শিক্ষিতের হার বাড়লেও আলোকিত মানুষের সংখ্যা কমছে

জয়া আহসানইনস্টাগ্রাম
নারীর ওপর পারিবারিক সহিংসতা ও যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করলেন অভিনেত্রী জয়া আহসান। সম্প্রতি কমনওয়েলথের একটি কর্মসূচিতে বিশ্বের প্রভাবশালী ২০ জন নারীর সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে বললেন, ‘নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা আর নয়’। ‘কমনওয়েলথ সেইস নো মোর’ কর্মসূচির সূত্র ধরে কথা হয় জয়া আহসানের সঙ্গে। তিনি বলেন নিজের অভিজ্ঞতা থেকে কিছু কথা।

প্রশ্ন :

কেন ও কীভাবে কমনওয়েলথের এই কর্মসূচির সঙ্গে সম্পৃক্ত হলেন?

কমনওয়েলথের মহাসচিব প্যাট্রিসিয়া স্কটল্যান্ডের কাছ থেকে একটি ই–মেইল পাই। তিনি বিশ্বের বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তির সঙ্গে আমাকেও ‘কমনওয়েলথ সেইস নো মোর’ কর্মসূচিতে যুক্ত হওয়ার অনুরোধ করেন। বাংলাদেশ থেকে আমাকে বলা হয় এর প্রতিনিধিত্ব করতে। বিষয়টি নিঃসন্দেহে আমার জন্য অনেক বড় ব্যাপার। এ ধরনের কাজ তো আমার দায়িত্ববোধের জায়গা থেকেই করতে হয়। কমনওয়েলথ থেকেই জানানো হয় এই কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া অন্য ব্যক্তিদের নাম। যার মধ্য নিউজিল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী, কিরবাটির বর্তমান প্রেসিডেন্ট, ভারতীয় অভিনেত্রী শাবনা আজমি থেকে শুরু করে যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়ার অনেক অভিনয়শিল্পী ও সংগীতশিল্পীর নামও ছিল।

আসলে নারীর প্রতি পারিবারিক সংহিসতা সব সময়, সব দেশেই চলমান ঘটনা। একে ঘরের ব্যাপার বলে সব সময়ই দাবিয়ে রাখা হয়, প্রকাশ হতে দেওয়া হয় না। বিশেষ করে করোনাকালে তো পারিবারিক সহিংসতা সবখানে বেড়ে গেছে। তাই এই সময়ের জন্য এমন একটি কর্মসূচি খুবই প্রাসঙ্গিক ছিল। তাই আমি আমার দায়িত্ববোধের জায়গা থেকেই যুক্ত হয়েছি কমনওয়েলথের এই উদ্যোগের সঙ্গে। এটাই উপযুক্ত সময় ‘না’ বলার।

প্রশ্ন :

ব্যক্তিগত জীবনে পারিবারিক সহিংসতা কিংবা যৌন নিপীড়নের কোনো অভিজ্ঞতা হয়েছে কি?

আসলে এ ধরনের সহিসংতা, নিপীড়ন ও বৈষম্যের গল্প প্রত্যেকটি মেয়ের জীবনেই আছে। আমারও আছে। নারীর ওপর সহিংসতা ও বৈষম্য আমাদের রক্তের ভেতর ঢুকে গেছে, যা আমরা বুঝতেই পারি না। আর এ কারণেই সমাজ পঙ্গু হয়ে যাচ্ছে। সমাজে আমরা যা কিছু অধঃপতন দেখি, তা কিন্তু আমাদের শিরায় শিরায় মিশে যাচ্ছে অনেক ছোট ছোট বিষয় থেকে। স্লো পয়জনের মতো করে নারীর প্রতি সহিংসতা-অত্যাচার আমাদের সমাজে মিশে গিয়ে সবকিছুকে বিষিয়ে তুলছে। ছোটবেলা থেকেই আমাদের শেখানো হচ্ছে, ‘তুমি মেয়ে। তুমি ফুটবল খেলতে পারবে না, তুমি খেলবে পুতুল।’ এভাবেই একেবারে জন্মের পর থেকে শুরু হয় একটা মেয়ের ওপর নির্যাতন। খেলার মাঠ, পরিবার, খাবার টেবিল, স্কুল ও ক্লাসরুমেও আমাদের মধ্যে বৈষম্য ও নারীর প্রতি অবজ্ঞা ঢুকিয়ে দেওয়া হয়।

প্রশ্ন :

এরপর কাজের ক্ষেত্রেও তো নিশ্চয়ই প্রতিনিয়ত বৈষম্যের শিকার হতে হয়?

তা তো অবশ্যই হতে হয়। শুধু বাংলাদেশের এন্টারটেইনমেন্ট ইন্ডাস্ট্রি নয়, পুরো বিশ্বের বিনোদন ক্ষেত্রই ভীষণভাবে পুরুষশাসিত। হলিউড, বলিউড, টালিউড, ঢালিউড—এখনো সবখানে মেয়েদের চেয়ে অনেক বেশি পারিশ্রমিক ছেলে আর্টিস্টদের। চিত্রনাট্যে বা উপস্থাপনে নারী শিল্পীদের কীভাবে মূল্যায়ন করা হচ্ছে, তা–ও প্রশ্ন তোলার মতো বিষয়। আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আমরা যে কীভাবে প্রতিদিন হেয় হই, ট্রলড হই—তা বলে শেষ করা যাবে না। নারীর প্রতি নিপীড়ন একেবারে সমাজের পরতে পরতে ঢুকে গেছে।

প্রশ্ন :

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নারীর প্রতি যে সহিংসতা হচ্ছে, আপনিও তো সেই সহিংসতার শিকার হয়েছেন। ভার্চ্যুয়াল জগতের এসব বাজে মন্তব্য ও ট্রল কতটা প্রভাবিত করে আপনাকে?

সোশ্যাল মিডিয়ার ট্রল ও বাজে মন্তব্য একটা সময় আমার ওপর প্রভাব ফেলত। এখন আর ফেলে না। কারণ আমি বুঝে গেছি, শিক্ষিতের হার বাড়লেও আলোকিত মানুষের সংখ্যা কমছে। নারীর মর্যাদা দিতে হলে শুধু শিক্ষিত হলে হয় না, ভেতর থেকে একজনকে আলোকিত মানুষ হতে হয়। আসলে আমরা যে কতটা অশিক্ষার মধ্যে পড়ে আছি, তা উপলব্ধিই করতে পারি না।

জয়া আহসান
ইনস্টাগ্রাম

প্রশ্ন :

এই ধরনের নিপীড়নগুলোর বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার অনুপ্রেরণা কোত্থেকে পেয়েছেন?

নানাভাবে নানান জনের থেকে আমি অনুপ্রেরণা পাই। তবে আমার নিজের কাজ থেকে আমি সবচেয়ে বেশি অনুপ্রাণিত হই। আমাকে লোকে অনেক কথা বলেছে, কিন্তু আমি মুখে কথা বলায় বিশ্বাসী নই। আমার বিশ্বাস ছিল কাজ করে দেখানোয়। আমাকে মানুষ যতটা বিরক্ত করেছে, বিব্রত করেছে, আমি সেগুলোকে আমার শক্তি হিসেবে দেখেছি। আমার সে সময়ের সাহস আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে। আমি আমার মায়ের কাছ থেকেও অনেক কিছু শিখেছি। এখনো বলি, আমার ভেতর থাকা সব ভালো গুণ মায়ের কাছ থেকেই পাওয়া।