জন্মদিনে ফিরে ফিরে আসেন ফরীদি

১৯৫২ সালের ২৯ মে ঢাকায় জন্ম নিয়েছিলেন গুণী এই অভিনেতা। ছবি: কোলাজ

জন্মদিনে তাঁর কিছু কথা মনে পড়ছে। তাঁর বলা কিছু শব্দ গেঁথে গেছে মনে। মৃত্যু নিয়ে বলেছিলেন তিনি। একটি টিভি চ্যানেলে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মৃত্যু নিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘মৃত্যুর মতো এত স্নিগ্ধ, এত গভীর সুন্দর আর কিছু নেই। কারণ মৃত্যু অনিবার্য। তুমি যখন জন্মেছ, তখন মরতেই হবে। মৃত্যুর বিষয়টি মাথায় থাকলে কেউ পাপ করবে না। যেটা অনিবার্য, তাকে ভালোবাসাটাই শ্রেয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘মৃত্যুকে ভয় পাওয়া মূর্খতা। জ্ঞানীরা মৃত্যুকে ভয় পায় না। মৃত্যুকে আলিঙ্গন করো, গ্রহণ করো, বরণ করে নাও। তাহলে দেখবে জীবন কত সুন্দর।’

হুমায়ুন ফরীদি
প্রথম আলো

তিনি হুমায়ুন ফরিদী, ২০১২ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় তিনি মৃত্যুকে বরণ করে নিয়েছিলেন। কিন্তু দেহান্তর মানেই মানুষের নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া নয়। তাঁর সৃষ্টি ও কর্ম মহাকালকে পরাজিত করে কালোত্তীর্ণ হয়ে রয়েছে। আক্ষরিক অর্থে মৃত্যুকে জয় করার উপায় না থাকলেও এভাবেই মৃত্যুঞ্জয়ী হয়ে ওঠেন কেউ কেউ। আজ তাঁর জন্মদিনে সে কথাই মনে পড়ে যায়। আজ শনিবার সকাল থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে তিনি ভাস্বর হয়ে উঠেছেন অনুরাগীদের স্মরণে। তিনি আছেন প্রিয়জনদের স্মৃতিতে, কথায়, ছবিতে, পুরোনো নাটক আর চলচ্চিত্রে। আজ সেসব শেয়ার করছেন অনুরাগীরা।

হুমায়ুন ফরীদি
প্রথম আলো

জাগতিক ভ্রমণে থাকলে আজ তাঁর বয়স হতো ৬৯। তিনি নেই, সে–ও ৯টি বছর পেরিয়ে গেল। অথচ কী জীবন্ত হুমায়ুন ফরীদি! কত মানুষ আজ তাঁকে স্মরণ করছেন!

কেউ কেউ তাঁকে নিয়ে লিখেছেন, কেউ তাঁর কথাগুলো তুলে ধরেছেন। কেউ একটি ছবি দিয়েই লিখেছেন, শুভ জন্মদিন।

ফেসবুকে একজন ফরীদির লেখা ‘ছায়া’ কবিতাটি শেয়ার করেছেন।

‘এই মাটি, মৃত্তিকার গান হঠাৎ হারিয়ে যায়

নিরাকার সন্ধ্যা বৃক্ষের ফোঁকড়ে বাঁধে বাসা

কুলবতী কালো বউ নদীজলে ধুয়ে ফেরে বাসন-কোসন

হাওয়া কাঁপে হাওয়া, ঘাসের সান্নিধ্যে ঘুমোয়

বিন্দুজলে স্বচ্ছন্দে সংসার সুখ নিচে যত টুনীর পায়ের

একা একা কিশোরীর স্নেহডোবা চোখে ভর করে

দুপুরের নির্জন ভীতি নিসহায় উনুনে পড়ে জল

আমার ঘরের পাশে লম্বিত সুপুরির গাছ

তবুও অপেক্ষা করে পাশে মেঘে মেঘে ভিজে যায় বেলা

এই নদী ভেজে কাক ঘাটে বাঁধা নৌকোর

সুশীল পাটাতন; উচ্ছিষ্ট কচুরীর ফুল।

১৯৮৫ সালে কলকাতায় নান্দীকর আয়োজিত আন্তর্জাতিক নাট্যোৎসবে ঢাকা থিয়েটারের নাটকে দর্শক শ্রদ্ধেয় শম্ভু মিত্র, রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্তের সঙ্গে হুমায়ুন ফরীদিসহ ঢাকা থিয়েটারের কীর্তনখোলা নাটকের শিল্পীরা

একটি পুরোনো ছবি শেয়ার করে গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের মহাসচিব কামাল বায়েজিদ লিখেছেন, ‘আজ বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মঞ্চনাটক অভিনেতা হুমায়ুন ফরীদির শুভ জন্মদিন। নিচের ছবিটি ১৯৮৫ সালে কলকাতায় নান্দীকর আয়োজিত আন্তর্জাতিক নাট্যোৎসবে ঢাকা থিয়েটারের নাটকে দর্শক শ্রদ্ধেয় শম্ভু মিত্র, রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্তের সঙ্গে হুমায়ুন ফরীদিসহ ঢাকা থিয়েটারের কীর্তনখোলা নাটকের কুশীলববৃন্দ।’ ছবিটি মহামূল্যবান।

ঢালিউড তারকা শাকিব খান তাঁর ফেসবুক ওয়ালে নিজের প্রযোজনা সংস্থা এসকে ফিল্মসের একটি লেখা শেয়ার করেছেন। সেখানে লেখা রয়েছে, ‘দেশের ইতিহাসের অন্যতম প্রতিভাবান ও প্রশংসিত অভিনেতাদের একজন ছিলেন হুমায়ুন ফরীদি ভাই। বাঙালির মধ্যবিত্ত সামাজিক জীবনধারাকে পর্দায় আনন্দিত করে তুলতেন তিনি। তাঁর নাটক–সিনেমা মানেই পর্দায় পুরো বাঙালির চোখ আটকে যাওয়া। হতাশ করতেন না, তিনি এত প্রাণবন্ত অভিনয় করতেন; যেন চারপাশের মানুষগুলোই জীবন্ত হয়ে যেত তাঁর অভিনয় দেখে। নাটকের পর ফরীদি ভাই নাম লিখিয়েছিলেন চলচ্চিত্রে। তাঁর উপস্থিতিতে একটু একটু করে বাংলা সিনেমায় ভিলেনের সংজ্ঞাটারও যেন পরিবর্তন হতে থাকে। প্রায় ২৫০টির মতো ছবিতে অভিনয় করেছেন ফরীদি ভাই। টানা তিন দশক ফরীদি ভাই তাঁর ক্যারিশমাটিক ম্যাজিক্যাল অভিনয়ে বুঁদ করে রেখেছিলেন পুরো বাঙালি জাতিকে। আজ হুমায়ুন ফরীদি ভাইয়ের জন্মদিন। ক্ষণজন্মা এই অভিনেতার প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।’

নাটকে ফেরদৌসি মজুমদারের সঙ্গে

অভিনেতা অপূর্ব একটি ভিডিও চিত্র শেয়ার করে লিখেছেন, ‘ফরীদি ভাই, এখনো আপনাকে মিস করি।’

বিরল প্রতিভা নিয়ে অভিনয়ের সব মাধ্যমে দাপট দেখিয়েছেন হুমায়ুন ফরীদি। অনেকেই বলেন, অভিনেতা হিসেবে তিনি যেমন শক্তিমান, মানুষ হিসেবেও ছিলেন অনন্য।
অভিনেতা আনিসুর রহমান মিলন এই প্রয়াত অভিনেতার সঙ্গে তাঁর একটি পুরোনো ছবি শেয়ার করেছেন

অভিনেতা আনিসুর রহমান মিলন এই প্রয়াত অভিনেতার সঙ্গে তাঁর একটি পুরোনো ছবি শেয়ার করে লিখেছেন, ‘ফরীদি ভাই, আমি এখনো এভাবেই হাসি। হুমায়ুন ফরীদি ভাই শুভ জন্মদিন, ভালোবাসা আমৃত্যু।’

চঞ্চল চৌধুরীও একটি ছবি দিয়ে লিখেছেন, ‘আজ ফরীদি ভাইয়ের জন্মদিন। ক্ষণজন্মা এই অভিনেতার প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।’ অভিনেত্রী আশনা হাবিব ভাবনা, ‘জন্মদিনে শ্রদ্ধা চির উজ্জ্বল ভালো শিল্পী’ লিখে হুমায়ুন ফরিদীর একটি মন্তব্য তুলে ধরেছেন, ‘তিন ধরনের শিল্পী আছে পৃথিবীতে। ভালো শিল্পী, বিপদগ্রস্ত শিল্পী আর অশিল্পী। বিপদগ্রস্ত শিল্পী সব সময় মনে করে, এই বুঝি পড়ে গেলাম! এখনকার শিল্পীরা ত্রস্ত, দৌড়াচ্ছে। এই দৌড় বন্ধ করে হেঁটে যাও। টাকার পেছনে না ছুটে ভালো অভিনয় করো। টাকা এমনিই আসবে।’

১৯৫২ সালের ২৯ মে ঢাকায় জন্ম নিয়েছিলেন গুণী এই অভিনেতা। ছবি: সংগৃহীত

ফেসবুকে তারকা, ভক্ত বা সহশিল্পীদের মূল্যায়ন বা শুভেচ্ছাবাণীতে একটি বিষয় স্পষ্ট, হুমায়ুন ফরীদির মতো দারুণ সাহিত্যজ্ঞান নিয়ে মঞ্চ, ছোট পর্দা, বড় পর্দায় সমান তালে দাপট দেখানোর মতো অভিনেতা বাংলাদেশে হাতে গোনা। এমন বিরল প্রতিভা নিয়ে অভিনয়ের সব মাধ্যমে দাপট দেখিয়েছেন হুমায়ুন ফরীদি। এ কথা অনেকেই বলেন, অভিনেতা হিসেবে তিনি যেমন শক্তিমান, মানুষ হিসেবেও ছিলেন অনন্য।

ভাঙনের শব্দ শুনি নাটকের দৃশ্যে বাবুল আহমেদের সঙ্গে

হুমায়ুন ফরীদির জন্মদিন আজ, ১৯৫২ সালের ২৯ মে ঢাকায়। দুই ভাই ও দুই বোনের মধ্যে হুমায়ুন ফরীদি ছিলেন দ্বিতীয়। ১৯৭০ সালে স্নাতক শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জৈব রসায়ন বিভাগে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে স্থগিত হয়ে যায় তাঁর পড়াশোনা। স্বাধীনতার পর অর্থনীতি বিষয়ে ভর্তি হন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। মেধার স্বাক্ষর রাখেন প্রাতিষ্ঠানিক ফলাফলে।

নাটক, চলচ্চিত্র কিংবা মঞ্চ—সবখানেই ছিল হুমায়ুন ফরীদির অবাধ বিচরণ। মঞ্চ দিয়েই শুরু তাঁর পথচলা। প্রথম মঞ্চনাটক কিশোরগঞ্জে মহল্লার নাটকে ১৯৬৪ সালে। প্রথম মঞ্চনাটক নির্দেশনা দেন স্কুলজীবনে—‘ভূত’।

১৯৭৬ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম নাট্যোৎসব আয়োজনের অন্যতম সংগঠক ছিলেন তিনি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার দিনগুলোতেই ফরীদি সম্পৃক্ত হন ঢাকা থিয়েটারের সঙ্গে। বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটারের সদস্য হিসেবেও অভিনয়ের আলো ছড়িয়ে বেড়ান সারা দেশে। যদিও এর আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তনাট্য প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে। এখানে তিনি ‘আত্মস্থ ও হিরণ্ময়ীদের বৃত্তান্ত’ নামে একটি নাটক লেখেন, নির্দেশনা দেন এবং অভিনয় করেন। এই নাটক পাঁচটি নাটকের মধ্যে সেরা নির্বাচিত হয় বিচারকদের কাছে। এ নাটকের সুবাদে পরিচয় ঘটে ঢাকা থিয়েটারের নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চুর সঙ্গে। মূলত এখান থেকেই হুমায়ুন ফরীদির অভিনয়যাত্রা। ঢাকা থিয়েটারের মধ্য দিয়ে হুমায়ুন ফরীদির মঞ্চযাত্রা শুরু হয়।

এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘চা আনা আর কস্টিউম পরিয়ে দেওয়া পর্যন্ত আমার গণ্ডি। আর সেলিম আল দীনের “চরকাঁকড়ার ডকুমেন্টারি” নাটকের প্রোডাকশনে কাজ করি। এরপর একই দলের একই লেখক ও নির্দেশকের “সংবাদ কার্টুন”-এ ছোট্ট একটি চরিত্রে সুযোগ পাই। তারপর “শকুন্তলা”।’

তাঁকে স্মরণ করে এক স্মৃতিচারণায় নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার বলেছিলেন, ‘হুমায়ুন ফরীদি যখন প্রথম মঞ্চনাটকে অভিনয় শুরু করল, তখনই আমি সবাইকে বলেছিলাম, এই ছেলে মঞ্চ কাঁপাবে। অবশ্য ফরীদি কিন্তু মঞ্চের চেয়েও তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল চলচ্চিত্রে। তাঁর রসবোধ ছিল প্রখর। কোনো একটা সিরিয়াস মুহূর্তকে তাৎক্ষণিকভাবে প্রাণচাঞ্চল্যে ভরিয়ে দিতে তার তুলনা ছিল না।’

মঞ্চ কাঁপিয়েছিলেন ফরীদি। শকুন্তলার পর ‘ফণীমনসা’, ‘কীর্তনখোলা’, ‘কেরামতমঙ্গল’, ‘মুনতাসীর ফ্যান্টাসি’ এবং ১৯৯০ সালে ‘ভূত’ দিয়ে শেষ হয় হুমায়ুন ফরীদির ঢাকা থিয়েটার জীবন। মূলত বন্ধু-অভিনেতা আফজাল হোসেনের সাহস ও উৎসাহে হুমায়ুন ফরীদির টেলিভিশনযাত্রা শুরু হয়। আফজাল হোসেন বন্ধুর কথা ভেবে অনেকগুলো নাটক লেখেন। ১৯৮০ সালে ‘নিখোঁজ সংবাদ’-এর মাধ্যমে টেলিভিশন নাটকে অভিষেক হয় হুমায়ুন ফরীদির। ১৯৮২ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত ‘নীল নকশার সন্ধ্যায়’ ও ‘দূরবীন দিয়ে দেখুন’ নাটকে অভিনয় করে তিনি তাক লাগিয়ে দেন।

নাটকের দৃশ্যে হুমায়ুন ফরীদি ও সুবর্ণা মুস্তাফা

যদিও টেলিভিশনে অভিষেকটা ঘটে আতিকুল হক চৌধুরীর মাধ্যমে। সেটাও অবশ্য আফজাল হোসেন ও রাইসুল ইসলাম আসাদের সুবাদে। সেলিম আল দীনের রচনা এবং নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চুর নির্দেশনায় ধারাবাহিক নাটক ‘ভাঙনের শব্দ শুনি’ দিয়ে আলোচনায় আসেন ফরীদি। এখানে তাঁর চরিত্রের নাম ছিল সেরাজ তালুকদার। একসময় বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত বিখ্যাত ‘সংশপ্তক’ নাটকে ‘কানকাটা রমজান’ চরিত্রে অভিনয় করে সাড়া ফেলেছিলেন তিনি।

ফরীদি অভিনীত অন্যান্য উল্লেখযোগ্য টিভি নাটকের মধ্যে রয়েছে ‘ভাঙনের শব্দ শুনি’, ‘বকুলপুর কতদূর’, ‘মহুয়ার মন’, ‘সাত আসমানের সিঁড়ি’, ‘একদিন হঠাৎ’, ‘চানমিয়ার নেগেটিভ পজিটিভ’, ‘অযাত্রা’, ‘পাথর সময়’, ‘দুই ভাই’, ‘শীতের পাখি’, ‘সংশপ্তক’, ‘কোথাও কেউ নেই’, ‘সমুদ্রে গাঙচিল’, তিনি একজন’, ‘চন্দ্রগ্রস্ত’, ‘কাছের মানুষ’, ‘মোহনা’, ‘বিষকাঁটা’, ‘ভবের হাট’ ও ‘শৃঙ্খল’। তাঁর অন্য নাটকগুলোর মধ্যে আছে, ‘দুই ভুবনের দুই বাসিন্দা’, ‘একটি লাল শাড়ি’, ‘প্রিয়জন নিবাস’। সর্বশেষ তিনি ‘তখন হেমন্ত’ নামের একটি ধারাবাহিক নাটক পরিচালনা করেন এবং ‘পূর্ণ চাঁদের অপূর্ণতায়’ নামের একটি নাটকে অভিনয় করেন।

হুমায়ুন ফরীদি তাঁর কয়েক দশকের কর্মময় জীবনে অসংখ্য বৈচিত্র্যময় চরিত্রে অভিনয় করেছেন। ছবি: সংগৃহীত

হুমায়ুন ফরীদির অভিনয়প্রতিভা মূল্যায়ন করতে গিয়ে প্রয়াত নাট্যজন আতিকুল হক চৌধুরী বলেছিলেন, ‘হুমায়ুন ফরীদির মতো শিল্পী যেকোনো দেশে জন্মাতে যুগ যুগ সময় লাগে, লাগে শতাধিক বছর। সে একজন ভার্সেটাইল শিল্পী। তাঁকে জিনিয়াসই বলা যায়।’

ভার্সেটাইল শিল্পী ফরীদির নাট্যাভিনয় থেকে চলচ্চিত্রে আসা ছিল অনেক নাটকীয়। দেশীয় চলচ্চিত্রের তখনকার বেহাল অবস্থা দেখে রুপালি পর্দার জন্য কাজ করবেন কি না, এ বিষয়ে দ্বিধায় ছিলেন তিনি। শেষ পর্যন্ত কাছের মানুষদের অনুপ্রেরণায়, নিজের দৃঢ়তায় এক নতুন আঙ্গিক নিয়ে বড় পর্দায় আসেন ফরীদি। তানভীর মোকাম্মেলের ‘হুলিয়া’ তাঁর অভিনীত প্রথম ছবি। নব্বই দশকে বাণিজ্যিক ছবির পরিচালক শহীদুল ইসলাম খোকনের ‘সন্ত্রাস’, ‘দিনমজুর’, ‘বীরপুরুষ’ ও ‘লড়াকু’ ছবিতে খলচরিত্রে অভিনয় করেন। এরপরই দেশীয় চলচ্চিত্রে খলনায়কের চরিত্র পায় এক অন্য মাত্রা। অবস্থা এমনই দাঁড়িয়েছিল যে একসময় মানুষ নায়কের পরিবর্তে তাঁকে দেখার জন্যই প্রেক্ষাগৃহে যেত। শহীদুল ইসলাম খোকন ‘বিশ্বপ্রেমিক’, ‘অপহরণ’, ‘দুঃসাহস’সহ ২৮টি ছবির মধ্যে ২৫টিতেই রাখেন ফরীদিকে।

তাঁর অভিনীত ছবির তালিকায় আরও আছে ‘দহন’, ‘একাত্তরের যীশু’, ‘দূরত্ব’, ‘ব্যাচেলর’, ‘জয়যাত্রা’, ‘শ্যামল ছায়া’, ‘মায়ের অধিকার’, ‘অধিকার চাই’, ‘ত্যাগ’, ‘মায়ের মর্যাদা’, ‘মাতৃত্ব’ ও ‘আহা!’। এসব ছবিতে অভিনয় করে এ দেশের চলচ্চিত্রাঙ্গনে এক উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনেন তিনি। ২০০৪ সালে ‘মাতৃত্ব’ ছবির জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান ফরীদি। ২০১৮ সালে পেয়েছেন মরণোত্তর একুশে পদক।

হুমায়ুন ফরীদির ব্যক্তিজীবনের পুরোটাই ছিল সাদামাটা

ফরীদি যেমন ছিলেন বুদ্ধিদীপ্ত, তেমনি কাছের মানুষদের বর্ণনায় তিনি রোমান্টিকও। এ মানুষটি ব্যক্তিগত জীবনে প্রথমে বেলি ফুলের মালা দিয়ে ফরিদপুরের মেয়ে মিনুকে বিয়ে করেন। তখন এ বিয়ে সারা দেশে ব্যাপক আলোড়ন তোলে। এ সংসারে তাঁদের একটি কন্যাসন্তান রয়েছে। পরে তিনি ঘর বাঁধেন প্রখ্যাত অভিনেত্রী সুবর্ণা মুস্তাফার সঙ্গে। কিন্তু ২০০৮ সালে তাঁদের বিচ্ছেদ হয়ে যায়। তবে ব্যক্তিজীবন ছাপিয়ে হুমায়ুন ফরীদি সবার প্রিয় অভিনেতা হিসেবে এখনো আবিষ্ট করে রেখেছেন অগুনতি দর্শক-সমালোচককে। পরিচিতজন ও ভক্তদের মতে, হুমায়ুন ফরীদির মৃত্যুর মধ্য দিয়ে অন্য রকম শিল্পচর্চার একটা যুগের অবসান হয়েছে। তাঁর দুর্দান্ত অভিনয়ে মুগ্ধ ও বিস্মিত হননি, এমন মানুষ খুব একটা পাওয়া যাবে না। শুধু একবার তাঁর অভিনয় দেখার জন্যই টিভির সামনে বসেছেন কত শত মানুষ। আজ যেমন শত শত মানুষ তাঁকে স্মরণ করছেন। মানুষের মধ্যে আজ ২৯ মে তিনি ফিরে এসেছেন। আসবেন বছরের পর বছর।