দেশের বাইরে ঈদ
দেশে স্বজনদের সঙ্গে ঈদ করতে কার না ভালো লাগে? কিন্তু সেলিব্রিটি বলে কথা। কাজের প্রয়োজনে কখনো কখনো ঈদটা কাটাতে হয় বিদেশে। সে রকমই কয়েকটি গল্প নিয়ে এই লেখা

দুবাইয়ে ঈদ, লন্ডনে ঈদ
শাকিলা জাফর
দেশের বাইরে আমার প্রথম ঈদ কেটেছিল ছোটবেলায়। পড়াশোনার জন্য বেশ কিছু সময় বাইরে থাকতে হয়েছিল আমাকে। বড় হওয়ার পর দেশের বাইরে প্রথম যে ঈদটা করলাম, সেটা ছিল ভীষণ মজার। একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের জন্য ঈদের আগের দিন আমরা লন্ডনে গিয়েছিলাম। বাংলাদেশ থেকে রওনা দেওয়ার দিন ছিল দুবাইয়ে ঈদ, পরদিন ঈদ ছিল বাংলাদেশে এবং তারপর লন্ডনে। লন্ডনে যাওয়ার পথে ট্রানজিট নেওয়ার জন্য দুবাই বিমানবন্দরে নামি, তখন সেখানে ঈদ। মিশ্র এক অনুভূতি হচ্ছিল মনের মধ্যে। বিমানবন্দরে ছিলাম, ঈদের কোনো আমেজ সেখানে লক্ষ করিনি। সেখানে অনেক লম্বা সময় ট্রানজিট ছিল। আমার বোন থাকে সেখানে, তাকে আসতে বললাম। বোন তার পরিবারসহ এল। আমরা ঈদ উপহার বিনিময় করলাম এবং ট্রানজিটের পুরো সময়টায় ভীষণ মজা করলাম সবাই মিলে।
যখন লন্ডনে পৌঁছালাম, তখন সেখানেও ঈদ। ঈদের দিনই আমাদের অনুষ্ঠান ছিল, তাই সেদিন অনুষ্ঠান নিয়েই ব্যস্ত থেকেছি সারা দিন। অনুষ্ঠান শেষে আয়োজকদের সঙ্গে মজা করে কাটিয়েছি বাকিটা সময়। আর বাঙালি কমিউনিটিতে অনুষ্ঠান ছিল বলে ঈদের আমেজটাও ছিল দারুণ। তাদের আতিথেয়তা ছিল মনে রাখার মতো।

ওরা উত্তর দিতে পারেনি
ফজলুর রহমান বাবু
গত বছর ঈদের আগে কাতারে গিয়েছিলাম একটা নাটকের শুটিংয়ে। প্রথমবারের মতো দেশের বাইরে ঈদ করব, তাও আবার আরব দেশে! ঈদের নামাজটা আমাদের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ, তাই হোটেলে গিয়েই ওদের কাছে জানতে চাইলাম, ঈদের নামাজ কোথায় হয় আর জামাতই বা কয়টায়। আমাকে অবাক করে দিয়ে ওরা এর কোনো উত্তর দিতে পারেনি। অনেকক্ষণ পর ওরা আমাকে যেটা জানাল সেটা এ রকম: এখানে ঈদের নামাজ বা জামাত বলে আলাদা কিছু নেই। ওরা ফজরের নামাজের সময় ঈদের নামাজ হিসেবে দুই রাকাত বাড়তি নামাজ পড়ে ফেলে। হোটেলের কাছেই একটা মসজিদ ছিল। ভাবলাম, ফজরের নামাজের সময় ওই মসজিদে গিয়ে ঈদের নামাজটা পড়ে ফেলব। কিন্তু বিধি বাম!! হোটেল থেকে জানাল যে কাছের সেই মসজিদে ওই দুই রাকাত নামাজ পড়ানো হয় না। সেটা পড়তে হলে হোটেল থেকে অনেক দূরে একটা মসজিদ আছে, সেখানে যেতে হবে।
খুব ভোরে হোটেলের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। কেউ যদি নামাজ পড়তে যায়, তাহলে তাদের সঙ্গে যাব। কিন্তু কারও দেখা পেলাম না। ফলে ইচ্ছে থাকলেও ঈদের জামাতে শরিক হতে পারিনি। আরও কিছু ঘটনা শুনে নিন মাহফুজের মুখে।

সবাই মিলে মালয়েশিয়ায়
নোবেল
তিন-চার বছর আগে বাবা-মায়ের সঙ্গে প্রথমবারের মতো কলকাতায় ঈদ করেছিলাম। কিন্তু সেই ঈদের চেয়েও স্মরণীয় ঈদ ছিল এক বছর আগে কুয়ালালামপুরে বাবা-মা-স্ত্রী-সন্তানসহ সবাইকে নিয়ে করা ঈদটা। কলকাতার চেয়ে ওটা একটু ব্যতিক্রমী ছিল।
আমরা যে গেস্ট হাউসটাতে উঠেছিলাম, সেটায় রান্নাবান্না করার সুযোগ ছিল না। সকালে ঈদের নামাজ শেষে আমরা যখন বাসায় ফিরি, তখন দেখলাম গেস্ট হাউসের কেয়ারটেকাররা আমাদের জন্য কিছু ঈদের খাবারের আয়োজন করেছে। মজার কথা হলো, ওরা ছিল বাঙালি। ব্যাপারটা খুব ভালো লেগেছিল। আমাদের একজন আত্মীয় থাকেন কুয়ালালামপুরে, যিনি ওখানে শিক্ষকতা করেন। আমরা সবাই মিলে তাঁর বাড়িতে গেলাম। আর আমি তো তখন একা না; বাবা-মা, আমার স্ত্রী, সন্তানেরা, সঙ্গে ভাইয়ের ছেলেমেয়েসহ অনেক বড় একটা দল ছিলাম। সবাই মিলে ওই বাসায় খাওয়াদাওয়া করলাম। সন্ধ্যার দিকে আমরা বাইরে ঘুরতে গেলাম। সবাই মিলে কেনাকাটা করলাম, খাওয়াদাওয়া করলাম, সিনেমা দেখলাম। আমি আসলে খুবই চিন্তায় ছিলাম বাবা-মাকে নিয়ে। দেশের বাইরে ঈদটা তাঁরা কেমন উপভোগ করবেন—সেটাই ছিল চিন্তার বিষয়। পরে বুঝলাম, কুয়ালালামপুরে করা ঈদটা তাঁদের খুব ভালো লেগেছে। যে ব্যাপারটি তখন মিস করেছিলাম, সেটা হলো, দেশের পরিচিত সব বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে ঈদের দিনে কাটানো সময়টা।

‘আজ তো ঈদ, জানো না?’
ফেরদৌস
’৯৭ সালের দিকে হঠাৎ বৃষ্টি ছবির ডাবিংয়ের কাজে আমাকে কলকাতায় যেতে হয়েছিল। দুই-তিন দিন সেখানে থেকে কাজ শেষ করে ঈদের দিন সকালেই আমার ফেরত আসার কথা। কিন্তু কিছু সমস্যার কারণে ডাবিং শেষ হয়নি সময়মতো। প্রথম ছবি ছিল বলে অন্য রকম একটা সিরিয়াসনেস আর উত্তেজনাও ছিল মনের মধ্যে। তাই দুই দিন ডাবিং করার পর মাথা থেকে ঈদের চিন্তা একেবারেই দূর হয়ে গেল।
একদিন সকালে ডাবিং করতে বেরিয়েছি, সঙ্গে ছিলেন বাসুদা (পরিচালক বাসু চ্যাটার্জি)। হঠাৎ করেই দেখলাম, রাস্তায় টুপি মাথায়, পাঞ্জাবি পরা অনেক লোক আসা-যাওয়া করছে। সূর্য উঠে গেছে অনেক আগেই, ফজরের নামাজ পড়া লোকদের এত দেরি করে বাসায় ফেরার কথা নয়। এই ভেবে বাসুদাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘দাদা, ওরা কোত্থেকে আসছে, এটা কি মুসলিম এলাকা?’ বাসুদা আমাকে অবাক করে দিয়ে বললেন, ‘আজ তো ঈদ, জানো না?’ আমার হঠাৎ করেই খুব মন খারাপ হয়ে গেল। দাদা আমার অবস্থা দেখে জিজ্ঞেস করলেন, ডাবিং বাতিল করবেন কি না? আমি দেশে ফিরে যাব কি না? আমি ‘না’ বললাম। বাসুদা তারপর আমাকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিলেন, ঈদের দিনে আমরা কী করি। শোনার পর বললেন, ‘মন খারাপ কোরো না, আজ যে আনন্দ থেকে তুমি বঞ্চিত হলে, একদিন এই আনন্দটাই কয়েক গুণ হয়ে তোমার কাছে ধরা দেবে।’ বিকেলে যখন ডাবিং শেষ হলো, বাসুদা তখন আমাকে তাঁর মেয়ে আর মেয়েজামাইয়ের সঙ্গে একটা রেস্টুরেন্টে নিয়ে গেলেন। আসলে আগে থেকেই তাঁদের দুজনের মাধ্যমে সবকিছুর আয়োজন করে রেখেছিলেন বাসুদা। আমরা একসঙ্গে রাতের খাবার খেলাম। তারপর বাসুদা আমাকে তাঁর এক মুসলিম বন্ধুর বাসায় নিয়ে গেলেন। বাসায় যখন ফিরি, তখন দেশের ঈদের দিনগুলোর কথা মনে পড়ছিল খুব।

মরুভূমির বুকে ঈদ
মাহফুজ আহমেদ
তোমার দোয়ায় ভালো আছি মা-এর সিকুয়াল মাগো তোমার জন্য নাটকের শুটিং করতে পুরো টিমসহ আমরা গত বছর কাতারে গিয়েছিলাম। মোট ১৭ দিন সেখানে শুটিং করতে হয়েছিল। কোরবানির ঈদটা ছিল সে সময়ই। বাংলাদেশে মানুষ যখন ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা আর আনন্দে ঈদ উদ্যাপন করছে, আমরা তখন ৩৭ থেকে ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় মরুভূমির বুকে শুটিং করে চলেছি! তখন মীর সাব্বির উট চরাচ্ছে, সুইটি একজন আরব শেখের বাড়িতে গৃহপরিচারিকার কাজ করছে, ফজলুর রহমান বাবু, সিদ্দিক, ফারুক আহমেদসহ অন্যরা নির্মাণশ্রমিক হয়ে দালান নির্মাণ করছে। এমন একটা কাজের মধ্য দিয়েই ঈদটা পার হয়ে গেল। আমরা কেউ বুঝতেই পারিনি, ওটা ঈদের দিন ছিল। কিন্তু মজার কিছু ব্যাপার লক্ষ করেছি সে সময়। আমাদের এখানে যেমন কোরবানির ঈদে রাস্তায় রাস্তায়, যেখানে-সেখানে ব্যাপক আনন্দের মধ্য দিয়ে পশু কোরবানি হয়, ঈদের জামাতে সবাই মহা-আনন্দে একসঙ্গে শামিল হয়, সেখানে তেমন কিছুই দেখলাম না। ওরা সবাই দিনের সব নামাজই জামাতে আদায় করে আর ঈদের নামাজও একইভাবে আদায় করে। তাই আলাদাভাবে বোঝার কোনো উপায় ছিল না যে কখন ঈদের নামাজ হয়েছে।
লক্ষ করলাম, পশু জবাই বা কোরবানির জন্য ওখানে একটা আলাদা জায়গা থাকে, সেখানেই কোরবানি দেওয়া হয়। তাই পুরো কাতারে তেমন কিছুই চোখে পড়েনি তখন। কিন্তু সেদিন সন্ধ্যায় যখন কাজ শেষে হোটেলে ফিরি, তখন দেশটাকে খুব মিস করেছি। আমার মেয়ে হওয়ার পর প্রথম ঈদটিতে আমি তার পাশে থাকতে পারিনি, সেটা যেমন আমাকে কষ্ট দিচ্ছিল, তেমনি সব সময়ের মতো ঈদের দিনটিতে মাকে সালাম করতে পারিনি বলে মন খারাপ হয়েছিল খুব।

হোটেলের নিচে খাসি
শারমিন লাকি
দু-তিন বছর আগে আমি প্রথমবারের মতো দেশের বাইরে ঈদ করলাম। আমার শ্বশুরবাড়ি মুর্শিদাবাদে, আর সেখানে ঈদ করার উদ্দেশ্যেই আমাদের কলকাতায় যাওয়া। আমরা যেদিন কলকাতায় গেলাম, তার পরদিন সেখানে ঈদ। কিন্তু রাস্তাঘাট, শপিং মলসহ কোথাও ঈদের তেমন কোনো আয়োজন দেখতে পাইনি। কিন্তু খেয়াল করেছিলাম, আমরা যে হোটেলে উঠেছিলাম, সে হোটেলের নিচে সেদিন হরিণের মতো দেখতে তিন-চারটা সুন্দর খাসি বাঁধা ছিল। খাসিগুলো দেখে খুব মায়া লাগছিল। পরদিন এগুলোকে কোরবানি দেওয়া হবে।
ঈদের দিন সকালে যখন আমরা বাইরে ঘুরতে বের হলাম, তখন রাস্তার আশপাশে কোথাও কোনো পশু কোরবানি করতে দেখিনি। ওটা যে ঈদের দিন ছিল, সেটা বোঝার উপায় ছিল না। মাঝেমধ্যে টুপি মাথায় পরা কিছু মুসলিম লোক দেখেই একটু বোঝা গেল আজ ঈদ। বাংলাদেশে ঈদের দিনটির কথা তখন মনে পড়ছিল খুব। কত হাসি-আনন্দের মধ্য দিয়েই না আমরা এ দিনটি উদ্যাপন করি। সারা দিন আমরা কলকাতার বিভিন্ন জায়গায় ঘোরাঘুরি করলাম। রাতের দিকে আমাদের এক আত্মীয়ের বাসায় প্রথম ঈদের মাংস খেলাম। পরদিন শ্বশুরবাড়ি মুর্শিদাবাদে গিয়ে ঈদে কোরবানি করা গরুর মাংস খেলাম। এভাবেই কেটে গেল দেশের বাইরে কাটানো আমার প্রথম ঈদটি।

খুব মন খারাপ ছিল
নাদিয়া
দেশের বাইরে অনেকবারই ঈদ করা হয়েছে। কিন্তু প্রথমবারের মতো বাইরে ঈদ করেছিলাম তুরস্কে, নব্বই সালের দিকে। কামাল আতাতুর্কের জন্মদিন উপলক্ষে তখন সেখানে আমরা একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। সফরটা অনেক লম্বা ছিল বলে তার মধ্যেই আমাদের ঈদ উদ্যাপন করতে হয়েছিল। তো ঈদের আগের দিন আমাদের অনুষ্ঠান ছিল, সেটা শেষ করলাম। ওদের দেশের নিয়ম অনুযায়ী, আমাদের প্রত্যেক মেয়েকে একেকটা আলাদা পরিবারের সঙ্গে থাকতে হয়েছিল। ঈদের আগের রাতে দেখলাম, ওরা ওদের মতো করে ঈদের প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু দোকানে বা শপিং মলে গিয়ে জামাকাপড় কেনা, মেহেদি পরা—এসব ব্যাপার কারও মধ্যে দেখিনি। ছোট ছিলাম বলে খুব মন খারাপ হচ্ছিল দেশের ঈদের দিনটির কথা চিন্তা করে। তারপর ঈদের দিন সকালে যথারীতি আমি ওদের বাসার মেয়েটার সঙ্গে চুপচাপ বসে থাকলাম। দুপুরের দিকে ওরা আমাকে ওদের পাশের একটা বাড়িতে বেড়াতে নিয়ে গেল। দুপুরের দিকে মা ফোন করলেন খোঁজখবর নিতে। খুব মন খারাপ করে ছিলাম, সেটা মা বুঝতে পেরেছিলেন। সন্ধ্যার দিকে আমরা সবাই আবার একসঙ্গে হলাম। তখন কিছুটা মজা করলাম। এককথায় বলতে গেলে জীবনের সবচেয়ে খারাপ ঈদটি পার করেছিলাম সেই সময়।
সহযোগিতায়: আলতাফ শাহনেওয়াজ, শফিক আল মামুন, আবদুল ওয়াজেদ ও দেব দুলাল গুহ