নতুন এক প্রজন্ম

মার্কিন চলচ্চিত্র সমালোচক রজার এবার্টকে বলা যায় তারকা সমালোচক। তিনিই প্রথম চলচ্চিত্র সমালোচনা করে পুলিৎজার পুরস্কার পেয়েছিলেন। ২০০৫ সালে তিনি হলিউডের ওয়াক অব ফেমে সম্মানিত হন, যেটা চলচ্চিত্র সমালোচকও হিসেবেও প্রথম। মার্কিনিদের মধ্যে রজার এবার্টের মতো এত জনপ্রিয় ও বিখ্যাত হননি কোনো সমালোচক। দুই শতাধিক পত্রিকায় ছাপা হয়েছে তাঁর চলচ্চিত্র সমালোচনা। লিখেছেন ১৫টির বেশি বই। ১৯৭৫ সাল থেকে জিন সিসকেলের সঙ্গে টেলিভিশনে চলচ্চিত্র সমালোচনাকেও বেশ জনপ্রিয় করে তোলেন রজার এবার্ট। তিনি মৃত্যুর আগপর্যন্ত শিকাগো সান-টাইমসে লিখতেন। ২০০২ সালে তাঁর চলচ্চিত্র সমালোচনার আর্কাইভ হিসেবে চালু করা হয় রজার এবার্ট ডট কম নামে একটি পোর্টাল। পাশাপাশি অন্যান্য চলচ্চিত্র সমালোচকদের সমালোচনাও প্রকাশিত হয়। এই পোর্টালের বর্তমান সম্পাদক কান চলচ্চিত্র উৎসবের এবারের আসরে দেখানো তিনটি ছবি রেহানা মরিয়ম নূর, এভল্যুশন ও দ্য স্টোরি অব ফিল্ম: আ নিউ জেনারেশন–এর সমালোচনা প্রকাশ করেন। সেখান থেকে রেহানা মরিয়ম নূর–এর অংশটির স্বচ্ছন্দ অনুবাদ প্রকাশিত হলো।

‘রেহানা মরিয়ম নূর’ চলচ্চিত্রে বাঁধন

এ বছরের কান চলচ্চিত্র উৎসবে কিছু ব্যতিক্রম আছে, এরপরও একটি বিষয় কিন্তু একই রয়ে গেছে: পৃথিবীর যেকোনো জায়গার তুলনায় সবচেয়ে বৈচিত্র্যপূর্ণ চলচ্চিত্র ইভেন্টের একটি কান। তিনটি সিনেমার কথাই ধরুন, যেগুলো দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। মিডওয়েস্টের তুলনামূলক আরাম পরিহার না করে কাজটা আমি করেছি। আর এ জন্য বোতলে থুতু দিয়েও প্রমাণ করতে হয়নি যে আমি কোভিডমুক্ত। গল্প বলার ধরন বিবেচনায় তার মধ্যে দুটি ছবিকে যথার্থ্যই বলা যায় বিষণ্ন ভাবাপন্ন। চরিত্রগুলোকে তারা এমন আলাদাভাবে মোকাবিলা করেছে যে সম্পূর্ণ অনন্য এক সুর পেয়েছে সেগুলো।

ব্রায়ান টলারিকো

এই তিন ছবির মধ্যে সবদিক থেকেই সেরা আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদের শক্তিশালী রেহানা মরিয়ম নুর। সীমাবদ্ধ দৃষ্টিকোণ এবং নৈপুণ্যের পরিশীলন কেন্দ্রীয় চরিত্র আজমেরী হক বাঁধনকে দিয়েছে আবেগের গভীরতা।

তিনি মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক আর ইমু (অবিশ্বাস্য সাবলীল অভিনয় করেছে আফিয়া জাহিন জাইমা) নামের হাশিখুশি একটি মেয়ের সিঙ্গেল মা। রেহানা এমন একজন মানুষ, যে অন্যের কাছ থেকে সর্বোচ্চটা আশা করে, যদিও তাঁর ঊর্ধ্বতন (কাজী সামি হাসান) তাঁকে ছাত্রছাত্রীদের দেখভালের সময় কিঞ্চিৎ ছাড় দিতে উৎসাহিত করে।

একবার অনেক রাতে রেহানা স্কুলে আছে, সে শুনতে পায় তার পাশের ঘরেই ঊর্ধ্বতনের কার্যালয়ে একজন তরুণীকে হেনস্তা করা হচ্ছে। এনি (আফিয়া তাবাসসুম বর্ণ) নামের এক ছাত্রী বের হয়ে আসে। সে বুঝতে পারে যে এইমাত্র যা ঘটেছে, রেহানা তা জানে। কিন্তু হেনস্তার বিষয়টি রিপোর্ট করার ব্যাপারে তার শিক্ষকের অনুরোধ রাখতে সে অস্বীকৃতি জানায়। কিন্তু রেহানা এটা ছেড়ে দিতে পারে না। বিষয়টি নিয়ে সে উত্তরোত্তর অবসেসড হয়ে পড়ে। জঘন্য একটা অপরাধ শাস্তি ছাড়াই পার পেয়ে যাবে—এই চিন্তা তাকে কুড়ে কুড়ে খেতে থাকে ।

কান চলচ্চিত্র উৎসবে দেখানো হয় আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদের সিনেমা ‘রেহানা মরিয়ম নূর’
ছবি: সংগৃহীত

মিত্রতাকে কীভাবে আমরা সংজ্ঞায়িত করি এবং একজন খারাপ মানুষ কত অনায়াসে লাগামছাড়া কাজ চালিয়ে যায়—রেহানা মরিয়ম নুর তার এক আকর্ষণীয় পর্যালোচনা। সত্য হচ্ছে, অধ্যাপকের বিরুদ্ধে এনি যদি হেনস্তার অভিযোগ দায়ের করে, তাহলে তার জীবন বরবাদ হয়ে যাবে। কঠিন শিক্ষাজীবনে যা কিছু সে অর্জন করেছে, সব জলে যাবে। এমন কিছু ঘটুক, বোধগম্য কারণেই এটা সে চায় না। তাই রেহানা তুখোড় একটা পরিকল্পনা আঁটে। ঊর্ধ্বতনদের সে বলবে, এনি নয়—সেই বরং ধর্ষিত হয়েছে। যত বিষয়টির গভীরে যেতে থাকে রেহানা, তত সে বেপরোয়া হয়ে ওঠে, আর সাদের ছবিটা হয়ে ওঠে প্রায় থ্রিলার। চঞ্চলমতি এক ক্যামেরাকে সে কাজে লাগায়, সব সময়ই যে চলমান, জঙ্গম। এটা যা কিছু ঘটছে, তার অনিশ্চয়তার প্রতিফলন—দর্শক ও কেন্দ্রীয় চরিত্র উভয়ের দিক থেকেই।

সাদ দারুণ সফলভাবে তাঁর কেন্দ্রীয় চরিত্রের দৃষ্টিকোণের সঙ্গে আমাদের বেঁধে ফেলেন। কাজটা তিনি করেন প্রতিটি দৃশ্যে তাকে রেখে আর অফিস, ক্লাসরুম ও হাসপাতালের করিডর থেকে একবারও না বেরিয়ে। পটভূমি ক্লস্ট্রোভোবিয়াভাবকে (আবদ্ধভীতি) আরও জোরদার করেছে। সেটাকে আরও প্রবল করেছে নীল রং। প্রায়ই জানালার ভেতর দিয়ে রেহানাকে আমরা দেখতে পাই এবং বিভিন্ন পৃষ্ঠতলে তাকে প্রতিবিম্বিত হতে দেখি। যেন দুঃস্বপ্নের এই জগতে সে ত্রিমাত্রিকের চেয়ে ঊন কিছু হয়ে উঠছে। ন্যায়বিচার অস্বীকার করে, এমন এক ব্যবস্থায় যেন সে বিলীন হয়ে যাচ্ছে।

‘রেহানা মরিয়ম নূর’ চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্য
সংগৃহীত

ছবিটার এক ঘণ্টার কাছাকাছি সময়ে টানটান একটা দৃশ্যে যেখানে একজন শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয় রেহানা, এরপর থেকে ছবিটার যেখানে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া উচিত ছিল, সেখানে এসে ছবিটা কেমন যেন পশ্চাদপসারণ করে। কিন্তু চূড়ান্ত দৃশ্যে এমনভাবে প্রথম দৃশ্যটার প্রতিধ্বনি করে, যা খুবই কার্যকর। কানে প্রথম বাংলাদেশি চলচ্চিত্র, ভবিষ্যতেও যার দিকে খেয়াল রাখতে হবে।


ব্রায়ান টলারিকো রজার এবার্ট ডটকমের সম্পাদক এবং শিকাগো ফিল্ম ক্রিটিকস অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট। এ ছাড়া তিনি ভলচার, দ্য প্লেলিস্ট, দ্য নিউইয়র্ক টাইমস, রোলিং স্টোনের জন্য লেখেন।