একজন শিবলী সাদিকের উত্থান
>শিবলী সাদিক নামটি মনে করিয়ে দেয় একজন সফল নির্মাতার কথা। অসংখ্য জনপ্রিয় ছবির এই কারিগর প্রথম দিকে অভিনেতা হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। কিন্তু একসময় চলচ্চিত্র নির্মাণই হয়ে ওঠে তাঁর প্রাণের জায়গা। তিন দশকের চলচ্চিত্রজীবনে নির্মাণ করেছেন দুই ডজন সফল ছবি। শিবলী সাদিকের অজানা অনেক কথা নিয়ে আজকের প্রতিবেদন। লিখেছেন মনজুরুল আলম।

বেড়ে ওঠা
শিবলী সাদিক ১৯৪১ সালে ব্রিটিশ ভারতের নওগাঁয় জন্মগ্রহণ করেন। শিবলী সাদিকের বাবা ছিলেন জেলা খাদ্য পরিদর্শক। বাবার বদলির কারণে ছোটবেলা থেকেই ব্রিটিশ ভারতের বিভিন্ন স্থানে থাকার সুযোগ হয় তাঁর। তখন থেকেই পদ্মা–যমুনা নদীর পাড়, বিস্তীর্ণ গ্রাম, রাখালের গান, সাধারণ মানুষের জীবন তাঁকে খুব টানত। ১৯৫৫ সালে বাবার চাকরির সূত্রে ঢাকায় আসেন শিবলী সাদিক। ১৯৫৮ সালে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায়।
অভিনেতা হতে সিনেমাপাড়ায়
দেখতে বেশ সুদর্শনই ছিলেন। চারুকলার বারান্দায় সিনিয়র–জুনিয়ররা, বিভাগের বন্ধুরা তাঁকে ডাকতেন ‘স্টাইলিশ বয় সাদিক’ নামে। একসময় সহকর্মীরা ‘হিরো’ নামেও ডাকতে শুরু করেন। এসব শুনে শুনে আঁকিবুকির পাশাপাশি শিবলী সাদিকের নায়ক হওয়ার ইচ্ছা জাগে। তখন নতুন নতুন যাত্রা শুরু করা এফডিসি (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশন, বর্তমান বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশন) থেকে তরুণ সেট ডিজাইনার খোঁজা হচ্ছিল। শিবলী সাদিক সেট ডিজাইনার হয়েই ঢোকেন এফডিসিতে। এরপর তাঁর পরিচয় হয় বরেণ্য নির্মাতা সুভাষ দত্ত ও মুস্তাফিজুর রহমানের সঙ্গে। তখন তিনি স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। চারুকলার ছাত্র শুনে নির্মাতা মুস্তাফিজ তাঁকে সেট ডিজাইনার ও শিল্প নির্দেশক হিসেবে কাজের প্রস্তাব দেন। তখন থেকেই সিনেমার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন শিবলী সাদিক। পরে বিজ্ঞাপনের ডিজাইনার হিসেবেও বেশ কিছুদিন কাজ করেন।
অভিনেতা নাকি নির্মাতা
ক্যামেরার পেছনে কাজ করতে গিয়ে বুঝতে পারেন, সিনেমা নির্মাণই তাঁকে বেশি টানে। প্রথমে ১৯৬৩ সালে মুস্তাফিজুর রহমানের সহকারী পরিচালক হিসেবে তালাশ ছবিতে কাজ করেন। ছবিটির শুটিং করার সময় আরেক সহকারী পরিচালক আজিজুর রহমান এবং ছবির ছোট একটি চরিত্রে অভিনয় করা সুভাষ দত্তের সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরি হয়। পরের বছর ১৯৬৪ সালে সুভাষ দত্তের সুতরাং এবং ১৯৬৬ সালে কাগজের নৌকা ছবিতেও সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করেন শিবলী সাদিক। পরে একই নির্মাতার আলিঙ্গন (১৯৬৯) ও অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী (১৯৭২) ছবিতে প্রধান সহকারী পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। চারুকলা থেকে পড়াশোনা শেষ করে সৈয়দ আওয়ালের সঙ্গে যৌথভাবে শিবলী সাদিক নির্মাণ করেন তাঁর প্রথম সিনেমা বালা। যদিও ছবিটি সেভাবে সাফল্য পায়নি। এই নির্মাতার ভাই ফারুক রোমান হায়দার জানান, নির্মাতা হিসেবে শিবলী সাদিকের প্রথম নির্মাণ ছিল বসতবাড়ি নামের তথ্যচিত্র।

বাঘা নির্মাতাদের ভিড়ে
মুক্তিযুদ্ধের পর শিবলী সাদিক যখন পুরোদমে চলচ্চিত্র নির্মাণে আসেন, তখন প্রযোজক পেতে হিমশিম খেতে হয় তাঁকে। সে সময় শিবলী সাদিককে প্রযোজক পেতে এহতেশাম, সুভাষ দত্ত, চাষী নজরুল ইসলাম, নারায়ণ ঘোষ মিতা, কাজী জহির, আলমগীর কুমকুম, আজিজুর রহমান, অশোক ঘোষদের মতো বরেণ্য নির্মাতাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হয়েছে। অবশেষে বাধা পেরিয়ে ১৯৭৪ সালে শিবলী সাদিক নির্মাণ করেন তারকাবহুল ছবি জীবন নিয়ে জুয়া। এতে অভিনয় করেছিলেন ববিতা, বুলবুল আহমেদ, মিনু রহমান, বেবি জামান, খলিলুর রহমান প্রমুখ। ছবির চিত্রনাট্য লিখেছিলেন আবদুল্লাহ আল–মামুন। ১৯৭৫ সালে ছবিটি মুক্তি পায় এবং প্রশংসিত হয়। এরপর শিবলী সাদিককে আর প্রযোজক খুঁজতে হয়নি।
শিবলী সাদিক মানেই ছবি হিট
প্রথম ছবির সাফল্যের পর শিবলী সাদিক নির্মাণ করেন নোলক। ‘ওকি গাড়িয়াল ভাই’ গানটি মনে আছে? ফেরদৌসী রহমানের গাওয়া এই গান সারা দেশের মানুষের মুখে মুখে ছিল। ছবিটি ভালো ব্যবসাও করে। ‘সাদিক ভাই মানেই হিট ছবি’—প্রযোজক মহলে ছড়িয়ে পড়ে এমন কথা। শিবলী সাদিকের স্ত্রী জানান, ‘অনেক প্রযোজক বাসায় আসতেন, অফিসে যেতেন। উনাকে (শিবলী সাদিক) দিয়ে ছবি বানাতে চাইতেন। কিন্তু ছবির গল্পে ব্যবসার উপকরণ আছে কি না, এটি মানসম্পন্ন সামাজিক গল্প কি না, গল্পের সঙ্গে চরিত্র মানানসই কি না—এসব ব্যাপারে না জেনে উনি কখনোই শুটিংয়ে যেতেন না। এমনও হয়েছে, চিত্রনাট্য লেখার পর পছন্দ না হলে কাজ করেন নাই।’
সুপারহিট ছবি
শিবলী সাদিকের তিন কন্যা, ভেজা চোখ, নীতিবান, দুর্নাম, ত্যাগ, মায়ের অধিকার, অন্তরে অন্তরে, আনন্দ অশ্রু—সব ছবিই সুপারহিট। কিছু কিছু ছবির আবেদন তো এখনো আছে আগের মতো। তাঁর পরিচালিত ছবি ভেজা চোখ টানা পাঁচ মাস দেশের প্রায় ২০০ সিনেমা হলে একসঙ্গে চলেছে।
উপহার দিয়েছেন যাঁদের
১৯৭৮ সালে মুক্তি পায় নোলক। এই ছবির বেশির ভাগ শিল্পীই ছিলেন নতুন। ফরহাদ, ফয়সল, মিন্না খান, পরে তাঁরা বেশ কটি সিনেমায় অভিনয় করেন। তিন কন্যা ছবির মধ্য দিয়ে শিবলী সাদিক তুলে ধরেন অভিনেত্রী চম্পাকে।
ছিলেন ভোজনরসিক
শিবলী সাদিকের বেশির ভাগ ছবির সংগীত পরিচালক আলম খান। তিনি বলেন, ‘সাদিক ভাই ছিলেন সাদা মনের মানুষ। সারাক্ষণ হাস্যরসে মাতিয়ে রাখতেন। ছিলেন ভোজনরসিক। খাওয়ার সময় বলতেন, সবজি খাও কবজি ডুবিয়ে, পায়েস খাও আয়েশ করে। এ রকম অনেক মজার কথা বলতেন আর খেতেন। নিজের রাগ, অভিমান কখনো অন্যকে বুঝতে দেননি।’
দেখিস, সালমান শাহ অনেক বড় হবে
শিবলী সাদিকের হাত ধরেই চলচ্চিত্রে নিয়মিত হয়েছিলেন নির্মাতা সোহানুর রহমান সোহান। ১৯৯৩ সালে সোহানুর রহমান সোহান নবাগত সালমান শাহ ও মৌসুমীকে নিয়ে নির্মাণ করেন কেয়ামত থেকে কেয়ামত সিনেমা। ওই সময় সালমানের অভিনয় দেখে বেশ প্রশংসা করেন শিবলী সাদিক। সালমান শাহকে নিয়ে বাবার বলা কথাগুলো এখনো শিবলী সাদিকের ছেলে মইন সাদিক মনে রেখেছেন। মইন বলেন, ‘বাবা সালমান শাহর অভিনয় খুবই পছন্দ করেছিলেন। বাসায় একাধিকবার বলেছেন, “দেখিস, সালমান শাহ ছেলেটা অনেক বড় হবে। ওকে একবার বললে দ্বিতীয়বার আর কিছু বলে দিতে হয় না।”’ ১৯৯৪ সালে সালমান শাহকে নিয়ে শিবলী সাদিক নির্মাণ করেন অন্তরে অন্তরে, ১৯৯৬ সালে মায়ের অধিকার ও ১৯৯৭ সালে আনন্দ অশ্রু। তিনটি ছবিই কালজয়ী।
ছবির গান মুখে মুখে ফিরত
শিবলী সাদিক ২২টি সিনেমা নির্মাণ করেছেন। প্রথম দুটি ছবি মোটামুটি ব্যবসা করলেও পরের সব কটি ছিল সুপারহিট। তাঁর প্রতিটি ছবির গানই দারুণ জনপ্রিয়তা পেত। ‘জীবনের গল্প আছে বাকি গল্প অল্প’, ‘তুমি আমার কত চেনা’, ‘কাল তো ছিলাম ভালো’, ‘ভালবাসিয়া গেলাম ফাঁসিয়া’, ‘পিঁপড়ায় খাবে বড় লোকের ধন’, ‘তুমি আমার এমনই একজন’, ‘তুমি মোর জীবনের ভাবনা’, ‘তেল গেলে ফুরাইয়া বাত্তি যায় নিভিয়া’—এসব গানই শিবলী সাদিক পরিচালিত সিনেমার গান।
পরিবারের চোখে শিবলী সাদিক
পুরো নাম শিবলী সাদিক হায়দার। তাঁর স্ত্রী আজমেরী সাদিক উত্তরার ৫ নম্বর সেক্টরের বাসায় এখনো স্বামীর সব পুরস্কার যত্নে রেখেছেন। ছেলে মইন শিবলী ও মেয়ে আনিতা এখনো বিভিন্ন জায়গায় বাবার পরিচয় দিলে সবাই নাকি বেশ আপন করে নেয়, জানায় সম্মান। শিবলী সাদিক পরপর দুবার পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। স্ত্রী আজমেরী সাদিক বলেন, ‘সারা জীবন যে মানুষটা ছবির জন্য এত কিছু করেছে। ফিল্মের মানুষকে খুব আপন ভেবেছে। যে মানুষটা দুবার পরিচালক সমিতির সভাপতি ছিলেন, দুইবার মহাসচিব ছিলেন, সততার সঙ্গে চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডের প্রধানের দায়িত্ব পালন করেছেন, এই মানুষটাকে এখন কেউ স্মরণ করে না কেন?’