বাস–ট্রাকের মাঝখানে পড়ে ছিলেন ক্যামেরাম্যান রাহাত

অনিমেষ রাহাত
ছবি : সংগৃহীত

গত মাসে আজকের এই দিনে অনিমেষ রাহাত ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন, ‘জীবনটা অনেক ছোট, সময় দ্রুত চলে যায়। একে ফিরে পাওয়া যায় না। যতটা সময় বেঁচে আছেন, জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করুন।’ রাহাত হয়তো সেই চেষ্টাই করতেন। নয়তো জেনে গিয়েছিলেন, তাঁর জীবনের দৈর্ঘ্য। মোটরসাইকেল চালিয়ে শুটিংয়ের আসার পথে আজ বুধবার এক মারাত্মক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান তিনি। বিনোদন অঙ্গনের একজন আস্থাভাজন স্ট্যাডিক্যাম অপারেটর হিসেবে কাজ করতেন তিনি।

রাহাতের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছেন তাঁর সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ আবদুল্লাহ। তিনি জানান, গাজীপুরের চান্দরা ছাড়িয়ে কিছুটা সামনে একটি ওয়ালটন শোরুমের পাশে সকাল ৭টা ৪৫ মিনিটে দুর্ঘটনার কবলে পড়েন রাহাত। ঘটনাস্থলেই মারা যান তিনি। রাহাতের লাশ রয়েছে শালনা হাইওয়ে থানায়। আবদুল্লাহ বলেন, ‘রাহাত ভাই মোটরসাইকেলে একাই আসছিলেন। একটা লোকাল বাস ভাইয়ের বাঁয়ে দাঁড়ানো ছিল। ভাই ডান পাশ থেকে বের হওয়ার জন্য এগোতে থাকেন, এমন সময় সামনে থেকে আসা একটি ট্রাক তাঁকে চাপা দেয়। তিনি বাস ও ট্রাকের মাঝে পড়ে যান। আমি আসার পরে জানতে পারলাম ঘটনাস্থলেই ভাই মারা গেছেন।’ দুর্ঘটনার কিছুক্ষণ পরই সেখানে পুলিশ আসে। দুমড়েমুচড়ে যাওয়া বাইক এবং লাশ তাদের হেফাজতে রয়েছে। রাহাত ঢাকায় থাকতেন। সম্প্রতি পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে তিনি সিরাজগঞ্জ গিয়েছিলেন। সেখান থেকেই ফিরে আজ সরাসরি শুটিংয়ে অংশ নেওয়ার কথা ছিল।

ক্যামেরা সহকারী হিসেবে বিনোদন অঙ্গনে কাজ শুরু করেছিলেন রাহাত
ছবি : সংগৃহীত

ক্যামেরা সহকারী হিসেবে বিনোদন অঙ্গনে কাজ শুরু করেছিলেন রাহাত। কাজ করতে থাকেন ক্যামেরা এবং ফোকাস পোলার হিসেবে। পরে আগ্রহী হয়ে ওঠেন স্ট্যাডিক্যাম চালানোয়। দেশে পাঁচ বছর কাজ করার পর শেখার জন্য তিনি ভারতে যান। সেখানে এসকে মুভিজের সঙ্গে কাজ করে দক্ষতা অর্জন করেন। ভারত থেকে ফিরে তিনি দেশে নিয়মিত কাজ শুরু করেন। সম্প্রতি তিনি ‘যদি কিন্তু তবুও’, ‘মুক্তি’, ‘গাঙচিল’, ‘নবাব এলএলবি’সহ বেশ কিছু ছবিতে কাজ করেছেন। তাঁর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন নির্মাতা, ক্যামেরাম্যান ও অভিনয়শিল্পীরা।

জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত চিত্রগ্রাহক রাশেদ জামান জানান, গত ৫০ বছরে মাত্র দুজন কঠোর পরিশ্রমী স্ট্যাডিক্যাম পরিচালক তৈরি হয়েছিল। তাঁর মধ্যে একজন ছিলেন অনিমেষ রাহাত। তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে টেকনিক্যাল লোকের অভাব। ক্যামেরার পেছনে কাজের জন্য দক্ষ লোকবল তৈরির কোনো ব্যবস্থা নেই। রাহাত নিজেই স্বপ্ন দেখত ক্যামেরার পেছনের কাজগুলো নিয়ে। কিছুদিন আগে তার ডেমো রিল ও স্ট্যাডিক্যাম নিয়ে দেখা করতে এসেছিল। সে শুধু নিজের কাজটাই করত না; ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখত। অনেক বড় ক্ষতি হলো আমাদের।’

তিন দিন আগে ‘মুক্তি’ ছবির শুটিংয়ে অংশ নিয়েছিলেন অনিমেষ রাহাত
ছবি : সংগৃহীত

রাহাত থাকতেন কাঁঠালবাগান এলাকায়। জানুয়ারিতেই মহানগর আবাসিকে বাসা নিয়েছিলেন। ইচ্ছা ছিল নতুন বাসায় স্ত্রীকে নিয়ে উঠবেন। আবদুল্লাহ জানান, রাহাত পরিবারের সঙ্গে দেখা করে স্ত্রীকে নিয়ে ঢাকায় ফিরতে চেয়েছিলেন। গতকাল দুপুরে ফোনে তাঁকে জানান, আপাতত স্ত্রীকে নিয়ে ফিরছেন না। আবদুল্লাহ বলেন, ‘আমরা একই এলাকার। ভাবিকে নিয়ে আজ আসার কথা ছিল। গতকাল ভাই ফোন দিয়ে বললেন, “তোমার ভাবিকে আপাতত আনছি না। তুমিসহ পরেরবার এসে আমরা একসঙ্গে ঢাকা যাব।” ভাইকে বলেছিলাম, আমি কাল এদিক দিয়েই শুটিংয়ে যাব।’ আবদুল্লাহ আজ ঢাকা থেকে শুটিংয়ে চলে যান। গুরুর জন্য অপেক্ষা করছিলেন ‘মুখোশ’ ছবির সেটে। এমন সময়ে তাঁর মৃত্যুর খবর জানতে পারেন।

তিন দিন আগে ‘মুক্তি’ ছবির শুটিংয়ে অংশ নিয়েছিলেন অনিমেষ রাহাত। তাঁর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছে ‘মুক্তি’ ছবির ইউনিট। নির্মাতা ইফতেখার বলেন, ‘রাহাতের মতো একজন দক্ষ টেকনিশিয়ান মারা যাওয়ায় আমি বাকরুদ্ধ। এটা আমাদের জন্য দুঃখজনক।’ ইউনিটে রাহাতের সহকর্মীরা তাঁকে স্মরণ করে এক মিনিট নীরবতা পালন করেন। রাহাত নির্মাতা অমিতাভ রেজা, মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, আদনান আল রাজীব, শিহাব শাহীনের সঙ্গে নিয়মিত কাজ করতেন।

এই খবর প্রকাশের মুহূর্তে জানা যায়, অনিমেষের মরদেহ তাঁর গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। সিরাজগঞ্জের কামারখন্দের কাজীপুরা গ্রামে তাঁকে দাফন করা হবে।

গত জুন মাসে মোটরসাইকেলটি কিনেছিলেন রাহাত
ছবি : সংগৃহীত