তারিক আনাম পরিবারের ঈদ আড্ডা

তারকা পরিবার (বাঁ থেকে) নিমা রহমান, তারিক আনাম খান, র‍্যাচেল প্রিয়াংকা ও আরিক আনাম খান ।ছবি: খালেদ সরকার
তারকা পরিবার (বাঁ থেকে) নিমা রহমান, তারিক আনাম খান, র‍্যাচেল প্রিয়াংকা ও আরিক আনাম খান ।ছবি: খালেদ সরকার

তারিক আনাম খান। ছোটবেলা কেটেছে সাতক্ষীরার হোসেনপুর গ্রামে। বাবা ছিলেন সাধারণ চাকুরে। অনেক ভাইবোনের সংসারে বাবার আয়ের টাকায় খুব একটা সাচ্ছন্দ্য না থাকলেও ঈদের আনন্দে কোনো কমতি ছিল না। বাবা ঈদে নতুন জামাকাপড় দিতে পারবেন কি পারবেন না, তার কোনো নিশ্চয়তা না থাকলেও কোথাও কোনো আক্ষেপ ছিল না। মা-বাবা, ভাইবোন, বন্ধুবান্ধব, পাড়া–প্রতিবেশীদের ভালোবাসা, হইচই করে হৃদয়-উৎসারিত যে আনন্দ পেতেন, বরং তা হারানোর জন্যই আজকের বৈভবের দিনে আক্ষেপ হয়। আহা! যদি ফিরে পাওয়া যেত অপার আনন্দের সেই দিনগুলো! জীবনে সেরা হয়ে থাকা সেসব ঈদ আনন্দ নিয়েই আড্ডা জমে পুরো আনাম পরিবারের চার সদস্যের।

কেমন ছিল ছোটবেলার ঈদ? ছোটবেলার ঈদের স্মৃতিতে ফেরা তারিক আনাম খান মন্ত্রমুগ্ধের মতো বলে যেতে থাকেন ঘটনার পর ঘটনা—ছোটবেলাতেই মানুষ তার সবচেয়ে সেরা ঈদটা পার করে আসে। আমার বিশ্বাস, গরিবেরাই ঈদে বেশি আনন্দ করে থাকে। কেননা তাদের সারা বছর খুব অভাব–অনটনের ভেতর দিয়ে যেতে হয়, ফলে ঈদের সময় ছোটখাটো প্রাপ্তি তাদের পরম আনন্দ দেয়। আমি নিজেও খুব মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান ছিলাম। অনেক ভাইবোন। আমাদের লেখাপড়া শিখে লড়াই করেই বড় হতে হবে—আমরা জানতাম। আর সেই লক্ষ্য নিয়েই আমাদের বেড়ে ওঠা। ফলে ঈদের সামান্য উপহারও আমাদের খুব আনন্দ দিত। ঈদের দিনের জন্য সারা বছর অপেক্ষায় থাকতাম। অপেক্ষায় থাকতাম বাবার দেওয়া উপহারের। মনে আশঙ্কা থাকত, এবারে বাবা কি আমাদের কিছু দিতে পারবেন! দিলে কী দেবেন? প্যান্ট, শার্ট নাকি পাঞ্জাবি-পায়জামা? বাবা কিছু দিলে খুশিতে আটখানা হয়ে যেতাম, না দিলেও খুব মন খারাপ হতো তা নয়। আমরা ভাইবোনেরা সবাই বুঝতাম আমাদের বাবার সামর্থ্য।

নিমা রহমান ও র‍্যাচেল প্রিয়াংকা।ছবি: খালেদ সরকার
নিমা রহমান ও র‍্যাচেল প্রিয়াংকা।ছবি: খালেদ সরকার

আমাদের মূল আনন্দ ছিল ঈদের ছুটির সময়টা তখন আমরা বন্ধুদের সঙ্গে ঘোরাফেরা খেলাধুলা করতে পারতাম। সেটা ছিল নির্মল আনন্দের। সেই সঙ্গে বছরের একটা দিন সেমাই খাওয়ার আনন্দও ছিল অপরিসীম। বলে যান তারিক আনাম খান।

নিজেই বাড়ির ঈদের বাজার করতেন এই নাট্যজন। বললেন, ‘ঘুরে ঘুরে খুঁজে খুঁজে ভালো ঘি, সেমাই কিনতাম। শুকনো ফল আমি খুব পছন্দ করতাম আর তাই কিশমিশ কিনতামই কিনতাম। ঈদের আগের রাতে মায়ের সঙ্গে সেসব রান্নাবান্না করতাম। মায়ের সঙ্গে কাজ করতে আমার খুব ভালো লাগত, ভালো লাগত বাবার সঙ্গে ঈদের নামাজ পড়তে যেতে। সেসব আনন্দ পৃথিবীর কোনো দামি বস্তুর বিনিময়েও কেনা যাবে না। অভাবী সময়ের ঈদ বোধহয় সবারই এমন আনন্দ–উৎফুল্লতায় কাটে। এখন হয়তো সেই অভাব নেই, তবুও সেই সময়ের আনন্দ আর আমাকে ছোঁয় না।’

ঈদের দিনগুলোতে বাবা–মায়ের কথা খুব মনে পড়ে তারিক আনামের। ভাইদের মধ্যে তিনি বড়। তাঁর বড় তিন বোন।

স্মৃতি মেলে ধরেন তারিক আনাম খান—আমাদের বাড়িতে ঈদের রান্নাবান্না হতো ফজরের নামাজের পরে। সে সময়ের আমার একটা স্মৃতি বেশ মনে পড়ে। তৎকালীন পাকিস্তান রেডিওতে একটা অনুষ্ঠান হতো, আমরা ফুল ভলিউমে শুনতাম। কখনো গান হতো, কখনোবা কথোপকথন। তো আমরা সবাই শুনতাম আর রান্নাঘরে চলত মায়ের রান্না। সে সময় দুধ এত সহজলভ্য ছিল না। এ কারণে ঈদের দু–চার দিন আগেই দুধ কিনে জ্বাল দিয়ে রাখা হতো। কখনো কখনো সেই দুধ ফেটে ছানা হয়ে গেলে আবার দুধ কোথায় পাওয়া যাবে তা নিয়ে ছিল মহা দুশ্চিন্তা। এই রকম দুশ্চিন্তাগুলোও ঈদের আনন্দকে বড় করে তুলত।

তারকা দম্পতি তারিক আনাম খান, নিমা রহমান।ছবি: খালেদ সরকার
তারকা দম্পতি তারিক আনাম খান, নিমা রহমান।ছবি: খালেদ সরকার

হোসেনপুর গ্রাম থেকে যখন শহরে এলেন তারিক আনাম খানরা, তখনো কখনো কখনো গ্রামে যেতেন নামাজ পড়তে। ‘ছনি নামের একজন রিকশাওয়ালা ছিল, সে আসত গ্রাম থেকে। সে এলে তার রিকশায় চেপে কখনো নামাজ পড়ে আবার কখনো না পড়েই বাবা, ভাই আমি রওনা হয়ে যেতাম গ্রামে। গ্রামের প্রতিটি ঘরে ঘরে যেতাম দেখা করতে আর সবাই জোর করে সেমাই বা মিষ্টিজাতীয় খাবার খেতে দিত। না গেলে কিংবা না খেলে ওই সব সাধারণ মানুষ অভিমান করত। আমাদের এত খাওয়া হতো যে দিন শেষে হিসাব করতাম কটা বাড়িতে আমরা কী কী খেয়েছি। ওটা তখন গর্বের বিষয় হয়ে দাঁড়াত আমাদের। মিষ্টি খেতে খেতে এমন হতো কারও কারও বাড়ি গিয়ে বলতাম ঝাল কিছু থাকলে দিন।’

১৯৭১ সালের ঈদটা তারিক আনাম খানের জীবনের একটা বিশেষ ঈদ হিসেবে যুক্ত হয়ে আছে। সেবার রোজার ঈদ ছিল পাকিস্তানি শাসনামলে আর কোরবানির ঈদ হয়েছিল স্বাধীন বাংলায়। মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন তারিক আনাম খান। ‘আমার তখন ১৭ বছর বয়স। এরপর হঠাৎ করেই নিজেকে বড় হয়ে যাওয়া মানুষ মনে হতো। মনে হতো, ঈদ আনন্দ আর আমাকে মানায় না। এই বড়বেলার ঈদ বলতে ঢাকা থেকে বাড়ি যাওয়া। আমার মেজ দুলাভাই মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। বোন আর তাঁর দুই সন্তানের সঙ্গে থাকতে আমার ঢাকায় আসা। সে সময় ঈদ এলেই আমি, আমার বোন আর তাঁর দুই বাচ্চা রওনা হতাম বাড়ির উদ্দেশে। সে যাত্রা ছিল বড় যন্ত্রণাদায়ক। অনেকগুলো ফেরি পার হয়ে দিন পেরিয়ে যখন বাড়ি পৌঁছাতাম, আর বাবা–মাকে দেখতাম, প্রবল আনন্দ হতো। স্বল্প সামর্থ্যে বাবা–মায়ের জন্য কিছু কিনে নিয়ে যেতাম।

নিমার সামনে বলা যায় (স্ত্রী নিমা রহমানের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসি দিয়ে), একবার ঈদে দিল্লিতে গার্ল ফ্রেন্ডের সঙ্গে এক মাঠে ঘাসের ওপর বসে আমি। সেদিন সেমাই খাওয়া হয়নি, কিন্তু বান্ধবী হঠাৎ মজা করে মুখের ভেতর ঘাস ঢুকিয়ে দিয়েছিল। খুব রেগে গিয়েছিলাম।

বিয়ের পরে ঈদ কিছুটা বদলে গিয়েছিল। বিয়ের পর প্রথম ঈদে তারিক আনাম খান স্ত্রী নিমা রহমানকে কটকী শাড়ি উপহার দিয়েছিলেন। আর নিমা রহমান তাঁকে পায়জামা পাঞ্জাবি দিয়েছিলেন। এই দুই দম্পতির সেরা ঈদ ছিল তাঁদের সন্তানের সঙ্গে উদ্‌যাপন করা প্রথম ঈদ।

এখানে তাঁদের পুত্র অভিনেতা আরিক আনাম খান যোগ করেন—‘বাবা–মা আর আমার সেরা ঈদগুলো কেটেছে দুইবার দুই দেশে—শ্রীলঙ্কায় আর মালয়েশিয়াতে।’

নিমা রহমানের বয়ানে জানা গেল, আরিক আনামের মিষ্টিজাতীয় খাবার খুব প্রিয়। ঈদের সকাল শুরু হয় পরোটা আর কোরমা দিয়ে, সঙ্গে শামি কাবাব আর রকমারি সেমাই।

একমাত্র পুত্রবধূ (মাঝে) র‍্যাচেল প্রিয়াংকার সঙ্গে নিমা রহমান ও তারিক আনাম খান।ছবি: খালেদ সরকার
একমাত্র পুত্রবধূ (মাঝে) র‍্যাচেল প্রিয়াংকার সঙ্গে নিমা রহমান ও তারিক আনাম খান।ছবি: খালেদ সরকার

নিমা রহমানের ঈদ কেমন কাটত? ছোটবেলার ঈদের দিনে ফিরে গিয়ে নিমা বলতে থাকেন, ‘আমার ছোটবেলার ঈদ কেটেছে তারিকের সম্পূর্ণ বিপরীত আবহে। প্রচুর বৈভব আর আড়ম্বরের ভেতর দিয়ে। ঈদের জামাকাপড় আসত লন্ডন থেকে।’ নিমার বাবা ছিলেন ব্যবসায়ী। প্রায়ই ঢাকা-লন্ডন করত হতো তাঁকে। এ জন্য ঈদের কেনাকাটা ওখান থেকেই করে আনতেন বাবা। কোনো কোনো ঈদে দেশের বাইরেও বেড়াতে যেতেন।

কেমন পোশাক এবং রং তাঁর পছন্দ ছিল? না, তেমন কোনো পছন্দ অপছন্দ ছিল না, তবে এখন বেশি পছন্দ শাড়ি আর রঙের বেলায় কালো, সবুজ আর নীল। আরিক আনাম যোগ করেন, মায়ের কমলা রং খুব পছন্দ (এখানে মা ছেলে আর বৌমার ছোট্ট খুনসুটি) সঙ্গে সঙ্গে নিমা রহমান না না বলে ওঠেন। একমুখ হাসি নিয়ে বলেন, ছেলে আর পুত্রবধূর ঘরের দেয়ালের কমলা রং তাঁর পছন্দ। (একযোগে সবার হাসি)।

নিমা রহমান কথায় কথায় জানিয়ে দিলেন, এবারের ঈদ আমাদের জন্য বিশেষ ঈদ। দুই বছর পর পুত্র আরিক আনাম খান তাঁদের সঙ্গে ঈদ করবেন এবং বাড়তি আনন্দ–উচ্ছ্বাস হিসেবে যোগ হবে একমাত্র পুত্রবধূ এগনেস র‌্যাচেল প্যারিস প্রিয়াংকার উপস্থিতি।

আরিক আনাম তাঁর ঈদের স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে বলেন, শুধু ঈদ নয়, আমার কাছে প্রতিটি উৎসব আয়োজনই ছিল ভীষণ আনন্দের। তবে দেশের বাইরে কাটানো ঈদগুলো বেশ মনে পড়ে। চাঁদরাতের শেষ সময়ে বাবার সঙ্গে বাজার করতে যাওয়াটা ছিল আমার কাছে বেশ উপভোগের। বিয়ের পর প্রথম ঈদ স্ত্রী বাবা–মা একসঙ্গে ঢাকায় কাটাবেন, এটাও হবে আরিক আনামের বিশেষ ঈদ।

আরিক আনাম খান ও র‍্যাচেল প্রিয়াংকা।ছবি: খালেদ সরকার
আরিক আনাম খান ও র‍্যাচেল প্রিয়াংকা।ছবি: খালেদ সরকার

আড্ডায় আড্ডায় উঠে আসে আনাম পরিবারের পুত্রবধূ প্রিয়াংকার ছোটবেলায় পাড়ায় পাড়ায় কাটানো ঈদের গল্প। কাফরুলে ক্যান্টনমেন্ট এরিয়াতে থাকতেন। নিজেদের বিল্ডিংয়ের ওপরে–নিচে যারা থাকতেন, তারা দাওয়াত দিতেন। এবাড়ি–ওবাড়ি থেকে সবাই সেমাই–সুজি পাঠাতেন। তবুও এবাসা–ওবাসা থেকে কখন খাবার পাঠাবে, এ নিয়ে অপেক্ষায় কাটত সময়, আর কখন সেজেগুজে দল বেঁধে দাওয়াত খেতে যাবেন, তা নিয়েও ছিল বেশ উৎকণ্ঠা। কোরবানির ঈদে বন্ধুরা সবাই মিলে বাড়ি বাড়ি ঘুরে গরু দেখতে যেতেন। ঈদে মা তাঁকে একটি করে নতুন জামা কিনে দিতেন।

এমনি গল্পকথায় প্রিয়াংকার মনে তখন ছোটবেলায় দাদার সঙ্গে রাজশাহীতে ঈদ কাটানোর স্মৃতির উঁকি। সেখানে কলোনিতে ঈদের আগের রাতে আতশবাজি, ফুলঝুরি, ফানুস উড়িয়েছিলেন। বড়বেলায় এসে এই স্মৃতি বেশ আনন্দ দিচ্ছে।

বিয়ের পর নতুন জীবনে, নতুন সংসারে প্রথম ঈদে কী করবেন, তেমন কোনো পরিকল্পনা না থাকলেও ডেজার্ট বানাবেন প্রিয়াংকা। আড্ডাতেই শ্বশুর তারিক আনাম খান জানিয়ে দিলেন, ঈদের দিন বৌমার হাতের বানানো ফ্রুটস কেক খাবার আবদার। এ সময় শাশুড়ি নিমা রহমান বলে ওঠেন, না না, বৌমা এবারে কোনো কিছু রাঁধবে না। নতুন বউ, শাশুড়ি মায়ের রান্না খাবে। কিন্তু প্রিয়াংকা বেশ আহ্লাদী গলায় জানিয়ে দেন, না মা, আমি বাবার জন্য কেক বানাব। একপ্রস্থ হাসি দিয়ে দাবি মঞ্জুর করে দেন নিমা রহমান।

ঈদের দিনে কেমন পোশাক পরবেন, কেমন সাজবেন? এই প্রশ্নে প্রিয়াংকা বলেন, শাশুড়ি নিমা রহমানের দেওয়া শাড়ি পরবেন। শাশুড়ির গয়নায় সাজবেন। তাঁর পছন্দের রং যেকোনো হালকা রং। পিচ, পেস্ট ইত্যাদি। (নিমা রহমান হেসে বলেন, হুম, বুঝেছি পছন্দগুলো জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে—ফের পুরো পরিবারের হাসি)।

এবারের ঈদে তারিক আনাম খানের তিনটি ছবি মুক্তি পাবে। দর্শক–পাঠকদের উদ্দেশে ছবিগুলো দেখার আমন্ত্রণ জানান তিনি। সেই সঙ্গে নিমা রহমান, তারিক আনান খান এবং এগনেস র‌্যাচেল প্যারিস প্রিয়াংকা মনে করেন, শুধু ঈদ নয়, সব উৎসব অনুষ্ঠানই হোক হানাহানি ভুলে গিয়ে নির্মল আনন্দে ভালোবাসাপূর্ণ, সব জাতি–ধর্মনির্বিশেষে সব মানুষের।

সৌজন্যে: প্রথম আলো বর্ণিল ঈদ