কথাসাহিত্যিক রাবেয়া খাতুন আর নেই

চলে গেলেন রাবেয়া খাতুন। ছবি : সংগৃহীত

কথাসাহিত্যিক রাবেয়া খাতুন আর নেই। আজ রোববার বিকেল ৫টায় হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে বনানীর বাসায় তিনি শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৬ বছর। তিনি দীর্ঘদিন বার্ধক্যজনিত নানা রোগে ভুগছিলেন। তাঁর মৃত্যুর খবর প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেছেন চ্যানেল আইয়ের অনুষ্ঠান বিভাগের মহাব্যবস্থাপক ও শিশুসাহিত্যিক আমীরুল ইসলাম। রাবেয়া খাতুনের দুই ছেলে ফরিদুর রেজা সাগর এবং ফরহাদুর রেজা প্রবাল বর্তমানে দেশের বাইরে। আগামীকাল বিকেলে রাবেয়া খাতুনকে বনানী কবরখানায় দাফন করা হবে।

মহীয়সী নারী রাবেয়া খাতুনের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রাবেয়া খাতুন লিখেছেন উপন্যাস, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, কিশোর উপন্যাস, স্মৃতিকথা। তাঁর লেখা থেকে নির্মিত হয়েছে চলচ্চিত্র ও নাটক। পঞ্চাশের দশকে এই অঞ্চলের মুসলিম নারীদের জীবন যখন নানা বিধিনিষেধের বেড়াজালে বন্দী, তেমন সময়ে তিনি আত্মপ্রকাশ করেন একজন লেখক হিসেবে। কথাসাহিত্যিক হিসেবে পরিচিত হলেও রাবেয়া খাতুন একসময় শিক্ষকতা করেছেন। সাংবাদিকতার সঙ্গেও দীর্ঘদিন যুক্ত ছিলেন। ‘ইত্তেফাক’, ‘সিনেমা’ পত্রিকা ছাড়াও তাঁর সম্পাদনায় পঞ্চাশের দশকে প্রকাশিত হতো ‘অঙ্গনা’ নামে নারীদের একটি মাসিক পত্রিকা।

রাবেয়া খাতুনের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে সিনেমা। ছবি : সংগৃহীত

রাবেয়া খাতুন ঢাকার বিক্রমপুরে তাঁর মামার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তবে তাঁর পৈতৃক বাড়ি মুন্সিগঞ্জ জেলার শ্রীনগর উপজেলার ষোলঘর গ্রামে। তাঁর বাবা মৌলভি মোহাম্মদ মুল্লুক চাঁদ এবং মা হামিদা খাতুন। তিনি আরমানিটোলা স্কুল থেকে প্রবেশিকা (মাধ্যমিক) পাস করেন ১৯৪৮ সালে। রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারের মেয়ে হওয়ায় বিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরোতেই তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ বন্ধ হয়ে যায়। তাঁর রচিত প্রথম উপন্যাস ‘নিরাশ্রয়া’ (অপ্রকাশিত)।

রাবেয়া খাতুনের স্বামী প্রয়াত এ টি এম ফজলুল হক ছিলেন দেশের চলচ্চিত্রবিষয়ক প্রথম পত্রিকা সিনেমার সম্পাদক ও চিত্রপরিচালক। বাংলাদেশের প্রথম শিশুতোষ চলচ্চিত্র ‘প্রেসিডেন্ট’-এর পরিচালকও তিনি। ১৯৫২ সালের ২৩ জুলাই তাঁদের বিয়ে হয়। তাঁদের চার সন্তান ফরিদুর রেজা সাগর, কেকা ফেরদৌসী, ফরহাদুর রেজা প্রবাল ও ফারহানা কাকলী।

রাবেয়া খাতুন রচিত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক জনপ্রিয় উপন্যাস ‘মেঘের পর মেঘ’ অবলম্বনে একই নামে ২০০৪ সালে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন পরিচালক চাষী নজরুল ইসলাম। ২০১১ সালে তাঁর আরেক জনপ্রিয় উপন্যাস ‘মধুমতি’ অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন পরিচালক শাহজাহান চৌধুরী। ২০০৩ সালে তাঁর লেখা ‘কখনো মেঘ কখনো বৃষ্টি’ অবলম্বনে এই নামে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন অভিনেত্রী মৌসুমী।

বহু উপন্যাস লিখেছেন রাবেয়া খাতুন। ছবি : সংগৃহীত

রাবেয়া খাতুন বাংলা একাডেমির কাউন্সিল মেম্বার। জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্রের গঠনতন্ত্র পরিচালনা পরিষদের সদস্য, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের জুরিবোর্ডের বিচারক, শিশু একাডেমির কাউন্সিল মেম্বার ও বাংলাদেশ টেলিভিশনের প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠান ‘নতুন কুড়ি’র বিচারক। বাংলাদেশ টেলিভিশনের জাতীয় বিতর্কের জুরিবোর্ডের বিচারক ও সভানেত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। যুক্ত ছিলেন বাংলা একাডেমি, বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ, ঢাকা লেডিজ ক্লাব, বিজনেস ও প্রফেশনাল উইমেন্স ক্লাব, বাংলাদেশ লেখক শিবির, বাংলাদেশ কথাশিল্পী সংসদ ও মহিলা সমিতির সঙ্গে।

তাঁর লেখা বিভিন্ন উপন্যাসের মধ্যে আছে ‘মধুমতি’, ‘সাহেব বাজার’, ‘অনন্ত অন্বেষা’, ‘রাজারবাগ শালিমারবাগ’, ‘মন এক শ্বেত কপোতী’, ‘ফেরারী সূর্য’, ‘অনেকজনের একজন’, ‘জীবনের আর এক নাম’, ‘দিবস রজনী’, ‘সেই এক বসন্তে’, ‘মোহর আলী’, ‘নীল নিশীথ’, ‘বায়ান্ন গলির এক গলি’, ‘পাখি সব করে রব’, ‘নয়না লেকে রূপবান দুপুর’, ‘মিড সামারে’, ‘হানিফের ঘোড়া’, ‘হিরণ দাহ’, ‘এই বিরহকাল’, ‘হোটেল গ্রীন বাটন’, ‘বাগানের নাম মালনিছড়া’, ‘প্রিয় গুলশানা’, ‘বসন্ত ভিলা’, ‘ছায়া রমণী’, ‘সৌন্দর্যসংবাদ’, ‘হৃদয়ের কাছের বিষয়’, ‘মালিনীর দুপুর’, ‘রঙিন কাচের জানালা’ ইত্যাদি। সাহিত্যে অবদানের জন্য তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার, হুমায়ূন কাদির স্মৃতি পুরস্কার, একুশে পদক, বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ পুরস্কার, বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ, নাসির উদ্দীন স্বর্ণপদক, জসীমউদ্‌দীন পুরস্কার, শেরেবাংলা স্বর্ণপদক, ঋষিজ সাহিত্য পদক, অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার, শেল্‌টেক্‌ পদক ইত্যাদি পুরস্কার পেয়েছেন।