, কেয়েছি, আবেগে কাইন্দালাছি, আমার এত আবেগ ক্যারে ইত্যাদি। সংলাপগুলো নিয়ে ফেসবুকে ট্রল আর মিমও প্রচার হতে থাকে। উৎসবভিত্তিক নাটক হিসেবে একটানা কয়েক বছর চলার পর যখন সিকান্দার বক্স শেষ করার ঘোষণা দেওয়া হয়, তখন পরিচালক ভীষণ বিড়ম্বনায় পড়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘নাটকটি শেষ হয়ে যাচ্ছে শুনে সে সময় অনেক দর্শক আমাকে ফোনে–ফেসবুকে সিকান্দার বক্স চালু রাখার জন্য হুমকি–ধমকি দিয়েছেন।’

যমজ আর না–ও হতে পারে
যমজ আর না–ও হতে পারে

যমজ আর না–ও হতে পারে

তখনপ্রচণ্ড গরমের সময়। মোশাররফ করিমের কাছে আসে যমজ নাটকের প্রস্তাব। নাটকে তিনটি চরিত্র বাবা ও দুই ভাই। ভাইয়ের চরিত্র নিয়ে সমস্যা না থাকলেও বাবা চরিত্রের জন্য মুখে দাড়ি লাগাতে গিয়ে বেঁকে বসেন মোশাররফ করিম। পরে চরিত্রের বৈচিত্র্যের কথা ভেবে রাজি হন তিনি। নাটকটি শুরুতে এসএ টিভিতে প্রচারিত হয়। পরে এক বছর বিরতি দিয়ে টানা সাত বছর এটি আরটিভিতে প্রচার হচ্ছে। কিন্তু সম্প্রতি একটি সূত্র থেকে জানা যায়, ঈদকেন্দ্রিক এই জনপ্রিয় নাটকের নতুন কোনো পর্ব আর না–ও আসতে পারে। কারণ, নাটকের শিল্পীরা চান একটি চরিত্রে আবদ্ধ না থেকে নতুন কিছু দিয়ে দর্শকদের বিনোদিত করতে।