শোক, শ্রদ্ধা, বিদায় আলী যাকের

অভিনেতা আলী যাকের তাঁর অঙ্গনের প্রিয় ও শ্রদ্ধেয়জন। ক্যানসারের সঙ্গে লড়ছিলেন চার বছর ধরে। এরই মধ্যে এসে হানা দেয় করোনাভাইরাস। করোনায় আক্রান্ত হয়ে গতকাল ভোরে চিরবিদায় নেন আলী যাকের। তাঁকে হারিয়ে শোকাহত বিনোদন অঙ্গন। শ্রদ্ধার সঙ্গে তাঁকে বিদায় জানিয়েছেন তাঁর দীর্ঘদিনের সহযাত্রীরা।

শ্রদ্ধার সঙ্গে আলী যাকেরকে বিদায় জানিয়েছেন তাঁর দীর্ঘদিনের সহযাত্রীরাকোলাজ

ফেরদৌসী মজুমদার, অভিনেত্রী
মঞ্চে ম্যাকবেথ ও টেমপেস্ট ও টেলিভিশনে বেশ কয়েকটি নাটকে আমি তাঁর সহশিল্পী ছিলাম। অভিনয়টা তিনি খুব ভালোবাসতেন। সে জন্য তাঁকে আমি খুব পছন্দ করতাম। সহশিল্পী হিসেবে তিনি আমাকে অনেক উচ্চাসনে বসিয়েছিলেন। অনেক আগে একবার আমার মস্কো রেডিওতে কাজ করতে যাওয়ার কথা ছিল। আমার বাসায় গিয়ে যাকের বলেছিলেন, ‘আপনি চলে গেলে আমি কার সঙ্গে অভিনয় করব।’

ফেরদৌসী মজুমদার

কথাটা এত আন্তরিক ছিল যে আমি আর যেতে পারিনি। প্রেমপত্র নামে একটি আমেরিকান নাটক আমাদের একসঙ্গে করার কথা ছিল। কিন্তু তাঁর শরীর সায় দিচ্ছিল না। তবু তিনি বলেছিলেন, ‘আপনারা শুরু করুন, আমি যোগ দেব।’ কিন্তু সেটা আর হলো না।

গ্যালিলিও নাটকে আলী যাকের

আসাদুজ্জামান নূর, অভিনেতা
ছটলু ভাইয়ের সঙ্গে আমার সম্পর্ক দীর্ঘ ৫০ বছরের। আমার নাটক, আমার ক্যারিয়ার—সবকিছু তাঁর হাতে গড়ে তোলা। আমাদের এই সম্পর্ক পরিবারের চেয়েও বেশি ছিল। আমার পরম সৌভাগ্য যে আমরা একসঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। তাঁর শেষ ইচ্ছে ছিল মঞ্চে গ্যালিলিও নাটকটায় অভিনয় করার। তাঁর সেই ইচ্ছে পূরণ হয়েছিল।

গ্যালিলিও নাটকের মঞ্চে আসাদুজ্জামান নূর অভিনয় করেছিলেন যাকেরের সঙ্গে

মামুনুর রশীদ, অভিনেতা ও নাট্যকার
কলকাতায় আমরা একসঙ্গে নাটক দেখতাম। উদ্বুদ্ধ হয়ে ঠিক করেছিলাম দেশ স্বাধীন হলে আমরাও নাটক করব। তাঁকে আমি একটি রেডিও নাটকে নিয়েছিলাম। তখনই বুঝেছিলাম, তাঁর ভেতরে অভিনয়ের প্রতিভা আছে। নাগরিকে যোগ দেওয়ার পর দেখা গেল বিজ্ঞাপনী দক্ষতার কারণে দলটির নাটকের চমৎকার প্রচারণা হতো। শুধু নিজের নয়, অন্য দলগুলোর জন্যও সেসব প্রচারণার পথ বাতলে দিয়েছিলেন তিনি।

সত্তরের দশকে আমাদের পাণ্ডুলিপি, নির্দেশক, মঞ্চ কিছুই ছিল না। তার মধ্য দিয়েও বিপুলসংখ্যক কর্মী নিয়ে আমরা যে আধুনিক নাটকের দল করেছিলাম, তিনি ছিলেন সেই কর্মযজ্ঞের এক অগ্রগামী নেতা।

অভিনেতা, নির্দেশক, নাট্যকার মামুনুর রশীদ

কাওসার চৌধুরী, অভিনেতা ও নির্মাতা
তিনি আমাকে প্রমিত বাংলা উচ্চারণ ধরে ধরে শিখিয়েছেন। নয়তো মহেশখালীর মতো একটা দ্বীপ অঞ্চল থেকে উঠে আসা আমার চট্টগ্রামের উচ্চারণভঙ্গি থেকে বের হয়ে আসা সম্ভব ছিল না। অসম্ভব আদর করতেন আমাকে, যা অন্যদের জন্য ছিল ঈর্ষণীয়। তাঁকে নিয়ে একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করব বলে গত ৩৪ বছর তাঁকে শুট করেছি। আজ তাঁর একটা কথা স্মরণ করে খুব কষ্ট হচ্ছে। দুঃখ করে তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘বুঝতে পেরেছি, তুই এগুলো আমাকে দেখাবি না। আমি মারা গেলে তুই সম্পাদনা শুরু করবি!’

গ্যালিলিও নাটকের একটি দৃশ্যে আলী যাকের ও কাওসার চৌধুরী

তারিক আনাম খান, অভিনেতা
পরিচয়ের পর থেকে ব্যক্তিগত ও পারিবারিকভাবে আমরা সম্পৃক্ত ছিলাম। তিনি আমাকে স্নেহ করতেন। সব সময়ই নাটককে এগিয়ে নেওয়ার অনুপ্রেরণা দিতেন। আমাদের দলের ‘নাট্যকেন্দ্র’ নামটি তিনিই দেন। ২০ দিন আগে আমাদের সর্বশেষ দেখা হয়। বিছানায় শুয়ে সৈয়দ জামিল আহমেদসহ পরিচিত সবার খবর নেন। নাটক নিয়ে তাঁর স্বপ্নের বার্তা নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়াই হবে তাঁকে ভালোবাসার সেরা উপায়।

তারিক আনাম খান