দুই উৎসবের ৩ সেরা ছবি

করোনাকাল। তাই চলচ্চিত্র উৎসবগুলোর ঠিকানা এখন ওয়েব। সেখানেই হয়ে গেল ছোট ছবির দুটি উৎসব। সেরা পুরস্কার পাওয়া তিনটি ছবির নেপথ্য গল্প নিয়েই এ আয়োজন।

হোয়াই নট প্রামাণ্যচিত্রের দৃশ্য
সংগৃহীত

হোয়াই নট

দুই দেশ, এক বেদনা

দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রবাসী শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করেন শেখ আল মামুন। কাজ করতে করতেই একসময় জানতে পারলেন ‘কমফোর্ট উইমেন’দের কথা। জাপানিদের যৌন নির্যাতনের শিকার এসব নারীর সঙ্গে বাংলাদেশের বীরাঙ্গনাদের আশ্চর্য মিল খুঁজে পেলেন মামুন। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে বীরাঙ্গনারাও তো নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। এ বিষয়ে পড়ালেখা শুরু করলেন মামুন। পড়তে পড়তেই একসময় তাঁর মনে হলো, আচ্ছা, এই দুই দেশের ভাগ্যাহত নারীদের জীবন সেলুলয়েডে বন্দী করা যায় না?

মাঠে নেমে পড়লেন মামুন। কিন্তু এক হাতে দুই দেশের কাজ চালানো তো মুশকিল। বীরাঙ্গনাদের নিয়ে বানানো সাইফুল জার্নালের অপেক্ষা নিরন্তর ছবিটি দেখে তাঁর মনে হলো, এই মানুষই পারেন তাঁকে সাহায্য করতে। প্রস্তাব দিতেই রাজি হয়ে গেলেন জার্নাল। দক্ষিণ কোরিয়ার এএমসি ফ্যাক্টরির সঙ্গে যুক্ত হলো বাংলাদেশের জলজ মুভি।

দক্ষিণ কোরিয়ায় দুই ধাপে ৪৫ দিন শুটিং চলে। নেওয়া হয় কমফোর্ট উইমেন, কোরিয়ার যুদ্ধ জাদুঘরের কিউরেটরসহ যুদ্ধাপরাধের বিচারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকার। এরপর বাংলাদেশে আসেন মামুন। সিরাজগঞ্জ ও মৌলভীবাজারে গিয়ে ২৯ জন বীরাঙ্গনার সঙ্গে কথা বলেন তিনি।

ছবিটির বাংলাদেশ অংশের সম্পাদনা করেছেন সাইফুল জার্নাল। আর কোরীয় অংশের নির্মাতা শেখ আল মামুন নিজেই। অনলাইনেই চলে সলাপরামর্শ। ধীরে ধীরে দাঁড়িয়ে যায় দুই দেশের বিশেষ নারীদের কথা নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র। বলে রাখা ভালো, এটি নির্মাতার দশম ছবি।

এবার নামের পালা। কী নাম দেওয়া যায়? নির্মাতা বলেন, ‘তাঁদের দাবি, সামাজিক নিরাপত্তা, স্বীকৃতি এবং যুদ্ধাপরাধী পাকিস্তানিদের বিচার। আমরা ভাবলাম, তাহলে বিচার হচ্ছে না কেন? তাঁদের যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করা হচ্ছে না কেন? হোয়াই নট? তার থেকেই নাম দিলাম হোয়াই নট?’

হোয়াই নট প্রামাণ্যচিত্রের শুটিংয়ের ফাঁকে
সংগৃহীত

ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জানুক এ ইতিহাস। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর আয়োজিত এবারের লিবারেশন ডকফেস্টে সেরা (দেশি) ছবি হয়েছে হোয়াই নট।

হাউসের ধুয়া প্রামাণ্যচিত্রের দৃশ্য
সংগৃহীত

হাউসের ধুয়া

শৈশবের স্মৃতিরা সেলুলয়েডে

গ্রীষ্মের কোনো এক সন্ধ্যা। উঠানে গোল হয়ে বসেছে লোকজন। মাঝখানে ঢোল, করতাল, মন্দিরা হাতে গায়েনের দল। এক গায়েন প্রশ্ন করেন, আরেক গায়েন উত্তর দেন। জমে ওঠে আসর। গানে গানে ভোর হয়ে যায়। গানের তালে তালে মাথা ঝাঁকাচ্ছে এক শিশু, নাম রাসেল রানা। বয়স কত হবে? তিন কি চার!

তারপর কেটে গেছে অনেক বছর। চলচ্চিত্র নিয়ে পড়াশোনা করতে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন ইনস্টিটিউটে ভর্তি হন রাসেল। অ্যাসাইনমেন্টের অংশ হিসেবে একটি প্রামাণ্যচিত্র বানানোর কাজ পান। হঠাৎ পুরোনো স্মৃতিরা জেগে ওঠে। শৈশবের স্মৃতিঘেরা সেই ধুয়া গান পর্দায় তুলে আনলে কেমন হয়?

কিন্তু এখন কোথায় পাবেন ধুয়া গানের দল? অনেক খুঁজে জামালপুরের পলাশতলায় পাওয়া গেল একটি ক্ষয়ে যাওয়া দল। দলের কেউ কৃষক, কেউ শ্রমজীবী। নিজেদের জীবনের সুখ-দুঃখ নিয়েই মূলত গান বাঁধেন তাঁরা। ১৯৯১ সালের বন্যা নিয়েও গান বেঁধেছেন। এখন খুব একটা গান করেন না। শুরু হলো তাঁদের সেলুলয়েডে তোলার কাজ। তিনি বলেন, ‘পাঁচ দিন শুটিং করেছি। প্রস্তুতিতেই গেছে বড় একটা সময়। বোঝেন তো! এখন আর ধুয়া গান অতটা হয় না। আমার দাদা ও দাদার ভাইয়েরা ধুয়া গান করতেন। সেই সূত্রে বাবারও জানাশোনা আছে। পরিবারের সহযোগিতা নিয়েছি।’

হাউসের ধুয়া প্রামাণ্যচিত্রের দৃশ্য
সংগৃহীত

জামালপুরের প্রত্যন্ত অঞ্চলে শুটিং। শট নেওয়ার জন্য ক্রেন লাগবে। শহর থেকে যন্ত্রপাতি নেওয়াও কষ্টসাধ্য। তাহলে উপায়? বাঁশ-কাঠ দিয়ে ক্রেন বানিয়ে দিলেন বাবা মোসলেম উদ্দিন। এভাবেই তৈরি হলো প্রামাণ্যচিত্র হাউসের ধুয়া।

নিজেদের তৈরি ‘ক্রেনে’ চিত্রগ্রাহক
সংগৃহীত

বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির তৃতীয় বাংলাদেশ স্বল্পদৈর্ঘ্য ও প্রামাণ্য চলচ্চিত্র উৎসবে প্রামাণ্যচিত্র শাখায় সেরা ছবি, সেরা নির্মাতা, সেরা সম্পাদনা, সেরা শব্দপরিকল্পনায় পুরস্কার পেয়েছে হাউসের ধুয়া। পাশাপাশি আরেকটা আনন্দের খবর জানালেন রাসেল, তাঁর আগামী প্রামাণ্যচিত্র সোনার তরী স্বল্পদৈর্ঘ্য শাখায় সরকারি অনুদান পেয়েছে।

আশ্রয় স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের দৃশ্য
সংগৃহীত

আশ্রয়

নিজের টাকা, বাবার টাকা

আশ্রয় কিন্তু একটা একাডেমিক অ্যাসাইনমেন্ট। কিন্তু নির্মাতা সারা বিনতে আফজলের চাওয়া ছিল অ্যাসাইনমেন্টের চেয়ে বেশি কিছু, সত্যিকারের ভালো একটা ছবি। ঠিক হলো, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘খুনি’ গল্পটিকে সেলুলয়েডে তোলা হবে।

খুব ভালো। কিন্তু ভালো ছবি বানাতে টাকা লাগে। হুট করে এত টাকা কোথায় পাবেন? সে পরিকল্পনা আগেই করে রেখেছিলেন সারা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টেলিভিশন, ফিল্ম অ্যান্ড ফটোগ্রাফি বিভাগে পড়ার শুরু থেকেই একটু একটু করে টাকা জমানো শুরু করেন। সেই টাকা দিয়েই শুরু হয় কাজ। বিভাগের অগ্রজ ও অনুজদের নিয়ে বানানো হলো শুটিং টিম। কিন্তু জমানো টাকা দিয়ে আর কত দিন? এখন কী করবেন! পাশে এসে দাঁড়ালেন বাবা। অবশেষে শেষ হলো কাজ। সারা জানান, পাঁচ থেকে ছয় মাসের একটা সফর ছিল।

আশ্রয় স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের দৃশ্য
সংগৃহীত

তৃতীয় বাংলাদেশ স্বল্পদৈর্ঘ্য ও প্রামাণ্য চলচ্চিত্র উৎসবে স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রে সেরা হয়েছে আশ্রয়।

সারা কি সন্তুষ্ট? চলুন পুরস্কার পাওয়ার পর তাঁর একটি ফেসবুক পোস্ট থেকে ঘুরে আসা যাক। সারা লিখেছেন, ‘এই খবর পাওয়ার পরমুহূর্তেই অনেক স্মৃতি মনে পড়ে গেল। রোকেয়া হলে বসে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে আমি তখন শুধু গল্প খুঁজি। খুব বেশি হল থেকে বের হই না, ক্লাস শেষ করেই সোজা হল। কখনো হলের মাঠে শুয়ে ভাবনা চলে, কখনো ডাইনিংয়ে বসে ভাত খাওয়ার সময়। এমনি করে আমার অনেক নির্ঘুম রাত যায়। রুমমেট এসব দেখে বলত, “আরে, এত প্যারা তুই নিতে পারোস! দেখবি ভালো কিছুই করতে পারবি শেষমেশ।”’

শেষমেশ ভালো কিছুই করেছেন সারা।