অমানবিক শৃঙ্খল থেকে মুক্তি চান ব্রিটনি

ব্রিটনি স্পিয়ার্স
ইনস্টাগ্রাম

‘আমি হতভম্ব। আমি ট্রমাটাইজড। আমি অসুখী। আমি ঘুমাতে পারি না। আমি রেগে আছি। কারণ, এসব পাগলামি। আমি বিষণ্ন। আমি কাঁদছি, প্রতিদিন।’

এগুলো ব্রিটনি স্পিয়ার্সের কথা। তবে গানের নয়। নিজের জীবনের কথা। ১২ বছর আগে বিষণ্নতার ছোবলে পড়ে নিজের জীবনের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছিলেন ব্রিটনি। সাবালিকা হওয়ার পরও আদালত তাই ১২ বছরের জন্য বাবা জেমি স্পিয়ার্সকে তাঁর আইনি অভিভাবক নিযুক্ত করেন। কিন্তু দিনে দিনে সেই অভিভাবকত্ব শিকল হয়ে উঠেছে তাঁর জীবনে। তাঁর থেকে এখন মুক্তি চান ব্রিটনি। বাবার সঙ্গে আইনি লড়াইয়ে আদালতে গত বুধবার এ কথাগুলো বলেন ‘টক্সিক’খ্যাত শিল্পী।

গত বুধবার ছিল আইনি লড়াইয়ের শুনানি। ফোনে ব্রিটনি বিচারকদের কাছে নিজের ‘বন্দী জীবন’-এর কথা জানিয়েছেন। আইনি অভিভাবকত্বের ইতি চেয়ে বলেছেন, ‘আমার জীবন আমাকে ফিরিয়ে দাও।’

বাবার বিরুদ্ধে আগেও অভিযোগ এনেছিলেন পপ তারকা। বাবা নাকি অনুমতি ছাড়াই তাঁর টাকা নিয়ে নিজের ব্যবসা শুরু করেছেন। ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করে তাঁকে মানসিক রোগের ওষুধ খেতে বাধ্য করেছেন। এ অবস্থার পরিবর্তন চান স্পিয়ার্স। কীভাবে তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে মানসিক রোগের ওষুধ খাওয়ানো হতো এবং জোর করে চিকিৎসা দেওয়া হতো, আদালতে সব খুলে বলেন। এই জীবন থেকে মুক্তি চেয়েছেন আদালতে।

গত বুধবারের শুনানিতে ব্রিটনি স্পিয়ার্স ও তাঁর বাবা—দুই পক্ষই অংশ নেন।

শুনানিতে কী বললেন ব্রিটনি
এই পপ তারকার স্যাম আসগরির সঙ্গে প্রেম। তাঁকে বিয়ে করতে চান। কোলে ফুটফুটে সন্তান দেখতে চান। কিন্তু এই সবকিছুতেই বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে আইনি অভিভাবকত্ব। তাঁকে গর্ভনিরোধক ডিভাইস পরতে হয়েছে। আর যাতে সন্তান নিতে না পারেন। অভিভাবকেরা চান না, তিনি আর বাচ্চা নেন।

এই অমানবিক শৃঙ্খল থেকে মুক্তি চান ব্রিটনি। তিনি চান, তাঁর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত যেন তিনিই নিতে পারেন।

আদালতের বাইরে প্ল্যাকার্ড হাতে ব্রিটনি স্পিয়ার্সের ভক্তরা
এএফপি

ব্রিটনি ভেবেছিলেন, আদালতে তিনি খুব একটা পাত্তা পাবেন না। দীর্ঘদিন আদালতে যাননি ব্রিটনি স্পিয়ার্স। আদালত আইনি অভিভাবক হিসেবে তাঁর বাবাকেই রেখে দেন। এই পপ তারকা বলেন, আদালতে তাঁর বিপর্যস্ত জীবন তুলে ধরেন ব্রিটনি স্পিয়ার্স। সময় নিয়েছিলেন ২৩ মিনিট।

স্পিয়ার্স বলেন, ‘আগে আমি বিশ্বকে জানিয়েছিলাম, আমি ঠিক আছি, সুখী আছি। আসলে আমি মিথ্যা বলেছিলাম। আমার মনে হয়েছে, আমি মারা গেছি। যেন এটা কোনো বিষয়ই না। আমার সঙ্গে যেন কিছুই হয়নি। আপনারা ভাবতে পারেন, আমি মিথ্যা বলছি। আবার বলছি, আমি মিথ্যা বলছি না। আমি এখানে সবকিছু শোনাতে চাই। আবারও আমি সবকিছু বলতে চাই। যেন আপনারা বুঝতে পারেন, আমার সঙ্গে যা তারা করেছে, এর গভীরতা, ভয়াবহতা এবং ক্ষতির পরিমাণ।’

শুধু তা–ই নয়, স্পিয়ার্সের অভিযোগ, তাঁকে সপ্তাহে আট শিশি রক্ত দিতে হয়েছে। তাঁর সন্তান ও প্রেমিকের সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হয়নি। জোর করে দিনে ১০ ঘণ্টা কাজ করানো হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমার বাবা এবং আরও কেউ কেউ এই আইনি অভিভাবকত্বের সঙ্গে জড়িত। ম্যানেজমেন্টও আমাকে শায়েস্তা করার পেছনে ছিল।’
ব্রিটনি বিচারকের কাছে তাঁদের কারাগারে পাঠানোর আবেদন করেন। স্পিয়ার্স জানান, এসব কথা তিনি খোলাখুলি বলতে চাননি। কারণ, তিনি ভাবতে পারেননি কেউ তাঁকে বিশ্বাস করবেন।

ব্রিটনি স্পিয়ার্স
ইনস্টাগ্রাম

ব্রিটনির বাবা জেমি স্পিয়ার্সের আইনজীবী আদালতে জানান, এই পপশিল্পীর বাবা খুবই দুঃখিত যে তাঁর মেয়ের এত কষ্ট হয়েছে। মি. স্পিয়ার্স তাঁর মেয়েকে যথেষ্ট ভালোবাসেন।
কখন ও কবে থেকে সংকটের শুরু

আদালতের বাইরে প্ল্যাকার্ড হাতে ব্রিটনি স্পিয়ার্সের ভক্তরা
এএফপি

ব্রিটনির বয়স তখন ২৬ বছর। ব্যক্তিগত সম্পর্ক ও ক্যারিয়ারের ঝামেলায় প্রায়ই বিষণ্নতায় ভুগতেন ব্রিটনি। একপর্যায়ে অবস্থা এমন হয়েছিল যে তাঁকে হাসপাতালে পর্যন্ত ভর্তি হতে হয়েছিল। তখন এই আইনি অভিভাবকত্বের প্রসঙ্গ আসে। তাঁর বাবা জেমি স্পিয়ার্সকে আইনি অভিভাবকত্ব দেওয়া হয়। এই সূত্র ধরে জেমি তাঁর মেয়ের আর্থিক বিষয়গুলোও নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করেন।

২০০৮ সাল থেকে জেমি স্পিয়ার্স আইনি অভিভাবক ও তাঁর আইনজীবী অ্যান্ড্রু ওয়ালেটসহ অভিভাবক হিসেবে দায়িত্ব নেন। ২০১৯ সালে ওয়ালেট তাঁর দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেন। তবে জেমি স্পিয়ার্স এখনো সহ–আইনি অভিভাবক হিসেবে অটল। স্বাস্থ্যগত কারণে জেমি স্পিয়ার্স সাময়িক অব্যাহতি নেন। তখন এই দায়িত্ব পালন করেন জোডি মন্টগোমরি। ব্রিটনির ব্যবস্থাপক ছিলেন তিনি।

হ্যাশট্যাগ ফ্রি ব্রিটনি আন্দোলন করেন ভক্তরা
এএফপি

২০০২ সালের নভেম্বর মাসে বিচারক বিসেমার ট্রাস্টকে সহ–আইনি অভিভাবক হিসেবে নিয়োগ দেয়। কিন্তু তাঁর বাবা জেমি স্পিয়ার্সকেও সহ–আইনি অভিভাবক হিসেবে রেখে দেন। কিন্তু ব্রিটনি স্পিয়ার্স তাঁর বাবাকে সহ–আইনি অভিভাবক হিসেবে চান না। ২০২০ সালের আগস্টে তাঁর আইনজীবী আদালতে জেমি স্পিয়ার্সকে এই পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার আবেদন জানান। জোডি মন্টগোমরিকে স্থায়ী আইনি অভিভাবক হিসেবে চাওয়া হয়।

বাবার নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত করতে ব্রিটনি স্পিয়ার্সের ভক্তরা রাস্তায় নামেন।
এএফপি

পাশে দাঁড়িয়েছেন তারকারা
এ ঘটনায় পাশে দাঁড়িয়েছে বন্ধুরা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, গণমাধ্যমে আলোচনা হয়েছে। বাবার কবল থেকে বের করে আনতে ‘ফ্রিব্রিটনি’ আন্দোলন করেছেন ভক্তরা। নব্বই দশকে ব্রিটনি স্পিয়ার্স যখন ক্যারিয়ারের তুঙ্গে, তখন তাঁর প্রেমিক ছিলেন জাস্টিন টিম্বারলেক। এই দুর্দিনে পুরোনো প্রেমিকার পাশে দাঁড়িয়েছেন জাস্টিন। টুইটারে লিখেছেন, ‘আজ যা দেখলাম, এরপর আমাদের সবার উচিত ব্রিটনির পাশে দাঁড়ানো। আমাদের অতীত কী ছিল? ভালো কিংবা খারাপ। কত বছর আগে আমাদের সম্পর্ক ছিল। এগুলো কোনো বিষয় নয়। এই মুহূর্তে তাঁর সঙ্গে যা হচ্ছে, এটা একদমই ঠিক নয়।’

জাস্টিন টিম্বারলেক আরও বলেন, ‘কোনো নারী তাঁর নিজের শরীর নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে বাধাগ্রস্ত হবে, এটা হতে পারে না।’

এ ছাড়া আদালতের বাইরে হ্যাশট্যাগ ফ্রিব্রিটনি আন্দোলনে শরিক হন প্রায় শত ভক্তের একটি দল। তাঁদের হাতে ছিল ‘ফ্রি ব্রিটনি নাউ’ এবং ‘গেট আউট অব ব্রিটনিজ লাইফ’ লেখা প্ল্যাকার্ড।

ব্রিটনি স্পিয়ার্সের এক ভক্ত
এএফপি

আদলতে বিচারক ব্রিটনির কথা শুনে তাঁকে ‘সাহসী’ হিসেবে মন্তব্য করেছেন। আদালতের বাইরে ব্রিটনির একজন ভক্তের সঙ্গে কথা বলেন আল–জাজিরার এক সাংবাদিক। জেনিফার প্রিস্টন নামের ৩৩ বছর বয়স্ক ওই নারী বলেন, ‘আমি একজন মা এবং আমি তাঁর একজন ভক্ত। আমরা তাঁর বক্তব্য শুনতে এসেছি। ১৩ বছর ধরে তাঁর সঙ্গে একজন শিশুর মতো ব্যবহার করা হয়েছে। তাঁর জীবন ও আর্থিক দিকের কোনো নিয়ন্ত্রণ তাঁর কাছে ছিল না। অথচ তিনি এগুলোর জন্য যথেষ্ট যোগ্য ছিলেন।’
সূত্র: এবিসি নিউজ, আল–জাজিরা