এফডিসিতে কষ্টে আছেন পার্শ্বচরিত্রের শিল্পীরা

এফডিসিতে কাজের অপেক্ষায় পার্শ্বচরিত্রের শিল্পী বিনা। ছবি: মানসুরা হোসাইন
এফডিসিতে কাজের অপেক্ষায় পার্শ্বচরিত্রের শিল্পী বিনা। ছবি: মানসুরা হোসাইন

দুপুরের নির্জনতার মতোই এফডিসিতে নীরবতা নেমেছে। কোনো শুটিং নেই। নায়ক নায়িকার উপস্থিতি নেই। শুটিং এর বিভিন্ন ফ্লোরগুলো তালা মারা। কোনো কোনোটি চলচ্চিত্রের বাইরের প্রতিষ্ঠানের কাছে ভাড়া দেওয়া। একটি ফ্লোরে সিনেমার সেট তৈরি হচ্ছে। পার্কের মতো বানানো একটি জায়গায় বাইরের কয়েকজন ছেলে বসে অলস আড্ডা দিচ্ছে। বাঁকানো যে ব্রিজ বা ছোট সেতুতে নায়িকারা শাড়ির আঁচল উড়িয়ে গানের দৃশ্যে অংশ নেন সেই সেতুর নিচে টলটলে পানি থাকার কথা, অথচ শেওলা আর বড়বড় কলমি শাক জন্মে আছে। পার্কের ঝরনাটি বন্ধ। তাই সেখানে নেই নায়ক নায়িকার নাচের দৃশ্য। মূল ফটকের সামনে নেই দর্শনার্থীদের ভিড়।

পার্শ্বচরিত্রের এই দুই শিল্পী নানি-দাদির চরিত্রে অভিনয় করেন। আজকাল তাঁদের আগের মতো কাজ জোটে না। ছবি: মানসুরা হোসাইন
পার্শ্বচরিত্রের এই দুই শিল্পী নানি-দাদির চরিত্রে অভিনয় করেন। আজকাল তাঁদের আগের মতো কাজ জোটে না। ছবি: মানসুরা হোসাইন

অনেকটা ফাঁকা এফডিসিতে (বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশন) গতকাল শনিবার দেখা হলো ফাইটার টাইগারের সঙ্গে। এক সময় বাংলা চলচ্চিত্রে পার্শ্ব বা এক্সট্রা চরিত্রে অনেক দাপট ছিল তাঁর। তিনি চিত্রনায়ক জসিমের সঙ্গে মারপিটের অভিনয় করেছেন। আবার নায়কের ডামি চরিত্রেও দেখা যেত তাঁকে। সিনেমায় দর্শকেরা দেখেন, নায়ক মার খাচ্ছেন। আসলে মার খেতেন তিনি। তাঁর ভাষায়,‘আমি হইলাম মার খাওন অলা’।
গত প্রায় ২৫ বছরে প্রায় আড়াই শ ছবিতে ‘ফাইটার’ হিসেবে অভিনয় করেছেন টাইগার। কিন্তু এখন আর ‘মার’ খাওয়ার জন্য তেমন ডাক পান না। বললেন ‘মালা তুমি কার’ ছবিতে শেষ অভিনয় করেছেন। সেও অনেক দিন আগে। 

নায়িকার বান্ধবীর চরিত্রে অভিনয় করেছেন কল্পনা। এফডিসিতে কাজের পরিমাণ কমে যাওয়ায় তাঁর ব্যস্ততা কমেছে। ছবি: মানসুরা হোসাইন
নায়িকার বান্ধবীর চরিত্রে অভিনয় করেছেন কল্পনা। এফডিসিতে কাজের পরিমাণ কমে যাওয়ায় তাঁর ব্যস্ততা কমেছে। ছবি: মানসুরা হোসাইন

সকাল থেকে এফডিসিতে চার ছেলে ও এক মেয়ের বাবা টাইগার যদি কোনো কাজ পাওয়া যায় সে আশায় বসে আছেন। তিনি বলেন, ‘সে এক জমানা ছিল। এইখানে তো দাঁড়াইতেই পারতেন না। ঝরণাতে নায়ক নায়িকা দেখতেন। ডাবিং রুম, মেকআপ রুম সব মানুষে গমগম করত। এখনতো বেশির ভাগ সময়ই এই সব তালা মারা থাকে। আগের সেই ডিরেক্টর, প্রডিউসাররাও নাই। কেউ কেউ ফিল্ম ছাইড়্যা অন্য ব্যবসায় চলে গেছে। বাংলা ফিল্মের কদর ও নাই।’
ব্যবসা মন্দ বলে সিনেমা হল ভেঙে মার্কেট তৈরি করছেন মালিকেরা। যেসব সিনেমা হচ্ছে তাতে সুন্দর, মনোরম দৃশ্যের জন্য শুটিং হচ্ছে অন্য জায়গা বা দেশের বাইরে। সিনেমার নাচ ও অন্যান্য চরিত্রের জন্য এখন অনেকেই বাইরে থেকে শিক্ষিত শিল্পী ভাড়া করেন। 
সিনেমার পার্শ্ব চরিত্রে অভিনয় করা শিল্পীরা ৫০০ থেকে দুই হাজার টাকা পর্যন্ত পান একেক শিফটের জন্য। তবে দালালের মাধ্যমে কাজ পেলে অর্ধেক দিতে হয় দালালকে।
মোছাম্মৎ কল্পনা ‘জমিদার বাড়ির মেয়ে’ সিনেমায় প্রথম অভিনয় করেন। শেষ ছবির নাম বলতে পারলেন না। কেননা সিনেমা মুক্তি পেতে পেতে অনেক সময় সিনেমার নামটাই পরিবর্তন হয়ে যায়। এ পর্যন্ত তিনি নায়িকা অপু বিশ্বাস, পূর্ণিমার বান্ধবীর চরিত্রে অভিনয় করেছেন। একটি সিনেমার নায়ক ছিলেন নীরব।
কল্পনার স্বামী কাঁচামালের ব্যবসা করেন। সিনেমায় অভিনয় করে কত পান জানতে চাইলে কল্পনা বলেন,‘নাচে কাজ করলে দুই হাজার টাকা। অভিনয়ে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত কাজ করলে রেট এক রকম। বেশির ভাগ সময়ই কাজ বুইঝ্যা টাকা দেয়।’

আগের মতো আর কদর নেই ফাইটার টাইগারের (সাদা পাঞ্জাবি)। ছবি: মানসুরা হোসাইন
আগের মতো আর কদর নেই ফাইটার টাইগারের (সাদা পাঞ্জাবি)। ছবি: মানসুরা হোসাইন

রাবেয়া ৩৫ বছর ধরে এফডিসিতে কাজ করছেন। এখন নানি, দাদির চরিত্রের জন্য মাঝে মাঝে ডাক পান। তিনি বলেন,‘সংসারে অভাব ছিল, তাই এই কাজে আসছিলাম। আগে তো ভালোই কাজ হইছে। কিন্তু এখন সারা দিন ঘুইরাও কাজ পাই না। এখন তো নায়ক জসিম, মান্নাও নাই।’
সিনেমায় নার্সের অভিনয় করা শেফালি বেগমও জানালেন হতাশার কথা। 

এফডিসির বন্ধ ফ্লোর। ছবি: মানসুরা হোসাইন
এফডিসির বন্ধ ফ্লোর। ছবি: মানসুরা হোসাইন

শাহানা বললেন, তিনি ২০ থেকে ২৫ বছর ধরে এখানে কাজ করছেন। মা, বোন, ভাবি যখন যে চরিত্র পান তাতেই অভিনয় করেন। সর্বশেষ কাজ করেছেন নায়ক শাকিব খানের সিনেমায়। কাজের পরিমাণ কমে গেছে বলে মিরপুর থেকে এখন এফডিসিতে কম আসেন। কাজের আশায় গতকাল অনেক দিন পর এসেছেন, থাকবেন সন্ধ্যা পর্যন্ত। সকাল থেকে কাজের আশায় বসে আছেন বীণাও। মলিন মুখ তাঁর। এসেছেন রামপুরা থেকে। কথা বলতে গেলে বেশ খানিকটা বিরক্ত হন। তিনি বলেন,‘কাজ পাওনের লাইগ্যা বইস্যা থাকতে হয়। কোরবানির ঈদের পর মাত্র একদিন ‘রাজা বাবু’ সিনেমায় মহল্লা বাসির চরিত্র পাই। আগে তো প্রায় প্রতিদিনই নায়িকার বান্ধবী বা অন্য রুলে অভিনয়ের ডাক পাইতাম।’

এফডিসির মূল ফটক। ছবি: মানসুরা হোসাইন
এফডিসির মূল ফটক। ছবি: মানসুরা হোসাইন

জসিম ১৯৭২ সালে ১০ বছর বয়সে এফডিসিতে কাজে যোগ দেন। এখন তিনি প্রোডাকশন ম্যানেজার। তিনি বলেন,‘এফডিসির ভেতরে শুটিং এর সংখ্যা কমে গেছে। প্রশাসনের দুর্নীতি তো আছেই। ফ্লোর খালি থাকলেও ভাড়া নিতে অনেক হাঙ্গামা পোহাতে হয়। অনেক জায়গায় দৌড়াতে হয়। বিভিন্ন কারণেই শুটিং এর সংখ্যা কমে গেছে।’
এফডিসি দেখতে আসা দর্শনার্থীদের কণ্ঠেও ছিল হতাশা। সোহরাব দেওয়ান এখন ভারতে থাকেন। দেশে এসে এফডিসি দেখতে এসেছেন। তিনি বলেন,‘ সোহেল রানা, রুবেল আর শাবনূররে দেখার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু কাউরেই দেখতে পাইলাম না।’ 

এফডিসির ফটকের সামনে অপেক্ষমাণ কয়েকজন। ছবি: মানসুরা হোসাইন
এফডিসির ফটকের সামনে অপেক্ষমাণ কয়েকজন। ছবি: মানসুরা হোসাইন

এফডিসি পরিচালক সমিতির মহাসচিব মুশফিকুর রহমান গুলজার প্রথম আলোকে বলেন, যাঁদের সিনেমার বাজেট কম থাকে তাঁরা এফডিসির ফ্লোর ভাড়া নিতে চান না। এখানে সেট বানিয়ে ড্রয়িং রুমসহ অন্যান্য জিনিস বানাতে খরচ বেশি হয়। এফডিসিতে বর্তমানে ছয় নম্বর ফ্লোরটি অকেজো। আরও কয়েকটিতে কাজ চলছে। সব মিলে আটটি ফ্লোর জোড়াতালি দিয়ে চলছে। তিনি বলেন, আগে বছরে ৮০ থেকে ৮৫টি ছবি হতো। বর্তমানে তা ৬০ এর ঘরে নেমে এসেছে। এসব সিনেমার বেশির ভাগেরই কাজ হচ্ছে এফডিসির বাইরে। এ কারণে এই শিল্পীরা মানবেতর জীবনযাপন করছেন।