হুমায়ূনের জন্মদিনে হিমু, মিসির আলী, বাকের ভাইয়েরা

হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিন! তাঁর নাটকের চরিত্রেরা যদি দিনটা উদ্‌যাপন করত, কেমন হতো? এ নিয়েই কাল্পনিক একটি লেখা।

হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিনে যদি জড়ো হতে পারতেন তাঁর চরিত্ররাকোলাজ : আমিনুল ইসলাম

হিমু একটা মিথ্যুক! রূপাকে ফোনে বলল, দেখা করতে যাচ্ছে। রূপা গাঢ় নীল পাড়ের নতুন শাড়ি পরল। চোখে মোটা করে কাজল দিল। দোতলার বারান্দার গ্রিল ধরে অপেক্ষার প্রহর গুনতে গুনতে ভাবল, আইনস্টাইন লোকটা বোকা। আপেক্ষিকতা তত্ত্বে তিনি বলেছেন, ভালো সময় নাকি দ্রুত ফুরিয়ে যায়৷ অথচ হিমুর জন্য এই যে তাঁর দীর্ঘ অপেক্ষা, এটা তো ফুরাচ্ছে না। কই, তাঁর তো খারাপ লাগছে না!

হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিন উপলক্ষে মাজেদা খালার দেওয়া একটা নতুন পাঞ্জাবি পরেছে হিমু। বাদল আবার জোর করে বিদেশ থেকে আনা পারফিউম মেখে দিয়েছে। কিন্তু নতুন পাঞ্জাবি হিমুর সয় না। গায়ের ভেতর কুটকুট করছে। আর বিদেশি পারফিউমের গন্ধে মাথা ভোঁ ভোঁ করছে। হিমুর একটু শীত শীত লাগছিল। তাই পাঞ্জাবির ওপর রূপার দেওয়া কাশ্মিরি শাল জড়িয়েছে। তাতে পারফিউমের কড়া ঘ্রাণটাকে আটকে দেওয়া গেছে। তীব্রভাবে নাকে এসে ধাক্কা দিচ্ছে না। হিমুর হাতে পাঁচটি নীল পদ্ম। চাদরের নিচে হাত দুটো ঢাকা পড়েছে। পদ্মগুলো হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিনের উপহার।

‘তাঁরা তিনজন’ হাজির হয়েছেন স্যুট–টাই পরে। হ্যাপি বার্থ ডে লেখা কার্টুন আঁকা বেলুন নিয়ে। একজনের হাতে চায়ের জার, একজনের জারে কফি আর তৃতীয় জনের কাছে চার পদের বিস্কুট। জন্মদিনের পার্টিতে এই তাঁদের অবদান

বাকের ভাই আছেন মহা উত্তেজনায়। ইতিমধ্যে তিনি ছয় কাপ চা খেয়ে ফেলেছেন। দোকানের কোণ থেকে রিপিটেড মুডে বেজেই চলেছে, হাওয়া মে উড়তা যায়ে, মেরা লাল দুপাট্টা মাল মাল কা হো জি...হো জি। হুমায়ূন আহমেদের ৭২তম জন্মদিন বলে কথা, এ কি কোনো সাধারণ দিন? সে কী করবে, কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। বারবার অকারণে মুনাকে মনে পড়ছে। মুনার সঙ্গে গিফটের ব্যাপারে একটু আলাপ করা গেলে ভালো হতো। মুনা মেয়েটা খারাপ না।

লাল ফিতায় জড়ানো বেগম আখতারের ক্যাসেট হাতে বাকের ভাই যখন হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিনে এলেন, একা এলেন না, সঙ্গে মজনু ও বদি। সঙ্গে অবশ্য একজন ভিক্ষুকও আছেন। তাঁর নাকি খুব ক্ষুধা পেয়েছে। ‘তাঁরা তিনজন’ হাজির হয়েছেন স্যুট–টাই পরে। হ্যাপি বার্থ ডে লেখা কার্টুন আঁকা বেলুন নিয়ে। একজনের হাতে চায়ের জার, একজনের জারে কফি আর তৃতীয় জনের কাছে চার পদের বিস্কুট। জন্মদিনের পার্টিতে এই তাঁদের অবদান। তাঁরা তিনজন হুমায়ূন আহমেদের সামনে হাজির হয়ে সালাম ঠুকে বললেন, শুভ জন্মদিন স্যার।

মনে পড়তেই কিছু কবিতার বইও সঙ্গে নিলেন মিসির আলী। লেখক ও নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদ মাঝে মাঝে আরাম চেয়ারে দুলে দুলে কবিতা পড়বেন, অসুবিধা কী?

মিসির আলীর শরীরটা ভালো না। দুই রাত ধরে জ্বর। আলমারি খুলে নতুন পাঞ্জাবি পরতেই একটু ভালো বোধ করতে থাকেন তিনি। মতি হাতের কাছে যা পেয়েছে, সব নিয়ে পালিয়েছে৷ জিনিসগুলোর জন্য খারাপ লাগছে না মিসির আলীর। কেবল ছেলেটার জন্য দুঃশ্চিন্তা হচ্ছে। ১৪–১৫ বছরের ছেলেটা এখন কোথায় আছে, কে জানে। তবে মিসির আলীর মন বলছে, মতি ফিরে আসবে। হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিন শেষে গভীর রাতে বাড়ি ফিরে দেখবেন, বারান্দায় পোটলা–পুটলি নিয়ে মাথা নিচু করে গুটিসুটি হয়ে বসে আছে। মিসির আলী ঠিক করে রেখেছেন, সত্যি সত্যি এ রকম হলে তিনি কিছুই বলবেন না। স্বাভাবিকভাবে সকালে চা–নাস্তা বানাতে বানাতে বলবেন, পড়তে বসাবেন। তবে হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিনে কী উপহার দেবেন, এটা তাঁকে ভাবাচ্ছে। ঠিক করলেন, চোখ বন্ধ করে আলমারির ড্রয়ার খুলে কিছুক্ষণ হাতড়াবেন। তারপর একটা কিছু তুলে নেবেন। হাতে যা উঠে আসবে, সেটাই হবে হুমায়ূন আহমেদের উপহার। কতজন কত উপহার দেয় মিসির আলীকে, সেসব তিনি ওই ড্রয়ারেই ফেলে রাখেন।

চোখ খুলে দেখলেন হাতে উঠে এসেছে একটা বালুঘড়ি। এই বালুঘড়ি তাঁকে দিয়েছিল তাঁর প্রিয় ছাত্রী নীলু। হঠাৎ একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের করিডোরে তাঁকে থামিয়ে বলল, স্যার? তারপর হাতে বালুঘড়িটা ধরিয়ে দিয়ে দিয়ে গটগট করে হেঁটে চলে গেল। নীলু মেয়েটা অদ্ভুত। সে সাধারণত কবিতার বই দেয়। মনে পড়তেই কিছু কবিতার বইও সঙ্গে নিলেন মিসির আলী। লেখক ও নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদ মাঝে মাঝে আরাম চেয়ারে দুলে দুলে কবিতা পড়বেন, অসুবিধা কী?

গরম ভাতের সঙ্গে এক চামচ ঘি, মচমচে বেগুন ভাজা, কাঁচা টমেটো পুড়িয়ে ভর্তা, পেঁয়াজ–রসুন দিয়ে ঝালঝাল করে ডাহুক পাখির মাংস ভুনা, খলসে মাছের ঝোল, পাটশাক, ডাল, কৈ মাছের ভর্তা, কলার মোচা আর চিংড়ির ভাজি সঙ্গে সবুজ কাঁচা মরিচ। আরও ছিল বাসি পোলাওয়ের সঙ্গে ডিমভাজা, জিরার মতো চিকন করে কাটা আলু ভাজি

হিমু, বাকের ভাই, মিসির আলী, তাঁরা তিনজন হুমায়ূন আহমেদের ডেরায় গিয়ে দেখে, চাঁদনী পসর রাতের এক হুলুস্থুল কান্ড। ৭২টা কেক। প্রধান কেকের ওপর লেখা, ‘মানুষ বড় অভিমাণী প্রাণী। ’ একটা কেকের ওপর চোখ আটকালো মিসির আলীর। সেখানে লেখা, ‘মানুষ হওয়ার সবচেয়ে বড় যন্ত্রণা হল, যা বলতে প্রাণ কাঁদে তা কখনোই বলা হয় না। ’ মিসির আলী ভাবলেন, কেন, সমস্যা কী? বলে ফেললেই তো হয়। পুষ্প নিজের হাতে একটি কেক বানিয়েছে। সেটার ওপর সাদা অক্ষরে লিখেছে, ‘তুমি আমার জন্যে দু’ফোটা চোখের জল ফেলেছ, তার প্রতিদানে আমি জনম জনম কাঁদিব। ’ পড়ে বিরক্ত হলেন হুমায়ূন। জন্মদিনে কান্নাকাটি কেন?

খাওয়া–দাওয়ার আয়োজন দেখলে যে কারো চোখ কপালে উঠবে। ধোঁয়া ওঠা গরম ভাতের সঙ্গে এক চামচ ঘি, মচমচে বেগুন ভাজা, কাঁচা টমেটো পুড়িয়ে ভর্তা, পেঁয়াজ–রসুন দিয়ে ঝালঝাল করে ডাহুক পাখির মাংস ভুনা, খলসে মাছের ঝোল, পাটশাক, ডাল, কৈ মাছের ভর্তা, কলার মোচা আর চিংড়ির ভাজি সঙ্গে সবুজ কাঁচা মরিচ। আরও ছিল বাসি পোলাওয়ের সঙ্গে ডিমভাজা, জিরার মতো চিকন করে কাটা আলু ভাজি। খাওয়াদাওয়া পর্ব শেষ করে ভরা জোছনায় শুরু হল গানের আসর। সব চরিত্রদের সঙ্গে নিয়ে চোখ বন্ধ করে হুমায়ূন আহমেদ বললেন, ‘পুষ্প, একটা গান ধরো তো। আর শোনো, আনন্দের গান ধরবা।’