চাষী নজরুল: সতীর্থদের স্মরণ

সোহেল রানা: চাষী নজরুল ইসলাম স্বাধীন বাংলার প্রথম মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র ওরা ১১ জন-এর পরিচালক। এই একটি কারণে হলেও বাংলাদেশ যত দিন থাকবে তত দিন এ দেশের মানুষ তাঁকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে। কাজের কারণে চাষীর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তাঁর চলে যাওয়ায় এক বন্ধুকে হারালাম আমি। চাষীর পরিচালনা ও নির্দেশনায় আমি দুটি চলচ্চিত্রে কাজ করেছিলাম। ছবি দুটি হচ্ছে হাঙর নদী গ্রেনেড ও বাসনা। অনেক মেধাসম্পন্ন একজন মানুষ ছিলেন চাষী। তাঁর মধ্যে খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাও ছিল। আর তাঁর এই দ্রুত সিদ্ধান্তের কাজগুলো সফলতাও পেত।
সুচন্দা: চাষী ভাই একাধারে একজন সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধা, স্পষ্টবাদী মানুষ এবং সর্বোপরি একজন বন্ধুসুলভ মানুষ ছিলেন। তাঁর সবকিছু নিয়ে যদি বিশ্লেষণ করি তবে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠবে যে তিনি সত্যিকার অর্থের একজন ভালো মনের মানুষ ছিলেন। একজন খুব ভালো ও গুণী নির্মাতা ছিলেন। তিনি এতটাই স্পষ্টবাদী ছিলেন যে কোনো কথা বলতেই দ্বিধাবোধ করতেন না। কে কী বলবে না বলবে এসব না ভেবে যা সত্য তিনি তাই বলতেন। চাষী ভাই এতটাই বন্ধুবৎসল মানুষ ছিলেন যে সব সময়ই তিনি হাসিমুখে কথা বলতেন সবার সঙ্গে। আমার প্রযোজনায় তিনি বাসনা ও বেহুলা লখিন্দর নির্মাণ করেছিলেন। চাষী ভাই এমনই একজন দরাজ কণ্ঠের মানুষ ছিলেন অনেক মানুষের ভিড়ে যখন তিনি কথা বলতেন, তখন মাইকেরও প্রয়োজন হতো না। সবাই তাঁর কথা শুনতে পেতেন। যাই হোক, তাঁর সেই দরাজ কণ্ঠ আর শোনা হয়ে উঠবে না তবে বহুদিন পর্যন্ত তাঁর সেই কণ্ঠ কানের কাছে বেজে উঠবে। তাঁদের মতো মানুষের চলে যাওয়াতে শূন্য হয়ে যাচ্ছে চলচ্চিত্রের অভিভাবক, এই শূন্যতা পূরণ হওয়ার নয়।
ফারুক: শুনেছি, সে দিলীপ কুমারের অভিনয় খুব পছন্দ করত। সেই পছন্দ থেকে অভিনয় করার স্বপ্ন নিয়ে চলচ্চিত্রে আসে চাষী। এরপর তো সে নির্মাণে অনেক বড় একটা জায়গায় চলে যায়। আমরা সমসাময়িক ছিলাম। আমাদের মধ্যে সম্পর্কও ছিল খুব সুন্দর। পেশাগত কাজের আলাপ ছাড়াও ব্যক্তিগত অনেক বিষয় নিয়ে আমরা আলোচনা করতাম। একপর্যায়ে তা বন্ধুত্বে রূপ নেয়। বন্ধুর সঙ্গে কাজ করার ব্যাপারটিও ছিল বেশ আনন্দের। অনেক মজা করতাম। চাষী নিজেও খুব মজার একজন মানুষ ছিল। সব সময়ই হাসিমুখে কথা বলত। তার পরিচালনায় চারটি ছবিতে অভিনয় করেছি। এগুলো হচ্ছে: বেহুলা লখিন্দর, পদ্মা মেঘনা যমুনা, দাঙ্গা ফ্যাসাদ ও মিয়াভাই। এর মধ্যে মিয়াভাই ছবিটি আমি প্রযোজনা করেছিলাম। অবাক হতাম এই ভেবে, যেই মানুষটা ওরা ১১ জন, বেহুলা লখিন্দর, পদ্মা মেঘনা যমুনা, সংগ্রাম-এর মতো ছবি বানিয়েছে সেই আবার দাঙ্গা ফ্যাসাদ-এর মতো ছবি বানিয়েছে। একেক ধরনের ছবি বানিয়ে সে যে ভার্সেটাইল তার প্রমাণ করে গেছে।
চাষীর চলে যাওয়ার মধ্য দিয়ে আমরা হারালাম খুব ভালো মানুষ, ভালো একজন বন্ধু আর চলচ্চিত্রশিল্পও হারাল একজন অভিভাবক।
ববিতা: খুব সকালে চাষী ভাইয়ের মৃত্যুর খবরটি শুনলাম। খুব দুঃখ লাগে যে সব আপন মানুষেরা একে একে চলে যাচ্ছেন। আমাদের চলচ্চিত্রাঙ্গনে চাষী ভাইয়ের যে অবদান তাই তাঁকে হাজার বছর বাঁচিয়ে রাখবে। আমাদের তিন বোনের সঙ্গে চাষী ভাইয়ের সম্পর্কটা ছিলো নিবিড়। আমরা যখনই কোনো অনুষ্ঠান করতাম, তখন আর কাউকে বলি না-বলি চাষী ভাইকে বলতামই। কারণ, তিনি আমাদের পরম আত্মার একজন মানুষ ছিলেন। পারিবারিক বিভিন্ন সমস্যায় আমরা তাঁকে সব সময়ই কাছে পেয়েছি। আমাদের চলচ্চিত্রাঙ্গনকে তিনি সমৃদ্ধ করে গেছেন। একটি নয়, দুটি নয় শুধু মুক্তিযুদ্ধ নিয়েই তিনি ছয়টি চলচ্চিত্র নির্মাণ করে গেছেন। তার নির্দেশনায় আমি বিরহ ব্যথা, লেডি স্মাগলার, বেহুলা লখিন্দর, মিয়াভাই, ভালো মানুষ, হাছন রাজা চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছি।