‘এখন মহড়ার কথা শুনলে সবাই ঠাট্টা করে’

বাংলাদেশের মঞ্চ ও টেলিভিশনের জীবন্ত কিংবদন্তি অভিনেত্রী ফেরদৌসী মজুমদার। ১৮ জুন শুক্রবার ছিল তাঁর ৭৮তম জন্মদিন। দীর্ঘ ক্যারিয়ারে তিনি অভিনয় করেছেন রেডিও, মঞ্চ, টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রে। গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপে গতিময় অভিনয়জীবনের শুরুর দিকের কিছু স্মৃতি তিনি তুলে ধরেন। সেখান থেকে কিছুটা তুলে ধরা হলো পাঠক ও তরুণ অভিনয়শিল্পীদের জন্য।

মঞ্চে ফেরদৌসী মজুমদার, ‘কোকিলারা’ নাটকে। ছবি: প্রথম আলো

সংলাপ মনে করতে গেলে অভিনয় হয় না
ফেরদৌসী মজুমদার কখনো ভাবেননি যে সোয়া দুই ঘণ্টা ধরে কোনো নাটকে তিনি একক অভিনয় করবেন। নির্দেশক আবদুল্লাহ আল মামুন অভয় দিয়েছিলেন বলেই সেটা সম্ভব হয়েছিল। ফেরদৌসীর মতে, তিনি যে জাত-নাট্যকার, নির্দেশক সেটা তিনি তখনই বুঝেছিলেন। সেই নাটকে যুক্ত হওয়ার সময়ে অভিনেতা ও নাট্যকারের সংলাপ ছিল এ রকম। ফেরদৌসীর বয়ানে—খুব শান্তভাবে তিনি একদিন বললেন, ‘একটা একক নাটক লিখেছি—কোকিলারা। ইন্টারভ্যালসহ সোয়া দুই ঘণ্টা। আপনি করবেন এটা।’ আমি প্রথমে বলেছিলাম, ‘সেটা তো আমি পারব না।’ প্রায় ১৭–১৮টি চরিত্র! তিনি বললেন, ‘আপনি না পারলে আর কে পারবে আমি জানি না। আপনাকে পারতেই হবে।’ আমি বললাম, ‘এত ডায়ালগ আমি কীভাবে মুখস্থ করব?’ তিনি বললেন, ‘আমি আপনাকে সময় দিলাম। এক মাস, দুমাস, তিন মাস। এক বছর! তাও হবে না?’ আমি বললাম, ‘তা তো জানি না।’ তিনি আবারও বললেন, ‘আপনি শুধু সংলাপগুলো মুখস্থ করে আমাকে বলেন যে মুখস্থ হয়েছে।’
স্মৃতিচারণা করতে করতে ফেরদৌসী বলেন, ‘আমি সেই থেকে শিখলাম, যেকোনো নাটকে নাট্যকারের যে সংলাপ, সেটা যদি কারও আয়ত্তে থাকে, তাহলে অভিনয় সহজ হয়ে যায়। সংলাপ মনে করতে গেলে কিন্তু অভিনয় হয় না। অভিনয় করতে গেলে সংলাপ মুখস্থ করতেই হবে। সংলাপ নাটকের প্রাণ। নাট্যকার অনেক চিন্তা করে সংলাপ লেখেন। তাঁর প্রতি সৎ থেকে আমাকে সংলাপ মুখস্থ করতে হয়। তবেই আমার অভিনয় ভালো হবে, লোকের কাছে সেটা মনোগ্রাহী হবে।’

‘কোকিলারা’ নাটকে ফেরদৌসী মজুমদার। ছবি: সংগৃহীত

আফসোস, আক্ষেপ, অগ্রগতি
কেবল কোকিলারা নয়, যেকোনো নাটক করে বাড়ি ফেরার পর খুব আফসোস হতো ফেরদৌসীর। সেই আফসোস ও আক্ষেপ তাঁকে এগিয়ে নিয়ে এসেছে এতটা দূর। তাঁর মনে হতো, ‘আজকের অভিনয় আরেকটু ভালো হতে পারত। মাথার ভেতর ঘুরত, কোথায় ভুল করলাম। সন্তুষ্টি থাকত না।’ তাঁর মতে, মঞ্চে সব সময়ই ভালো করার সুযোগ থাকে। তিনি বলেন, ‘আমি সঙ্গে সঙ্গে দর্শকদের কাছ থেকে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া পাচ্ছি। পরের প্রদর্শনীতে সেগুলো শুধরে নেওয়া যায়। নাটকের লোক বা দর্শকদের আলোচনাতেও বোঝা যায়। তাতে আর্টিস্ট নিজেকে সংশোধন করতে পারে। মঞ্চের একটা বিরাট সুবিধা হচ্ছে, এখানে অভিনয়ের গভীরতা তৈরি করা যায়, চরিত্রের গভীরে যাওয়া যায়।’

এক ফ্রেমে মোস্তফা কামাল সৈয়দ, মমতাজউদ্‌দীন আহমদ ও ফেরদৌসী মজুমদার। ছবি: সংগৃহীত

‘কোকিলারা’ তাঁকে করেছে অমর
প্রথম দিকে কোকিলারা মঞ্চায়নের সময় নাট্যকার আবদুল্লাহ আল মামুনকে ভীষণ চিন্তিত দেখাত। ফেরদৌসী বলেন, ‘দেখতাম তিনি গম্ভীর মুখে পায়চারি করছেন। কোকিলারা করতে গেলে আমার পা কাঁপত। কেননা, এখানে আমিই সব। আমার কোনো সহশিল্পী নেই। আবদুল্লাহ আল মামুন কিন্তু এ নাটকের শুরুর দিকে সন্তুষ্ট হননি। বলতেন, ‘আপনি ওই জায়গায় যাননি, আলোটা নেননি।’ বেশ কয়েকটি শো হওয়ার পর তিনি একদিন বললেন, ‘না হয়েছে।’ এখন তো সমালোচনাই হয় না। সমালোচনা না হলে একজন শিল্পী নিজেকে সংশোধন করতে পারে না। মামুন সাহেব আমাকে অনেকগুলো ভুলভ্রান্তি ধরিয়ে দেওয়ার পর আমি সেসব সংশোধন করেছিলাম। তারপর মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাই।’ মঞ্চের দর্শকেরা বিশ্বাস করেন, কোকিলারা নাটকটি তাঁকে অমর করে রাখবে।

ভারতে কিন্তু এখনো সংলাপ মুখস্থ করে। বড় বড় সব সংলাপ। ভারতের শিল্পীদের অভিনয় এত ভালো হয়, কারণ তাঁরা সংলাপ মুখস্থ করে বলেন

মহড়ার কথা শুনলে সবাই ঠাট্টা করে
সংলাপ মুখস্থ করার পাশাপাশি মহড়াকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেন অভিনেত্রী ফেরদৌসী মজুমদার। তিনি বলেন, ‘এখনো সংলাপ মুখস্থ ও মহড়ায় আমার আস্থা শতভাগ। আমি তো মনে করি, মহড়ার কোনো বিকল্প নেই। কেউ যদি মহড়া করে এগোয়, তাহলে সে একটা ভালো জায়গায় পৌঁছাতে পারে। আমাদের এখানে এখন মহড়ার কথা শুনলেই তো ঠাট্টা করে। অথচ সংশপ্তক-এর প্রতিটি দৃশ্যের আগে আবদুল্লাহ আল মামুন আমাদের মহড়া করাতেন। এর সুফল যে কী, এটা যারা করেছে, তারা জানে। আমি, ফরীদি, সুবর্ণা মুস্তাফা, আমরা জানি।’

ঢাকার নাট্যোৎসবে প্রয়াত অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও ফেরদৌসী মজুমদার। ছবি: প্রথম আলো

যে কারণে অপছন্দ ছিল সিনেমা
খুব বেশি সিনেমায় অভিনয় করা হয়নি এই অভিনেত্রীর। করেছিলেন মায়ের অধিকার ও মেঘলা আকাশ। আবদুল্লাহ আল মামুনের একটি সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন, যেটি শেষ পর্যন্ত মুক্তি পায়নি। সিনেমা কম করার কারণ হিসেবে তিনি বলেছিলেন, ‘সিনেমায় আমি মজা পেতাম না। আমার তো অভ্যাস সংলাপ মুখস্থ করা। কিন্তু ওখানে মুখস্থ করতে দিত না। একজন সংলাপ বলে, সেটা শুনে শুনে আমাকে বলতে হয়। আমি আনন্দ পেতাম না। আমাদের দেশে এই ব্যাপারটা নেই। ভারতে কিন্তু এখনো সংলাপ মুখস্থ করে। বড় বড় সব সংলাপ। আমি যখন একটা ডায়ালগ বলি, তখন আমি জানি যে এর পরের অভিব্যক্তি কী হবে। কিন্তু কেউ সেটা বলে দিলে অভিনয়ের স্বাদটা পাওয়া যেত না। ভারতের শিল্পীদের অভিনয় এত ভালো হয়, কারণ তাঁরা সংলাপ মুখস্থ করে বলেন।’

বাড়ির পড়ার ঘরে আড্ডায় ফেরদৌসী মজুমদার ও রামেন্দু মজুমদার
ছবি: প্রথম আলো

বেতারে অভিনয় আরও কঠিন
ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে বেতারে নাটক পাঠ করতেন অভিনেত্রী ফেরদৌসী মজুমদার। তবে তখনকার সময়ের খুব বেশি নাটকের কথা আজ আর তিনি মনে করতে পারেন না। মনে পড়ে কেবল নাট্যকার মমতাজউদদীন আহমদের লেখা কী চাহ শঙ্খচিল-এর কথা। একক এ নাটক নিয়ে তিনি বলেন, ‘তখন আমি পড়তাম। আসলে রেডিওর নাটক অনেক কঠিন। সেখানে আমাকে কেউ দেখতে পাচ্ছে না, অথচ শোক, দুঃখ, রাগ সবটা কণ্ঠ দিয়ে বোঝাতে হতো।’ ষাটের দশকে বেশ কিছু নাটক তিনি করেছিলেন বেতারে। আতিকুল হক চৌধুরীর নির্দেশনায় তাঁর করা কিছু নাটক বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছিল।