জ্বর, ঠান্ডা, হাঁচি–কাশি নিয়ে শুটিং করছেন কেউ কেউ

ছোট পর্দার অনেক অভিনয়শিল্পী ও কলাকুশলী জ্বর, ঠান্ডা, হাঁচি-কাশি নিয়ে শুটিং করছেন
ছবি: সংগৃহীত

ছোট পর্দার অনেক অভিনয়শিল্পী ও কলাকুশলী জ্বর, ঠান্ডা, হাঁচি-কাশি নিয়ে শুটিং করছেন। তাঁদের কারও কারও পরিবারের সদস্য আবার করোনায় আক্রান্ত। অন্যদের ছিল নানা অজুহাত। কেউ বলছেন, এসব কিছু নয়, ঋতু পরিবর্তনজনিত ঠান্ডার সমস্যা। কেউ বলছেন, আইসক্রিম, ঠান্ডা পানি খাওয়া ও শুটিং থেকে ফিরে রাতে গোসলের কারণে অসুস্থ। কেউ অসুস্থতার কথা নির্মাতাকে জানিয়ে লুকিয়ে শুটিং করছেন। এদিকে প্রায় শতভাগ শুটিং বাড়ি ও ইউনিটে নেই স্বাস্থ্য পরীক্ষার ব্যবস্থা। এগুলো দেখভাল করার জন্য নেই তদারকি।

গত ২৩ মার্চ থেকে শারীরিক দুর্বলতা ও কাশি অনুভব করছিলেন অভিনেতা শফিক খান দিলু। বাড়িতেই বিশ্রামে ছিলেন তিনি। এর মধ্যেই ৩১ মার্চ ‘বিবাহবিচ্ছেদ’ ধারাবাহিক নাটকের শুটিংয়ের যেতে হয় তাঁকে। ইউনিটের বেশ কিছু অভিনয়শিল্পী বুঝতে পারেন, তিনি অসুস্থ। এই অভিনেতা তাঁদের জানিয়েছিলেন, ঋতু পরিবর্তনের জন্য এমনটা হয়েছে। পরে তিনি নিজেই নাটকের নির্মাতা রওনক হাসানকে অসুস্থতার কথা জানান। রওনক আলাদা একটি ঘরে তাঁর থাকার ব্যবস্থা করেন। সন্ধ্যা পর্যন্ত শুটিং করতে হয় তাঁকে। পরের দিন দিলু নমুনা পরীক্ষা করে জানতে পারেন, তাঁরা সপরিবার কোভিড-১৯ পজিটিভ। এই অভিনেতা বলেন, ‘আগে থেকেই শরীর খারাপ ছিল। নাটকের কিছু দৃশ্যে আমাকে দরকার ছিল। সে জন্য বাধ্য হয়েই শুটিংয়ে যেতে হয়েছিল। আমি আলাদা থেকে দূরত্ব বজায় রেখে দৃশ্য ধারণে অংশ নিয়েছি। করোনায় আক্রান্ত জানার পর ঘর থেকে বের হইনি।’

অভিনেতা শফিক খান দিলু
ছবি: সংগৃহীত

শামীম ভিস্তি নামের এক অভিনেতা ফেসবুকে লিখেছেন, ‘অনলাইন পত্রিকার মাধ্যমে জানলাম, আপনি ও ভাবি দুজনে ২ এপ্রিল করোনা পরীক্ষা করিয়েছেন এবং আপনাদের রিপোর্ট পজিটিভ এসেছে। আপনারা এখন হোম কোয়ারেন্টিনে থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন। ৩ এপ্রিল শুটিংয়ে এসে আপনি বললেন যে শুধু ভাবির পজিটিভ এসেছে এবং আপনার নেগেটিভ। তাহলে সেদিন কি আপনি সঠিক তথ্যটি সবার কাছে লুকিয়েছিলেন?’

শামীম ভিস্তির স্ট্যাটাস
ছবি: সংগৃহীত

এই পোস্টদাতা শামীম সেদিন অভিনয় করেন শহীদুজ্জামান সেলিমের সঙ্গে ঈদ ধারাবাহিক ‘রূপকথা’ নাটকে। সেদিনের শুটিং প্রসঙ্গে নাটকটির নির্মাতা তারিক মোহম্মদ বলেন, ‘সেলিম ভাই (শহীদুজ্জামান সেলিম) শুটিংয়ে এসে বলেছিলেন, তোর ভাবির (রোজী সিদ্দিকী) একটু জ্বর। তাঁর করোনার কোনো লক্ষণ ছিল না। তিনি নিজে থেকেই অন্যদের দূরত্ব বজায় রাখতে বলেছিলেন। আমরা সচেতন হয়েই শুটিং করেছিলাম। পরে জানতে পারি, তাঁরা করোনায় আক্রান্ত। আমাদের পরবর্তী শুটিং বাতিল করে ইউনিটের সবাই ১০ দিন, কেউ ১৪ দিন পর্যন্ত হোম কোয়ারেন্টিনে ছিলাম।’

শুটিংয়ের লাইট-ক্যামেরা সহকারী, প্রোডাকশন বয়সহ অনেকেই তথ্য গোপন করে শুটিং করেন। অনেকে নিয়ম মেনেও শুটিং করেন।
ছবি: সংগৃহীত

গত বছর লকডাউনের পর শুটিং শুরু হলে যথাযথ নিয়ম না মানায় অনেক অভিনয়শিল্পী করোনায় আক্রান্ত হন। গত বছরের জুলাইয়ে মিজানুর রহমান আরিয়ানের সেটে করোনা হানা দিলে নির্মাতা, শিল্পীরা হোম কোয়ারেন্টিনে চলে যান। সেই সময় বেশির ভাগ কলাকুশলী তথ্য গোপন করে শুটিং করেছেন। আরিয়ানের ইউনিটের একজন প্রোডাকশন বয় শারীরিক অসুস্থতার কথা গোপন করে ‘বাকের খনি’ ধারাবাহিকের শুটিংয়ে অংশ নিয়েছিলেন। ঘটনাটি জানিয়ে নাটকের নির্মাতা মাতিয়া বানু শুকু প্রথম আলোকে বলেছিলেন, সেই প্রোডাকশন বয়কে তাঁরা পারিশ্রমিক দিয়ে বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছেন।
শারীরিক অসুস্থতার তথ্য লুকিয়ে শুটিংয়ে অংশ নেওয়ার ঘটনা এখনো ঘটছে বলে জানান অভিনেতা ফজলুর রহমান বাবু। তিনি জানান, গত ২৯ মার্চ শুটিংয়ের জন্য মেকআপ নিচ্ছিলেন তিনি। এমন সময় সেই মেকআপম্যান জানান, তাঁর করোনা হয়েছিল। বাবু জানতে চান, কত দিন বাসায় ছিলেন? অবাক করে দিয়ে সেই মেকআপম্যান জানান, নির্মাতা কাউকে কিছু না বলে তাঁকে শুটিং করতে বলেছিলেন। বাবু প্রথম আলোকে বলেন, ‘তাদের নাম বলছি না। সেই মেকআপম্যানের বয়স ২৫ বছর। তার কারণে কতগুলো মানুষের করোনা হতে পারে! ধরলাম, তার শুটিং বাতিল করার ক্ষমতা নেই। কিন্তু একজন নির্মাতা জ্ঞানী, শিক্ষিত মানুষ! তিনি মূর্খের মতো কাণ্ডজ্ঞানহীনতার পরিচয় কীভাবে দিলেন। সবার পরিবারে বয়স্ক, অসুস্থ মানুষ আছেন। তাঁদের কথা ভাবলেন না। নাট্য অঙ্গনে কিছু মানুষ শুধু টাকা আয় করার প্রতিযোগিতা করছেন। তাঁদের কোনো নৈতিকতা নেই, অন্য মানুষের প্রতি কোনো সহমর্মিতা নেই।’

গত বছর ‘খলিলের বাড়ি’ শুটিং হাউসে থার্মাল স্ক্যানার রাখা হলেও এখন সেটা নেই। তবে কিছু ইউনিট ব্যক্তিগত উদ্যোগে এসব রাখছে
ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা ও পুবাইলের শুটিং বাড়িগুলোতে খবর নিয়ে জানা যায়, সেসব হাউসে নেই তাপমাত্রা মাপার মেশিন। গত বছর ‘খলিলের বাড়ি’ শুটিং হাউসে থার্মাল স্ক্যানার রাখা হলেও এখন সেটা নেই। তবে কিছু ইউনিট ব্যক্তিগত উদ্যোগে এসব রাখছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে আছে কেবল মাস্ক ও স্যানিটাইজার। শিল্পী, কলাকুশলীদের শারীরিক অসুস্থতাকে সেভাবে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না বেশির ভাগ জায়গায়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন অভিনয়শিল্পী বলেন, ‘অসুস্থ থাকার পরও অনেকে শুটিং করছেন। সাধারণ সমস্যা বলে চালিয়ে দিচ্ছেন। এতে অন্যরা ঝুঁকিতে পড়ছেন।’

স্বাস্থ্যবিধি মানছে কি না, দেখভাল করার জন্য নাটকের আন্তসংগঠনের চারজনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তাঁদের একজন সাজ্জাদ হোসেন বলেন, ‘আমরা স্পষ্ট বলে দিয়েছি, অসুস্থতা নিয়ে শুটিং করা যাবে না। কেউ সামান্য অসুস্থ থাকলে, সেটা ইউনিট আমাদের জানাবে। আমরা তার চিকিৎসার ব্যবস্থা নেব। কেউ তথ্য গোপন করে শুটিং করলে আমাদের কিছু করার থাকে না। শিগগিরই আমরা প্রতিটি হাউসে তাপমাত্রা পরিমাপের মেশিন দিতে সংগঠন থেকে বাধ্য করব।’