দিলুর ছিল অপূর্ব জীবনীশক্তি

অভিনেতা মুজিবুর রহমান দিলুর মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালা প্রাঙ্গণেছবি:সংগৃহীত

‘আমরা ছয় ভাই ও দুই বোন ছিলাম, আমি সবার জ্যেষ্ঠ। আজ আমাদের এক ভাই চলে গেল। পনেরো বছর আগে গুলেনবারি সিনড্রোমে আক্রান্ত হয়েও সে ফিরে এসেছিল। দিলুর ছিল অপূর্ব জীবনীশক্তি। সেই জীবনীশক্তির কারণেই সে অপরাজিত।’ ছোটভাই অভিনেতা মুজিবুর রহমান দিলুকে শেষবার শ্রদ্ধা জানাতে এসে এসব কথা বললেন নাট্যজন আতাউর রহমান।

আতাউর রহমান জানান, ২০০৫ সালের পর অভিনয়জীবন থেকে নিজেকে কিছুটা দূরে সরিয়ে রাখলেও শিল্পের মানুষদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল। বীর মুক্তিযোদ্ধা দিলুর যুদ্ধকালীন স্মৃতির চুম্বক অংশ তুলে ধরে আতাউর রহমান কান্নাভেজা কণ্ঠে বলেন, ‘দিলু মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিল কাউকে না বলে, বাসা থেকে পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে প্রশিক্ষণ নিয়েছিল। যুদ্ধ শেষে যখন ফিরে আসে, তখন তার রণক্লান্ত অবস্থা থেকে তাকে চেনার উপায় ছিল না। তখন আমি কাজ করি এক বিদেশি সংস্থায়। সে আমার অফিসে গিয়েছিল। অনেক কথার পর তাকে আমরা চিনতে পারি।’

বিকেলে অভিনেতা দিলুর মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালা প্রাঙ্গণে। সেখানে এক অস্থায়ী বেদিতে রাখা হয় তাঁকে। ফুল দিয়ে তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন, থিয়েটারসহ আরও বেশ কিছু সংগঠন।

অভিনেতা দিলুর ছোট ছেলে অতুল রহমান দেশের বাইরে। বাবার দাফনে অংশ নিতে পারলেন না তিনি। দূর দেশ থেকে স্বরবার্তায় বাবার জন্য দোয়া চাইলেন তিনি। বড় ছেলে অয়ন রহমান সেই বার্তা সবার উদ্দেশে তুলে ধরেন। অতুল বলেছেন, ‘বড় হওয়া পর্যন্ত একজন মানুষকেই সবচেয়ে সৎ দেখেছি, তিনি আমাদের বাবা। বাবার জন্য আপনারা সবাই দোয়া করবেন।’

মঞ্চ ও টেলিভিশন নাটকের অভিনেতা মুজিবুর রহমান দিলু
ছবি : ফেসবুক থেকে

বীর মুক্তিযোদ্ধা দিলু যুদ্ধ করেছেন ২ নম্বর সেক্টরে। তাঁর কমান্ডার ছিলেন নাসির উদ্দীন ইউসুফ। তিনি বলেন, ‘মাত্র ১৮ বছর বয়সে অভিনেতা দিলু দেশমাতৃকার ডাকে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে সে যখন মুক্তিযুদ্ধে গেল, তখন সে ভালো করেই জানত, এ মহান কাজে তাকে জীবনও দিতে হতে পারে। কিন্তু সে ছিল অকুতোভয়।’
রণাঙ্গণের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে নাসির উদ্দীন ইউসুফ বলেন, ‘রাইসুল ইসলাম আসাদ ও কাজী শাহাবুদ্দিন শাহজাহানের মতো সে–ও ছিল এক দুর্ধর্ষ গেরিলা যোদ্ধা। যুদ্ধকালীন আমাদের বেশ কয়েকটি স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়া হলো। তখন আমাদের সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফ দায়িত্ব দিলেন, এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করতে হবে। কাজটা বেশ কঠিন। তখন গুটিকয়েক শিক্ষার্থী ক্লাসে যাচ্ছিলেন, সেখানে বোমা হামলা হলে তো আমাদের বন্ধুরাই মারা পড়বে। দিলুর ওপর দায়িত্ব পড়ল ঢাকা কলেজ বন্ধ করার। সে দিনদুপুরে সাধারণ ছাত্রের বেশে ঢাকা কলেজে ঢুকে পড়ল। তখন সবাই জেনে গেছে, দিলু গেরিলা যোদ্ধা। দিলু তড়িৎ গতিতে বোমা মেরে চলে আসল। ঢাকা কলেজ বন্ধ হয়ে গেল।’


দিলুর অভিনয়জীবন নিয়ে নাসির উদ্দীন বলেন, ‘আমাদের অনুজ দিলু যখন মঞ্চে এল, তখন ‘আমি গাধা বলছি’, ‘নানা রঙের দিনগুলি’ কীভাবে তাকে জনপ্রিয়তা এনে দিল, সে তো আমাদের চোখের দেখা। আশির দশক থেকে যারা নাট্যচর্চায় যুক্ত হয়েছে, তারা সকলেই জানে, দিলু ছিল সব চরিত্রে পারঙ্গম। তার মতো চমৎকার কণ্ঠস্বর ও উচ্চারণ খুব কম লোকের হয়। দিলুর চলে যাওয়া ইতিহাসের বড় অংশের বিদায়।’
বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী বলেন, ‘নিভৃতচারী মানুষ ছিলেন অভিনেতা দিলু। তার লক্ষ্যই ছিল ভালো কাজের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত রাখা। যাঁরা নীরবে–নিভৃতে দেশ, সমাজ ও শিল্পের উৎকর্ষ সাধনের জন্য কাজ করে যান, তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা সব সময়ই আমাদের আলাদা রকম বেশি।’
মঙ্গলবার ভোরে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন অভিনেতা মুজিবুর রহমান দিলু। জোহরের নামাজের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদে তাঁর জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। শিল্পকলা একাডেমিতে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর মঙ্গলবার বাদ আসর বনানী কবরস্থানে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হয়েছে অভিনেতা মুজিবুর রহমান দিলুকে।