পালিয়ে আসতে চেয়েছিলেন আসাদ

‘লাল দরজা’র শুটিং থেকে পালিয়ে আসতে চেয়েছিলেন রাইসুল ইসলাম আসাদকোলাজ

‘লাল দরজা’র শুটিং শুরু হয়ে গেছে। তখনো চিত্রনাট্য, গল্প—কিছুই হাতে পাননি। প্রস্তুতি নিতে আগেভাগেই তাই কলকাতায় চলে গেলেন রাইসুল ইসলাম আসাদ। চিত্রনাট্য হাতে নিয়ে চমকে উঠলেন—পুরো সিনেমায় তাঁকে গাড়ি চালাতে হবে। অথচ গাড়ি চালনায় তিনি আনাড়ি। নির্মাতাকে সরাসরি গিয়ে দিলেন, এ চরিত্রে তিনি অভিনয় করতে পারবেন না। কিন্তু বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত তাঁকে ছাড়তে নারাজ। কলকাতা থেকে পালিয়ে আসার পরিকল্পনা করেন আসাদ।

রাইসুল ইসলাম আসাদ। ছবি: প্রথম আলো

শেষ পর্যন্ত অবশ্য আর পালিয়ে আসা হয়নি। নানাভাবে রাইসুল আসলাম আসাদকে বোঝালেন বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত—তাঁকে এ সিনেমায় দরকার। রাইসুল আসলাম আসাদও নাছোড়। তাঁকে নিয়ে শুটিং করা সম্ভব না। শুধু শুধু সময় ও অর্থের অপচয় হবে। এইখানে রাইসুল ইসলামকে থামিয়ে দিই, আপনি তো হাল ছাড়ার মানুষ না, সেদিন কেন মনে হলো পারবেন না?

‘আমি কখনোই চাই না আমাকে দিয়ে কারও কোনো ক্ষতি হোক। চিত্রনাট্যে আমি জটিল এক চরিত্র। কলকাতার ব্যস্ত শহরে আমাকে গাড়ি চালাতে হবে। আমার গাড়ি ছিল। আমি টুকটাক গাড়ি চালাতে পারতাম। কিন্তু নিয়মিত কখনো চালাইনি। এই শুটিংয়ের গাড়ির পেছনে থাকবে দামি ক্যামেরা। তা ছাড়া ভিড়ের মধ্যে গাড়ি চালাতে গেলে যেকোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটবে। সেই জায়গা থেকে আমি কাজ করতে চাইনি,’ বললেন রাইসুল ইসলাম আসাদ।

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত
ইনস্টাগ্রাম

বুদ্ধদেব দাশগুপ্তকে বুঝিয়ে বলেও লাভ হলো না। উল্টো বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত তাঁকে একজন চালক ঠিক করে গাড়ি চালনার প্রশিক্ষণে লাগিয়ে দেন। রাইসুল ইসলাম আসাদ তখন শর্ত দেন, আগে দেখবেন ঠিকমতো চালাতে পারবেন কি না। যদি তাঁকে দিয়ে চালানো সম্ভব হয়, তাহলেই শুটিং শুরু করবেন।

তিনি বলেন, ‘টানা সপ্তাহখানেক শিখলাম। আস্তে আস্তে আমার মধ্যে আত্মবিশ্বাস আসে। একদিন বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত আমাকে বললেন, আরে আপনি তো ভালো গাড়ি চালাতে পারেন। শুরু হলো শুটিং। বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত আমার অভিনয় দেখে বললেন, আপনি পরপর আমার তিনটি সিনেমায় অভিনয় করবেন। কথা না দিলে আপনাকে ছাড়ছি না।’

কিন্তু আসাদের কথা জানলেন কী করে বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত? ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ সিনেমায় মেকআপ আর্টিস্ট ছিলেন কলকাতার দেবী হালদার। বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের সিনেমাতেও তিনি কাজ করেছেন। যখন ‘লাল দরজা’র জন্য অভিনেতা খুঁজছিলেন বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, তখন তিনিই রাইসুল ইসলাম আসাদের কথা বলেন। পরে ‘পদ্মা নদীর মাঝি’র প্রযোজকের মাধ্যমে তাঁর সঙ্গে পরিচয়। সেই থেকে তাঁদের সম্পর্ক।

পর্দায় রাইসুল ইসলাম আসাদ। ছবি: ইউটিউব থেকে

পরে ‘উত্তরা’য়ও কাজ করেন আসাদ। ছবিতে তিনি একজন পাদরি। সিনেমাটি ২০০০ সালে ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে রৌপ্যসিংহ পুরস্কার জয় করে। স্বর্ণসিংহের জন্যও মনোনয়ন পায় ‘উত্তরা’। লাভ করে ভারতের জাতীয় পুরস্কারসহ একাধিক বিদেশি সম্মাননা। রাইসুল ইসলাম আসাদ বলেন, ‘একজন নির্মাতা আমার কাছে কী ধরনের অভিনয় চাইছেন, সেটাকেই আমি সব সময় গুরুত্ব দিই। একটি দৃশ্য নিয়ে আমাদের প্রচুর আলাপ হতো। খুঁটিনাটি সবকিছু নিয়েই আমরা আলোচনা করতাম। যুক্তি–তর্কে অনেক সময় আমারও ধারণাকেও তিনি প্রাধান্য দিতেন। এভাবে একটি চরিত্র ফুটিয়ে তোলা তিনি পছন্দ করতেন। আস্তে আস্তে আমাদের মধ্যে ভালো সম্পর্ক হতে থাকে। আমরা চলচ্চিত্র, ব্যক্তিজীবন, সম্পর্ক, লেখালেখি নিয়ে আড্ডা দিতাম। পুরুলিয়ায় বা কলকাতায় আমাদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা জমত।’

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত আপনাকে নিয়ে তো তিনটি সিনেমা করতে চেয়েছিলেন, তৃতীয়টা কেন হলো না? রাইসুল ইসলাম আসাদ বলেন, ‘আমারও খুব ইচ্ছা ছিল। ২০০৬ সালে আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি। তিন বছর পরে সুস্থ হই। তখন আবার বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি অনেকবার ঢাকায় এসেছেন। একবার ঢাকায় এসেছিলেন চলচ্চিত্র উৎসবে। কোলাহল পছন্দ করতেন না। দ্রুত সরে পড়ার জন্য বললেন, আমার বাসায় যাবেন। তখনো তিনি বলতেন, আমাদের তিনটা ছবি করতেই হবে। সেটাই এখন আফসোস। গুণী একজন নির্মাতার সঙ্গে কাজটা হয়ে উঠল না।’

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত মারা গেছেন ১০ জুন
ছবি: কোলাজ

গত এপ্রিল থেকে যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছেন রাইসুল ইসলাম আসাদ। সেখানেই ‘উত্তরা’র সহকর্মী সোমা ও আরও বেশ কিছু মানুষের কাছ থেকে জানতে পারেন, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত আর নেই। শোনার পরে কষ্ট পেয়েছেন। আগে থেকেই জানতেন দীর্ঘদিন ধরে এই নির্মাতাকে নিয়মিত ডায়ালাইসিস করতে হচ্ছে। আসাদ বলেন, ‘আমি কলকাতায় আরও সিনেমা করেছি। শুটিং শেষ হলেই আমাদের আড্ডা জমত। কখনো প্রায় সারা রাত ধরে চলত আড্ডা। দূর থেকেও তাঁর স্পর্শগুলো অনুভব করছি।’