চলচ্চিত্র নিয়ে দেশের সঙ্গে সমান্তরাল হেঁটেছিলেন তিনি

বাংলাদেশের প্রতিটি ঐতিহাসিক অধ্যায়ে কখনো তাঁর কলম লিখেছে, কখনো ক্যামেরার ফ্ল্যাশ জ্বলে উঠেছে

বুলেট দিয়েই কি সব সময় যুদ্ধ হয়? একাত্তরে জহির রায়হান তুলে নিয়েছিলেন ক্যামেরা। স্টপ জেনোসাইড, বার্থ অব আ নেশন পরিচালনা কিংবা লিবারেশন ফাইটার্স, ইনোসেন্ট মিলিয়নস প্রযোজনা করে পাকিস্তানি সৈন্যদের বিভৎসতা তুলে ধরেছিলেন পুরো বিশ্বে। স্বাধীনতা–পরবর্তীকালে জহির রায়হান তাই একজন কথাশিল্পী, আলোকচিত্রী, সম্পাদক, বুদ্ধিজীবী, ভাষাসংগ্রামী আর মুক্তিযোদ্ধার অভিধা ছাপিয়ে পরিচিত হয়ে ওঠেন একজন চলচ্চিত্রকার হিসেবে।
আপাদমস্তক তিনি ছিলেন শিল্পী, কি জীবন কি কাজে। বাংলাদেশের প্রতিটি ঐতিহাসিক অধ্যায়ে কখনো তাঁর কলম লিখেছে, কখনো ক্যামেরার ফ্ল্যাশ জ্বলে উঠেছে। মাঠে, ময়দানে, রাস্তায় সক্রিয় অংশগ্রহণ তো ছিলই। একুশের দিনগুলোকে যেমন দেখা যায় আরেক ফাল্গুন-এ, তেমনি একাত্তরের বিভৎস চিত্র উঠে এসেছে স্টপ জেনোসাইড-এ। কী করে শিল্প দিয়ে জীবনকে প্রভাবিত করা যায়, তার উজ্জ্বল উদাহরণ তিনি তৈরি করেছিলেন।

আন্তর্জাতিক থেকে শুরু করে আমজনতা পর্যন্ত তাঁর অবাধ বিচরণ।
ছবি: সংগৃহীত

১৯৭০ সাল। পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার জন্য ফুঁসছে। এই গনগনে সময়ে ফেনীর মজুপুরের ছেলেটি একটি ছবি বানিয়ে বসলেন জীবন থেকে নেয়া নামে। সেই সময়ে জীবন থেকেই যেন গল্পগুলো জীবন্ত উঠে এসেছিল পর্দায়। 'একটি দেশ, একটি সংসার, একটি চাবির গোছা, একটি আন্দোলন' স্লোগান নিয়ে ছবিটি হয়ে উঠেছিল আইয়ুব খান ও পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের শোষণকে তুলে ধরার এক শৈল্পিক প্রয়াস।

এভাবেই জহির রায়হানের জীবন ও কাজ এই দেশ ও মাটির সঙ্গে কখন যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল। স্বাধীনতার বেশ আগেই ক্যামেরার সঙ্গে বন্ধুত্ব তাঁর। পড়তে গিয়েছিলেন ফিল্ম স্কুলেও। শেষ করতে পারেননি। পরিচালক এ জে কারদার তখন একটি ছবি করার জন্য বাংলাদেশে আসেন। জহির রায়হানকে নিয়ে নেন সহকারী পরিচালক হিসেবে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মা নদীর মাঝি অবলম্বনে জাগো হুয়া সাভেরা হয়ে ওঠে জহিরের চলচ্চিত্র শেখার হাতেখড়ি। এরপর সহকারী হিসেবে নাম লেখান সালাউদ্দিনের যে নদী মরুপথ, এহতেশামের এ দেশ তোমার আমার ছবিতে।

কলকাতায় ১৯৭১ সালে এক প্রতিবাদ সমাবেশে (বাঁ থেকে) পটুয়া কামরুল হাসান, জহির রায়হান ও অজয় রায়।
ছবি: সংগৃহীত

তত দিনে এফডিসি প্রস্তুত। জহির রায়হান এবার পরিচালনায় হাত দিলেন। ১৯৬১ সালে মুক্তি পেল প্রথম ছবি কখনো আসেনি। তখন বয়স মোটে ২৬। সেই শুরু। এটিসহ এক দশকের পথচলায় তিনি পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবি বানিয়েছেন ১০টি। অন্যগুলো হলো সোনার কাজল, কাঁচের দেয়াল, সঙ্গম, বাহানা, বেহুলা, আনোয়ারা, একুশে ফেব্রুয়ারী, জীবন থেকে নেয়া ও লেট দেয়ার বি লাইট। শুধু পরিচালনা নয়, একটি নতুন চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিকে এগিয়ে নিতে ধরেছিলেন প্রযোজনার হাল। দুই ভাই, কুচবরণ কন্যা, জুলেখা, সুয়োরাণী দুয়োরাণী, সংসার ও মনের মতো বউ-এর মতো ছবিগুলো প্রযোজনা করেন তিনি।

শুধু তা–ই নয়, ১৯৬৪ সালে তাঁর নির্মিত উর্দু ছবি সঙ্গম ছিল সমগ্র পাকিস্তানের প্রথম রঙিন ছবি। ১৯৬৫ সালে নির্মিত তাঁর ছবি বাহানা পাকিস্তানের প্রথম সিনেমাস্কোপ চলচ্চিত্র। মনসামঙ্গল পুরাণ থেকে নির্মিত বেহুলা চলচ্চিত্রটি মুক্তি পায় ১৯৬৬ সালের সেপ্টেম্বরে। এই চলচ্চিত্র বাংলাদেশকে পরিচয় করিয়ে দেয় এক নতুন অভিনেতার, একসময় যিনি রাজ্জাক নামে কাঁপিয়ে বেড়াবেন বাংলা চলচ্চিত্রে।

শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক হিসেবে সন্ধানী প্রকাশনীর সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে বক্তৃতারত জহির রায়হান। মঞ্চে বাঁ থেকে কাইয়ুম চৌধুরী, সৈয়দ শামসুল হক, হাসান হাফিজুর রহমান ও গাজী শাহাবুদ্দিন আহমেদ

তবে জহির রায়হান সবচেয়ে বেশি উজ্জ্বল প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণে। একাত্তরে পাকিস্তানি সেনাদের গণহত্যা ক্যামেরার লেন্সে তুলে এনেছিলেন সুচারুভাবে। তাঁর পরিচালিত স্টপ জেনোসাইড ও বার্থ অব আ নেশন এবং তাঁর প্রযোজিত বাবুল চৌধুরীর ইনোসেন্ট মিলিয়নস ও আলমগীর কবিরের লিবারেশন ফাইটার্স মুক্তিযুদ্ধের অসামান্য দলিলও বটে।

জহির রায়হান ও সুচন্দার সঙ্গে ববিতা (বাঁয়ে)

এভাবেই কাজে, মননে আর জীবনে এই চলচ্চিত্রকার যেন বাংলাদেশেরই সমান্তরাল হেঁটে গেছেন। তাঁর চরিত্রগুলো ছবিতে, গল্পে উঠে আসে ঠিক এই মাটির মানুষ হয়ে। তাঁর চলচ্চিত্র, উপন্যাস কিংবা গল্পের প্রতিটি চরিত্রই কি জহির নিজে নন? এমন প্রশ্ন উঠে আসে মনে।