শিল্পকলা একাডেমিতে চলছে গঙ্গা যমুনা সাংস্কৃতিক উৎসব। পেরিয়ে গেছে ছয়টি দিন। দেখা গেছে তেরোটি নাটক। ছিল নৃত্য, আবৃত্তি, গানের পরিবেশনা। এর মধ্যে গেল মঙ্গলবার ৯ অক্টোবর ছিল লোকনাট্য দলের (বনানী) নতুন নাটক ঠিকানার উদ্বোধনী মঞ্চায়ন। উৎসবে এখন পর্যন্ত নতুন নাটকের প্রাপ্তিতে এটি। কাজে ঠিকানা নাটকটিকে এখন পর্যন্ত এবারের উৎসবে গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন বললে অত্যুক্তি হবে না। বিস্তারিত লিখেছেন মাসুম আলী।
উৎসবে মেলা আয়োজন। হরেক রকম সাজসজ্জা। অনেক নাটকের পোস্টার, লিফলেট। সবকিছুর ভিড়ে ঠিকানা নাটকের পোস্টারটি চোখে পড়ে, ঠিক ওপরেই জলপাই রঙের একটি হেলমেট। মাঝে রক্তলাল হাত। নিচে মুষ্টিবদ্ধ তিনটি হাত। বুঝতে বাকি রইল না, মঙ্গলবার সন্ধ্যায় শিল্পকলা একাডেমির পরীক্ষণ থিয়েটারে যে নাটকটি মঞ্চস্থ হচ্ছে, তার সঙ্গে যুদ্ধ, আন্দোলন, অধিকার আদায়—এসব জড়িত। পোস্টারের একটি বাক্যেও বিষয়বস্তু আরও পরিষ্কার, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় রচিত বাঙালির আত্মত্যাগের উপাখ্যান’।
আগেই বলে নিই, লোক নাট্যদলের (বনানী) ২৮তম প্রযোজনা হিসেবে মঞ্চে এসেছে ঠিকানা। ঢাকার মঞ্চে প্রথম হলেও ঠিকানার আছে গৌরবময় ইতিহাস। এটি লিখেছেন বাংলা মঞ্চনাটকের অন্যতম প্রবাদ পুরুষ প্রখ্যাত নাট্যকার, অভিনেতা ও নির্দেশক উৎপল দত্ত। তিনি নাটকটি লিখেছেন ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এবং মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেই ২ আগস্ট ১৯৭১ সালে কলকাতায় নাটকটি মঞ্চস্থ হয়। নতুন করে নাটকটির নির্দেশনা দিয়েছেন লোক নাট্যদলের (বনানী) জ্যেষ্ঠ সদস্য প্রণবানন্দ চক্রবর্তী। তিনি ভারতের পুনে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নাট্যশাস্ত্রে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন।
মাত্র দুই দিনের ঘটনা নিয়ে নাটক। একটি ছোট শহর তারাগঞ্জ, মূলত শিল্পাঞ্চল। সেখানেও দাপিয়ে বেড়াচ্ছে পাকিস্তানি হানাদার সৈন্যরা। তারাগঞ্জে একটি ছোট রেস্টুরেন্ট চালান একসময়ের কারখানা শ্রমিক বৃদ্ধা রশিদা খাতুন। তাঁকে সবাই ‘নানি’ বলে ডাকে। রশিদা খাতুনের ‘সুতৃপ্তি রেস্টুরেন্ট’–এ নিয়মিত খেতে আসে শ্রমিক–মালিক, ধনী-গরিব নির্বিশেষে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। রশিদা খাতুনের হাতে বানানো লুচি-সবজি আর চা খেতে বেশ লাগে। তবে ২৫ মার্চের পর থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হামলা আর নিয়মিত টহলের কারণে লোকজন আগের মতো রেস্টুরেন্টে খেতে আসে না। এই রশিদার সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে শিল্পাঞ্চলের গেরিলাদের। তিনি রেস্টুরেন্ট খোলা রেখে মূলত তার আড়ালে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য তথ্য আদান-প্রদানে সহযোগিতা করেন। শ্রমিকনেতা মকবুলের (মিনহাজুল হুদা) তথ্য অনুযায়ী, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর জন্য গোলাবারুদ ভর্তি একটি ট্রেন এসেছে তারাগঞ্জ স্টেশনে, যাবে জামালপুর। তারাগঞ্জের গেরিলারা এ ট্রেনটি উড়িয়ে দিতে চায় বোমা মেরে। সে জন্য চাই ডিনামাইট, যা পাওয়া যাবে মির্জাপুরের একটি ঠিকানায়। সেই ঠিকানাটি রশিদার কাছে আসবে লোক মারফত সাংকেতিকভাবে, যা গেরিলারা সংগ্রহ করবে। গল্পের নাটকীয়তা এখানে শুরু হয়।
এক সন্ধ্যায় রেস্টুরেন্টে তখন খাচ্ছিলেন শিল্পপতি সাহাবুদ্দিন চৌধুরী (আবদুল্লাহ আল হারুন), সঙ্গে তাঁর বন্ধু মনস্তত্ত্ববিদ ডাক্তার আনিসুজ্জামান (ইউজিন গোমেজ)। আর ছিলেন যাত্রাশিল্পী যামিনী সেন (হাফিজুর রহমান) ও তার বন্ধু ব্যাংকের কেরানি হাশমৎ আলী (সাদেক ইসলাম)। হঠাৎ করে চা খাওয়ার জন্য রেস্টুরেন্টে ঢোকে টহলরত একদল সেনা, যার মধ্যে রয়েছে লেফটেন্যান্ট বোখারি (মোজাক্কির আলম)। অতিরিক্ত মদ্যপানের ফলে সে অনবরত বমি করছিল আর তার পাঞ্জাবি সহকর্মীদের গালাগাল করছিল, মাঝেমধ্যে কাঁদছিলও। সে হঠাৎ প্রস্রাব করতে চাইলে রশিদা খাতুন তাকে দোকানের পেছনে নদীর পাড়ে দিয়ে আসেন। কিন্তু আর ফিরে আসে না বোখারি, তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। খবর দেওয়া হয় পাকিস্তানি কমান্ডার কর্নেল ওয়ালীউল্লাহকে। গ্রেপ্তার করে সেনা ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয় রেস্টুরেন্টে উপস্থিত চারজন ক্রেতা আর রশিদা খাতুনকে। তাঁদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সদস্য বোখারিকে হত্যার অভিযোগ আনা হয়, চলে জেরা আর টর্চার। ঘোষণা প্রচার করা হয়, বোখারির হত্যাকারী আত্মসমর্পণ না করলে বা হত্যাকারীকে এলাকাবাসী ধরিয়ে না দিলে পাঁচজন বন্দীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে, ফায়ারিং স্কোয়াডে গুলি করে।
নাটকের শেষ দিনটি ২৫ এপ্রিল ১৯৭১ ভোর ছয়টায় পাঁচজনকে একে একে গুলি করে হত্যা করে পািকস্তানি হানাদার বাহিনী। সবশেষে যে মুহূর্তে হত্যা করে রশিদা খাতুনকে, ঠিক সেই মুহূর্তে স্টেশনে গোলাবারুদভর্তি ট্রেনটিতে বিস্ফোরণ ঘটায় গেরিলারা। বিস্ফোরণের শব্দে চারদিক কেঁপে ওঠে, কেঁপে ওঠে পাকিস্তানি সেনাদের অন্তরাত্মা। গুলি খেয়ে মৃত্যুর আগে বিস্ফোরণের শব্দ শুনে যেতে পেরে পরম তৃপ্তিতে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে রশিদা খাতুনের মুখ, ‘জয় বাংলা’ বলে শরীরে লুকিয়ে রাখা বাংলাদেশের মানচিত্র আঁকা পতাকাটি তুলে ধরেন তিনি। এমন দৃশ্য দেখে রীতিমতো গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেল! সত্যিকারে বীর রশিদা খাতুন, নানি (সামসাদ বেগম)।
১ ঘণ্টা ৪৫ মিনিটের নাটক। ২২টি দৃশ্যে মোট দেখা গেছে আটটি সেট। তবে নাটকের ছয় ধরনের দৃশ্য দেখে মনে হয়েছে দৃশ্যগুলো মঞ্চে প্রদর্শন এবং পরিবর্তন করতে নির্দেশক যথেষ্ট অনুশীলন ও কৌশল অবলম্বন করেছেন। যেমন নির্জন পথ, সুতৃপ্তি রেস্টুরেন্ট, মিলিটারি সদর দপ্তর, সেল, ছাদহীন বিধ্বস্ত স্কুল, রেলস্টেশন, ফায়ারিং স্কোয়াড।
হুট করে নতুন নাটক ঠিকানা মঞ্চে চলে এসেছে তা নয়। নির্দেশক প্রণবানন্দ চক্রবর্তী বলেন, নাটকটি মঞ্চে আনা হলো মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে। আমরা মঞ্চায়নযোগ্য মুক্তিযুদ্ধের নাটক যুক্ত করার পরিকল্পনা করছিলাম বেশ কয়েক বছর আগেই। সেই প্রত্যাশায় ঠিকানা নাটকটি লোক নাট্যদলের জন্য মঞ্চায়নযোগ্য কি না, এ ধারাবাহিকতায় নাটকটির পাঠ চলছিল। পাঠ শেষে মনে করা হলো সেটের বাহুল্য না দেখিয়েও নাটকটি বেশ সহজেই দর্শকদের সামনে তুলে ধরা যাবে, সাধারণ দর্শকদেরও বুঝতে অসুবিধা হবে না। তা ছাড়া উৎপল দত্ত প্রতিটি দৃশ্যে যেভাবে বন্ধনীতে নির্দেশনা দিয়েছেন, তাতে আর বাড়তি নির্দেশনাও প্রয়োজন হয় না। যথাযথভাবে বন্ধনীর নির্দেশনাগুলো অনুসরণ করেই নাটকটি দাঁড়িয়ে গেছে।
আজ বৃহস্পতিবার গঙ্গা যমুনা সাংস্কৃতিক উৎসবের সপ্তম দিন। আজ জাতীয় নাট্যশালার মূল মঞ্চে আছে নাগরিক নাট্যাঙ্গনের ক্রীতদাসের হাসি, পরীক্ষণ থিয়েটারে বিবর্তন যশোরের মাত্বব্রিং এবং স্টুডিও থিয়েটারে মৈত্রী থিয়েটারের কেনারাম বেচারাম। ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত চলবে এ উৎসব। সময় সুযোগ মিললে দেখে আসতে পারেন।