আয় বন্ধ, বেকায়দায় থিয়েটারের নেপথ্যের কলাকুশলীরা

মঞ্চানাটকের স্বল্প আয়ের লোকগুলো এখন বেকায়দায় পড়েছেন।
বাংলাদেশ থিয়েটার আর্কাইভস

‘রামপুরা থাকতাম একটা ফ্ল্যাট নিয়া। অফিসের ভাড়া ১০ হাজার টাকা, বাসা ১৫ হাজার টাকা দিতাম। শেষমেশ অফিস ও বাসা ছাইড়া দিছি। অফিসের ভাড়া, বাসার ভাড়া, কর্মচারীর বেতন—এত টাকা পামু কই? কর্মচারীগুলারে বাড়ি পাডাইয়া দিছি। আমিও ফ্যামিলি নিয়া নিজে বাড়িত চইলা আইছি।’
মঞ্চনাটকে আলো সরবরাহের কাজ করেন আবদুল মালেক। ১৯৮৮ সাল থেকে এ পেশার সঙ্গে জড়িত তিনি। করোনার এই সময়ে তাঁর অবস্থা জানতে চাইলে আক্ষেপ নিয়ে এই কথাগুলোই বললেন তিনি। ‘মালেক লাইট হাউস’ নামে ছোট একটি প্রতিষ্ঠান আছে তাঁর। বাংলাদেশের রাজধানীকেন্দ্রিক মঞ্চনাটকগুলোতে আলো সরবরাহ করে প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু করোনা সংক্রমণ ও লকডাউনের কারণে বন্ধ মঞ্চনাটকের প্রদর্শনী।

আয়–রোজগারের একমাত্র উপায়টি বন্ধ হওয়ায় বেকায়দায় পড়েছেন আবদুল মালেক। তিনি জানান, গত লকডাউনেই বন্ধ হওয়ার জোগাড় হয় তাঁর প্রতিষ্ঠান। এরপর মুজিব বর্ষের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কাজ করে সেটি পুষিয়ে নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পরে আবার লকডাউন দেওয়ায় বন্ধ করে দিতে হয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। মালেকের আশা, আবার কাজ করতে পারবেন তিনি। বললেন, ‘আমার মতো যারা মঞ্চনাটকের লাইট, সেট, সাউন্ডের কাম করে; সবাই সমস্যায় আছে। আমি আশা করি, সবকিছু খুললেই আবার কাম কইরা খাইতে পারুম।’

‘আমার মতো যারা মঞ্চনাটকের লাইট, সেট, সাউন্ডের কাম করে; সবাই সমস্যায় আছে। আমি আশা করি, সবকিছু খুললেই আবার কাম কইরা খাইতে পারুম।’
আব্দুল মালেক, লাইট সরবরাহকারী

সবুজ ইলেকট্রিক হাউসের সবুজ ভূঁইয়া দু-তিনজন কর্মচারীকে বাদ দিয়ে দিয়েছেন। বাকিদের নিয়ে কোনোমতে চলছেন। তিনিও পরিবার নিয়ে চলে গেছেন গ্রামের বাড়িতে। উপার্জন আপাতত বন্ধ। সবুজ বলেন, ‘আমি আছি এখন গাজীপুরের পুবাইলে। করোনা আসার পর থেকে একটা বছর ধরে আমার কর্মচারীদের পালি, নিজেরও সংসার আছে। অফিস ভাড়া বাকি পড়ে আছে কয়েক মাস। বাড়িওয়ালাকে জানিয়ে দিয়েছি, সময় ভালো হলে দেব। কর্মচারীদের পেছনে ৬০ থেকে ৬৫ হাজার টাকা খরচ যায়। নিজের জমানো টাকা থেকে দিচ্ছি এসব।’

বেশির ভাগই চলে গেছেন গ্রামের বাড়িতে। অপেক্ষায় আছেন কবে লকডাউন উঠবে, আবার কবে মঞ্চে আলো জ্বলবে।
বাংলাদেশ থিয়েটার আর্কাইভস

মঞ্চনাটক–সংশ্লিষ্ট রূপসজ্জা, মঞ্চ নির্মাণ, আলো ও শব্দ সরবরাহ, বাদ্যযন্ত্র বাদন, পর্দা সরবরাহসহ অন্যান্য পেশায় নিযুক্ত কলাকুশলীদের উপার্জনের মাধ্যমটি বন্ধ। স্বল্প আয়ের এই লোকগুলো এখন বেকায়দায় পড়েছেন। বেশির ভাগই চলে গেছেন গ্রামের বাড়িতে। অপেক্ষায় আছেন কবে লকডাউন উঠবে, আবার কবে মঞ্চে আলো জ্বলবে।
জানা গেছে, এই কলাকুশলীদের ইতিমধ্যে বিভিন্ন নাট্যদল ও নাট্যবিষয়ক পত্রিকা থেকে এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন গ্রুপভিত্তিক আর্থিক সহযোগিতা করা হয়েছে।

রূপসজ্জাশিল্পীদেরও উপার্জন বন্ধ
বাংলাদেশ থিয়েটার আর্কাইভস

বটতলা নাট্যদলের সৃজনশীল পরিচালক আলী হায়দার বলেন, ‘এই মানুষগুলো খুব বেশি নন। যেসব দলের সঙ্গে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের দিকে যদি একটু হাত বাড়িয়ে দেওয়া যায়, তাহলেই হয়। এর আগে থিয়েটার স্বজন নামে তাঁদের সহযোগিতার একটা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। সেখান থেকে সহযোগিতা করা হচ্ছে।’
গত বছর লকডাউনের সময় পর্দার পেছনের কলাকুশলীসহ এই সময়ে সমস্যায় থাকা থিয়েটার ও সংস্কৃতিকর্মীদের পাশে দাঁড়ানো হয় ‘থিয়েটার স্বজন’ নামে একটি উদ্যোগের মাধ্যমে। সেখানে বিভিন্ন নাট্যদলের থিয়েটার কর্মী ও দলপ্রধানেরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। প্রবাসী নাট্যকর্মীরাও সহযোগিতা করতে এগিয়ে আসেন।

থিয়েটার স্বজনের দায়িত্বশীল (অর্থ সংগ্রহ ও বিতরণ) লোক নাট্যদল বনানীর সাধারণ সম্পাদক কামরুন নূর চৌধুরী প্রথম আলোকে জানান, এ উদ্যোগে ছয় দফায় মোট ১১ লাখ ৯২ হাজার ৬১০ টাকা সহযোগিতা দেওয়া হয়। গত বছরের জুলাইয়ে প্রথম দফায় দলীয় কর্মী ও নেপথ্য কর্মী মিলে ১১৩ জনকে সহযোগিতা করা হয়। এভাবে ছয় দফায় সহযোগিতা দেওয়া হয় এবং ষষ্ঠ দফায় ঈদের আগে এ বছরের মে মাসে ৫১ জনকে সহযোগিতা করা হয়। তিনি বলেন, ‘যাঁরা আমাদের মঞ্চে ওঠার আগে মেকআপ করে দেন, মঞ্চে আলো ফেলেন, সেট তৈরি করে দেন; তাঁরা আমাদের থিয়েটারেরই প্রধান অংশ। এই সময়ে তাঁদের পাশে দাঁড়ানো উচিত।’ তিনি আক্ষেপ করেছেন, অনেক বড় সংগঠনের আরও বেশি জোরালো ভূমিকা রাখা উচিত ছিল এই কলাকুশলীদের সহযোগিতা করতে।

এ উদ্যোগে ছয় দফায় মোট ১১ লাখ ৯২ হাজার ৬১০ টাকা সহযোগিতা দেওয়া হয়। গত বছরের জুলাইয়ে প্রথম দফায় দলীয় কর্মী ও নেপথ্য কর্মী মিলে ১১৩ জনকে সহযোগিতা করা হয়। এভাবে ছয় দফায় সহযোগিতা দেওয়া হয় এবং ষষ্ঠ দফায় ঈদের আগে এ বছরের মে মাসে ৫১ জনকে সহযোগিতা করা হয়।
থিয়েটারকর্মীর সহযোগিতায় থিয়েটার কর্মীরাই এগিয়ে এসেছেন।
বাংলাদেশ থিয়েটার আর্কাইভস

বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন মঞ্চনাটকের সবচেয়ে বড় সংগঠন। এই সময়ে এই কলাকুশলীদের নিয়ে তারা কী ভাবছে? ফেডারেশনের মহাসচিব কামাল বায়েজীদ বলেন, ‘যাঁরা ব্যাকস্টেজে কাজ করেন কিংবা এই সময়ে আর্থিকভাবে সমস্যায় আছেন, তাঁদের গত বছর যে সহযোগিতা করেছিল, এবারও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় সে রকম সহযোগিতা করার জন্য নীতিগতভাবে রাজি হয়েছে। ঢাকায় শিগগিরই শুরু হবে। ঢাকাসহ বাইরের যাঁরা সমস্যায় আছেন, তাঁদেরও সহযোগিতা করা হবে ফেডারেশন থেকে।’
করোনা সংক্রমণে সব অঙ্গনের মতো সংস্কৃতি অঙ্গনও স্থবির। তবে থিয়েটারের কর্মীরা বসে নেই। তাঁরা একে অপরের পাশে দাঁড়িয়েছেন, দাঁড়াচ্ছেন। থিয়েটারকর্মীর সহযোগিতায় থিয়েটার কর্মীরাই এগিয়ে এসেছেন।