অজানা জেমসের খোঁজে

>

চেনা রূপে জেমস। ছবি: কবির হোসেন
চেনা রূপে জেমস। ছবি: কবির হোসেন

জেমস মানে উন্মাতাল সুর, ‘সিনায় সিনায় লাগে টান’। জেমস আমাদের নগরবাউল এবং ভক্তদের ‘গুরু’। বাংলাদেশের ব্যান্ডের এই মহাতারকার ভাষায়, ‘আমি তোমাদেরই লোক’। কিন্তু মঞ্চে উঠলে তিনি যতটা কাছের, মঞ্চ ছাড়তেই ততটা দূরের তারা। সংগীতশিল্পী জেমস আমাদের যতটা চেনা, ব্যক্তি জেমস আমাদের কাছে এখনো অনেকটাই অজানা। এই লেখায় জেমসের ভেতরের মানুষটাকে আবিষ্কার করার চেষ্টা করেছি আমরা।

১৩ আগস্ট, সোমবারের নাগরিক বিকেল। ঠিক পাঁচটা থেকে রাজধানীর গুলশান সোসাইটি লেক পার্কে বসে আছি আমরা, আগ্রহ অধীর। অতঃপর কালো রঙের একটি গাড়ি থেকে নগরবাউল নেমে এলেন। চোখে রোদচশমা, পরনে টি-শার্ট-জিনস। পার্ক তখন মানুষের পদচারণে মুখর। নিয়মের হাঁটাচলার মাঝে কেউ কেউ থমকে দাঁড়াল, চোখ বড় বড় করে বিস্ময় ভাগ করল সঙ্গীর কাছে, ‘আরে, জেমস না?’ যাঁকে নিয়ে বিস্ময়, তিনি নির্লিপ্ত।

জেমস আসলে এমনই...। আসলে কি এমনই? ছবি তোলার পর্ব শেষ হওয়ার পর তাঁর সঙ্গে আমরা যখন কথায় ডুবে গেলাম, তখন সবিস্ময়ে আবিষ্কার করলাম, জেমস আসলে এমন ছিলেন না! তাঁর ভাষায়, ‘আমি ছিলাম এক্সট্রোভার্ট (বহির্মুখী), ভীষণ দুরন্তপনা করেছি ছেলেবেলায়।’

ছবি তোলার পর্ব শেষ করে জেমস আমাদের নিয়ে গেলেন বনানীর রয়্যাল পার্ক রেসিডেন্সে। ভেতরে ঢুকেই সোজা চলে গেলের নিচতলার ছোট্ট পুলপাড়ে। বেয়ারা এসে খাবারের মেন্যু জেনে গেলেন। শুরু হলো কথাবার্তা। গানের সুরে জীবনটা বাঁধতে আশির দশকের শুরুর দিকে যাত্রা শুরু করেছিলেন জেমস। আজও ছুটছেন। তাঁর একটা গানের কথা এ রকম, ‘চোরা সুরের টানে রে বন্ধু,/ মনে যদি ওঠে গান,/ গানে গানে রেখো মনে/ ভুলে যেয়ো অভিমান...’। ফলে ‘আপনি কেন নিজেকে আড়ালে রাখেন?’ এই প্রশ্ন করতে গেলেও অভিমানটা গিলে ফেলতে হয়। নিজের চরিত্রের এই দিকটা নিয়ে তাঁর ব্যাখ্যা এ রকম, ‘একা থাকতে পছন্দ করি। তখন হয়তো নিজের মতো ভাবি, ভাবতে ভালো লাগে। চুপচাপ থাকলে কোনো একটা বিষয় নিয়ে ফোকাসড থাকা যায়। তবে আমি তো গানের জন্য সব সময়ই অ্যাভেইলেবল। দেশে এবং দেশের বাইরে স্টেজ শো করছি নিয়মিত। আমি নিজের মতো করে কাজ করতে পছন্দ করি। বাড়তি আড্ডা দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করি না।’

জেমস তাঁর ছেলেবেলার যে দুরন্তপনার কথা বলছিলেন, সে প্রসঙ্গে আমাদের প্রবল আগ্রহ। তাই প্রশ্ন করি, ‘আপনি তো গানে গানে বলেছেন, “মোরা শাসন মানি না, বারণ শুনি না, করি তাল-বাহানা, করি নানা ছলনা...”। আসলেই কি তেমনটা ছিলেন?’ জেমস স্মৃতিকাতর হলেন কি না, বোঝা গেল না, কেবল বলে গেলেন, ‘ছোটবেলা থেকে সাঁতারে ভীষণ ঝোঁক ছিল। বেশ ভালো সাঁতরাতেও পারতাম। দুরন্ত আমি বন্ধুদের নিয়ে আশপাশের পুকুরে সাঁতার কাটতাম। নওগাঁয় থাকতে ১০-১২ বছর বয়সে সাঁতার কাটতে চলে যেতাম নদীতে। বেশ কয়েকবার তো সাঁতরে মাঝনদীতেও চলে গিয়েছিলাম! এখন তো আর নদীতে সাঁতার কাটার সুযোগ নাই...।’

জেমসের নদীর কাছে যেতে না পারার কষ্ট কতটা প্রবল, সেটা আমরা উপলব্ধি করতে পারি না। তবে নদীর প্রসঙ্গ এসেছে তাঁর অনেক গানেই। যেমন দুখিনী দুঃখ করো না অ্যালবামে ছিল ‘তুমি যদি নদী হও, আমি হব জেগে থাকা চর...’ গানটি।

বাবা মোজাম্মেল হক ছিলেন সরকারি চাকুরে। সেই সূত্রে জেমসের প্রথম স্কুল ছিল সিলেটের ব্লু-বার্ড স্কুল। তারপর রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল। আর নীলফামারী ও সিরাজগঞ্জের কলেজজীবনে কেটেছে দারুণ কিছু সময়। কলেজজীবনের পর জেমসের মাথায় ঢোকে গানের পোকা। পরিবারের কেউ কখনো গানের সঙ্গে যুক্ত ছিল না। ফলে বড় ছেলে জেমসের গায়ক-জীবন চাননি বাবা মোজাম্মেল হক এবং মা জাহানারা খাতুন। আর তাই অভিমানী জেমসকে ঘর ছেড়ে পথে নামতে হয়। তাঁর গানের কথায়, ‘পথের বাপই বাপ রে মনা, পথের মা-ই মা...’। সেই পথ চলতে চলতে তাঁর ঠিকানা হয়ে যায় চট্টগ্রামের কদমতলীর পাঠানটুলি রোডে মতিয়ার পুলের সেই আজিজ বোর্ডিংয়ের ৩৬ নম্বর কক্ষটি। জেমস বলছিলেন, ‘আড্ডা আর গান যা-ই হোক না কেন সব ওখানেই। আজিজ বোর্ডিংয়ের দিনগুলো কখনো ভুলব না।’ এই কথাগুলোই জেমস বলেছেন ‘আজিজ বোর্ডিং’ গানটিতেও, ‘কত স্বপ্নের পায়রা ছুঁয়ে গেছে মন,/ শত স্মৃতির কিংখাবে,/ বন্দী সে দিন এখন।/ প্রিয় আজিজ বোর্ডিং, প্রিয় আজিজ বোর্ডিং...’।

দুই মেয়ে জান্নাত ও জাহানের সঙ্গে বাবা জেমস
দুই মেয়ে জান্নাত ও জাহানের সঙ্গে বাবা জেমস

আজিজ বোর্ডিংয়ে গানের কথা আর সুরের নেশায় ঘুমহীন অনেক রাত কেটেছে জেমসের। সেখানে ছিল তাঁর ‘ছোট্ট একটি ঘর, ছোট্ট একটি খাট,/ছোট্ট একটি টেবিল, একটি পানির জগ।/ছিল একচিলতে আকাশ আমার,/ আর সেই প্রিয় গিটার।’ তারকা হয়ে ওঠার পর অবশ্য আর কখনোই সেখানে যাওয়া হয়নি তাঁর। তবে যে কক্ষে থাকতেন, সেখানে এখনকার বাসিন্দারা ‘গুরু’র জন্মদিনে কেক কাটে প্রতিবছর। ‘আবারও কি সেখানে যেতে চান?’ জেমসের উত্তর, ‘কখনো সময়-সুযোগ হলে ঢুঁ মারলেও মারতে পারি।’

তারকা জেমসকে আজিজ বোর্ডিং কখনো পায়নি। পায়নি তাঁর মা-বাবাও। গানের জগতে জেমসের সাফল্যের পারদ ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার আগেই দুজনই চলে গেছেন পৃথিবী ছেড়ে। জেমস তাঁর ‘মা’ গানে বলেছেন, ‘সবাই বলে ওই আকাশে লুকিয়ে আছে, খুঁজে দেখো, পাবে দূর নক্ষত্র মাঝে...’।

জেমসের ছোট ভাই রুশো এখন নওগাঁতেই থাকেন। দেখাশোনা করেন পারিবারিক ব্যবসা। আর এখনকার পরিবার? আপনার সন্তানদের সম্পর্কে আমরা জানিই না বলা চলে। জেমস এ কথা শুনে স্বভাবসুলভ মাপা হাসি হেসে বললেন, ‘আমার গানের জীবনের বাইরে ব্যক্তিজীবনটা প্রকাশিত হোক, সেটা কখনো চাইনি।

এ কারণেই হয়তো আমার পারিবারিক জীবনটা সেভাবে খুব কাছের কেউ ছাড়া সবার জানার সুযোগ হয়নি। এটা আমি শুরু থেকেই করে এসেছি। আমার তিন সন্তান—সবার বড় ছেলে দানেশ, তারপর মেয়ে জান্নাত ও জাহান।’ জেমসের পরিবারের অগ্রজদের কেউ যেমন গানের জগতে নেই, অনুজদের মধ্যেও কেউ গানের সুরে জীবন বাঁধেনি।

অবসর কাটে কীভাবে আপনার? জেমস বললেন, ‘সবাই যে রকম করে, আমারও তেমন। টেলিভিশন দেখি। বই পড়ি। ছবি তোলার একটা নেশা আছে, যখন সময় পাই ছবি তুলি। এভাবেই কেটে যাচ্ছে।’

শৈশব–কৈশোরের জেমসের সঙ্গে বর্তমানের জেমসের মিল খুঁজে পাওয়া ভার। ছবি: কবির হোসেন
শৈশব–কৈশোরের জেমসের সঙ্গে বর্তমানের জেমসের মিল খুঁজে পাওয়া ভার। ছবি: কবির হোসেন

সিনেমার মধ্যে ক্ল্যাসিকগুলো বেশি দেখেন জেমস। সর্বশেষ দেখেছেন অ্যাল পাচিনো অভিনীত ড্যানি কলিনস সিনেমাটি। এর গল্পটা এক রকস্টারকে নিয়ে, তাই নাকি ভালো লেগেছে। জেমসের প্রিয় লেখক অনেকেই। তাঁদের মধ্যে সবার আগে আছে গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের নাম। এ ছাড়া নাগিব মাহফুজও প্রিয়।

ফেসবুকে জেমসের ফলোয়ারমাত্রই জানেন, আলোকচিত্রী হিসেবেও তিনি কম যান না। কয়েক বছর ধরে ছবি তুলে মাঝেমধ্যে ফেসবুকে পোস্ট করছেন। এই প্রতিভা কোথায় লুকিয়ে রেখেছিলেন? জেমসের মুখে হাসি, ‘ভিনদেশে শো করতে গেলে কিছু অবসর সময় থাকে। তখন সেটা কাজে লাগানোর জন্যই ছবি তোলা। ফটোগ্রাফারমাত্রই জানে, এটা অদ্ভুত একটা নেশা। একবার ফটোগ্রাফির পোকা ঢুকলে মাথা থেকে বের করা মুশকিল। ল্যান্ডস্কেপ আমাকে বেশি টানে। আবার যখন একটু অলস হয়ে গেলাম, তখন মডেলদের ছবি তুলতে শুরু করলাম। কারণ, এটা বাসায় বসে বসে করা যায়। লাইট-টাইট নিয়ে নাড়াচাড়া করা। লাইটের ভাষা শেখা আরকি।’

কক্সবাজারের কিছু ল্যান্ডস্কেপ ফটোগ্রাফি করেছেন জেমস। কিন্তু দেশে একটাই সমস্যা—ল্যান্ডস্কেপ তুলতে গেলেই ভক্তরা ভিড় করে। খ্যাতির বিড়ম্বনা যাকে বলে, ‘ফটোগ্রাফি এমন একটা বিষয় আপনাকে অবশ্যই ইনভিজিবল থাকতে হবে। আমি ছবি তুলতে গেলে বাংলাদেশে মানুষ জড়ো হয়ে যায়। তখন আর ছবি তোলা হয় না। ফটোগ্রাফার থাকবে একদম সবার অন্তরালে। তবে পিরোজপুরের নৌকায় ভাসমান পেয়ারার হাটের ছবি তুলতে চাই। এটা কীভাবে যে হবে তা নিয়ে ভাবছি। আর আমার তোলা এই ছবিগুলো নিয়ে একটা প্রদর্শনী হলেও হতে পারে।’

শখের কথা গেল, বন্ধুদের কথা কিছু শোনা যাক। জেমসের বন্ধু কারা? আপনি তো গানে গানে বলেছেন ‘তোমাদের মাঝে কি কেউ আছে বন্ধু আমার?’ জেমস জানালেন, স্কুল-কলেজের বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ আছে, ‘ইমতিয়াজ থাকে কানাডার টরন্টোতে। মিমি ঢাকার একটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করছে। দু-তিন বছর পরপর হঠাৎ হঠাৎ অনেক বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়। নীলফামারী কলেজের বন্ধুর মধ্যে ওয়াজেদ এখন চিকিৎসক, অস্ট্রেলিয়ায় থাকে। সবাই আসলে ব্যস্ত থাকে তো, তাই আগের মতো আর যোগাযোগ হয়ে ওঠে না।’

বাঁ থেকে প্রিন্স মাহ্‌মুদ, রবি চৌধুরী, আজম বাবু, জেমস, মনির খান, আইয়ুব বাচ্চু ও পলাশ। ছবি: সংগৃহীত
বাঁ থেকে প্রিন্স মাহ্‌মুদ, রবি চৌধুরী, আজম বাবু, জেমস, মনির খান, আইয়ুব বাচ্চু ও পলাশ। ছবি: সংগৃহীত

গানের জগতেও বেশ কজন ভালো বন্ধু আছে জেমসের। তাঁদের মধ্যে আইয়ুব বাচ্চু, হামিন আহমেদ, মাকসুদ ও পার্থ বড়ুয়া উল্লেখযোগ্য। তাঁরা কেন ভালো বন্ধু? জেমস বললেন, ‘আলাদাভাবে বলাটা মুশকিল। এটা বলতে পারি, আমাদের সবার শুরুটা হয়েছিল একসঙ্গেই। অনেক চড়াই-উতরাই ও ঘাত-প্রতিঘাতের সাক্ষী আমরা। সংগীতজীবনের শুরুতে অনেক দিন-রাত আমরা একসঙ্গে থেকেছি। প্রতিকূলতার মোকাবিলা করেছি। আবার একসঙ্গে সব পরিকল্পনা করেছি। এখনো বামবা নিয়ে যখন কোনো আলোচনা হয়, আমরা এক হই। আড্ডা দিই।’

আমাদের আড্ডার সময় অবশ্য ফুরিয়ে আসে। গান আর জীবন নিয়ে কিছু শুনতে চাই জেমসের কাছে। ‘প্রতিটা দিনই আমি আমার মতো করে উপভোগ করি।’ জেমস বলছিলেন, ‘কোনো লক্ষ্য ঠিক করে সামনে চলি না। আমি যে কাজটা করে আনন্দ পাই, সে কাজটা করি। আমার যদি আগ্রহ না থাকে, সে কাজ আমি কখনোই করি না। আমার জীবনের খুব সোজাসাপ্টা হিসেব। জীবনে অনেক ওঠানামা ছিল। গান গাইতে এসে কোনো লক্ষ্য স্থির করিনি। গান করছি, এটাই আমার আনন্দ, এটাই আমার প্যাশন। তারপর কী হয়েছে না হয়েছে এটা নিয়ে ভাবিনি। কিছু না হলেও গানই করতাম।’

জেমসের আরও কিছু

■ জেমসের পুরো নাম ফারুক মাহফুজ আনাম। জন্ম ১৯৬৪ সালের ২ অক্টোবর, নওগাঁয়।

■ জেমস নামটি রেখেছিলেন তাঁর বাবা ড. মোজাম্মেল হক, চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি। মা জাহানারা খাতুন ছিলেন গৃহিণী।

■ জেমসের প্রিয় খাবার ভাত, ডাল, গরুর মাংস, আইড় মাছ, পাবদাসহ দেশি সব মাছ। দেশের বাইরের মধ্যে কোরিয়ান ও জাপানিজ খাবার খুব ভালো লাগে। তবে রান্না করতে একেবারেই পারেন না।

■ নিয়মিত জিমে যান জেমস। ফিটনেস ধরে রাখতে সাধারণ ব্যায়ামগুলো নিয়ম মেনেই করেন।

■ বাংলাদেশের আনাচ-কানাচে যেমন চষে বেড়িয়েছেন, তেমনি গানের জন্য পৃথিবীর বহু দেশ, বহু শহর ঘুরেছেন জেমস। সবচেয়ে প্রিয় শহরের তালিকায় আছে ভারতের কলকাতা, যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক ও সুইজারল্যান্ডের জুরিখ। বলাবাহুল্য, সবচেয়ে প্রিয় বাংলাদেশ।

■ নির্জনতা খুব টানে তাঁকে। এ জন্য ঢাকা থেকে গাড়িপথে দু-তিন ঘণ্টার দূরত্বের কোনো নির্জন জায়গায় ভবিষ্যতে বসত গড়লেও গড়তে পারেন। কাজের জন্য ঢাকায় আসবেন, কাজ সেরে আবার চলে যাবেন।