নাট্যশালা যেন আরণ্যক হয়ে গিয়েছিল

উৎসব উপলক্ষে অনেক দিন পর মঞ্চে এসেছিল ইবলিশ
উৎসব উপলক্ষে অনেক দিন পর মঞ্চে এসেছিল ইবলিশ

এমন দৃশ্য দেখে মুগ্ধ না হয়ে থাকা যায়! অন্তত যিনি মঞ্চ নাটক ভালোবাসেন, এ পাড়ায় যার নিত্য আসা-যাওয়া, তিনি তো মুগ্ধ হবেনই।

একটু বাড়াবাড়ি মনে হচ্ছে কি? তাহলে শুনুন সেই দিনগুলোর কথা। প্রতি সন্ধ্যায় শিল্পকলার দুই মিলনায়তনে নাটক। সেখানে ঢোকার জন্য টিকিট কাউন্টারের সামনে মানুষের সারি। বিকেলে নাট্যশালা চত্বরের বাইরে নাচ, গান। নানা বর্ণের, নানা ভাষার শিল্পীদের ছোটাছুটি। আড্ডা, ভিড়—সব জায়গায় উৎসবের রং। বলতেই হয়, দলের ৪৫ বছর পূর্তিতে আরণ্যকের উৎসবটি যেমন সফল হয়েছে, তেমনি সত্যিকার অর্থে আন্তর্জাতিক রূপ পেয়েছে।

শেষ দিনের কথা বলি। সেদিন ২৮ অক্টোবর, শনিবার। জাতীয় নাট্যশালায় ঢুকতে ঢুকতে কেন যেন রবীন্দ্রনাথকে মনে পড়ছিল, ‘এল যে শীতের বেলা বরষ-পরে...’। সিঁড়ির সামনের করিডরে দর্শকের ভিড়ের চাপে সামনে এগোনোর উপায় নেই। নিরুপায় হয়ে নিচেই দাঁড়াই। সেখানে দাঁড়িয়ে আড্ডা দিচ্ছিলেন মামুনুর রশীদ, মান্নান হীরা, গোলাম কুদ্দুছ, আহমেদ গিয়াস, আখতারুজ্জামানসহ আরও কয়েকজন। উৎসব উপলক্ষে বানানো একটি উত্তরীয় গায়ে জড়িয়েছেন মামুনুর রশীদ। কথায় কথায় তিনি বলছিলেন, ‘অর্ডার দেওয়ার সময় বলছিলাম এমনভাবে বানাবা, যেন শীতেও ব্যবহার করা যায়।’

মনে মনে ভাবলাম, তাহলে এই চাদরটাই কি উৎসবের প্রতীক হয়ে গেল? শীতে যেমন নাট্যাঙ্গন পুরোদমে জমে ওঠে, উৎসবটিও যে তা-ই। জমিয়ে দিল ঢাকার নাটকপাড়া। শীতের আগেই বসন্ত দিয়ে গেল।

প্রথম দিনের কথা শুনুন। ২২ অক্টোবর রোববার। সন্ধ্যা নামার আগেই শিল্পকলা একাডেমির নন্দন মঞ্চের চারপাশে শুধু মানুষ আর মানুষ। নাটকের উৎসবে এমন জমায়েত অনেক দিন দেখা যায়নি ঢাকায়। বিচিত্র সেদিনের আয়োজন। মাদল বাজিয়ে উৎসবের উদ্বোধন করেন শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরীর সহধর্মিণী নাট্যজন লিলি চৌধুরী। এ প্রজন্মের দর্শকদের অনেকেই সেদিন প্রথম দেখলেন তাঁকে। তাঁর কথা শোনার অভিজ্ঞতার পাশাপাশি দর্শক মুগ্ধতা নিয়ে দেখল সাঁওতালি আধুনিক, ধ্রুপদি নাচের নান্দনিক পরিবেশনা। নাটক ও আরণ্যক নিয়ে বলেছিলেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, নরওয়ের রাষ্ট্রদূত সিডসেল ব্লিকেন, ইরানের রাষ্ট্রদূত আব্বাস ভায়েজি দেহনাভি, সংস্কৃতিজন রামেন্দু মজুমদার, লিয়াকত আলী ও গোলাম কুদ্দুছ। আরণ্যকের পক্ষে মামুনুর রশীদ ও মান্নান হীরা তো ছিলেনই। সেদিন উদ্বোধনের পরে দর্শকের একটা অংশ পূর্ণ করেছিল জাতীয় নাট্যশালার সব কটি আসন। সেখানে মামুনুর রশীদ, তুষার খান, ফজলুর রহমান বাবু, আজিজুল হাকিমদের ইবলিস নস্টালজিক করেছিল বয়সে প্রবীণ দর্শকদের। যারা আশির দশকে মঞ্চ নাটকের দর্শক হয়েছিলেন।

২২ থেকে ২৮ অক্টোবর—প্রতিটা দিন বিকেলে, সন্ধ্যায় নাট্যানুরাগীদের গন্তব্য হয়েছিল জাতীয় নাট্যশালা। জাতীয় নাট্যশালা, পরীক্ষণ থিয়েটারের সব কটি প্রদর্শনীতে দর্শকের প্রাণবন্ত উপস্থিতি। উপস্থিতি ছিল জাতীয় নাট্যশালা চত্বরে। ঢাকার মঞ্চ নাটকের আন্তর্জাতিক উৎসবের বেশির ভাগই ছিল শুধু প্রতিবেশী দেশের উপস্থিতি। এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছিল আরণ্যকের উৎসবটি। ইরান, হংকং, নরওয়ের নাট্যকর্মীদের পরিবেশনা দেখা ছিল ঢাকার দর্শকের জন্য বাড়তি পাওয়া। শিল্পের একটা নিজস্ব ভাষা রয়েছে, যা মানুষের ভাষা ছাপিয়ে যায়—এ উৎসবে সেটা আবার প্রমাণিত হলো। উৎসবে পাঁচ নারী পরিচালকের নাটকের বিষয়টিও আলাদা আগ্রহের বিষয় ছিল।

শেষ দিনের কথাই বলি। হংকংয়ের নাট্যদলের ভিন্নধর্মী প্রযোজনাটির নাম ছিল দ্য থার্ড টাওয়ার অব বাবেল, যার বাংলা নাম দাঁড়ায় ‘বাবেলের তৃতীয় স্তম্ভ’। সেদিন শনিবার উৎসবের সমাপনী সন্ধ্যায় জাতীয় নাট্যশালার সিঁড়িসহ নানা জায়গা ব্যবহার করেছিল হংকংয়ের নাট্যদল এশিয়ান পিপলস থিয়েটার ফেস্টিভ্যাল সোসাইটির শিল্পীরা। নাচের সঙ্গে অভিনয় এবং সুরের সম্মেলন দেখে দর্শকের আগ্রহ অনুভূতি জানান দেয় শিল্পের চিরন্তন ভাষাটির কথা। পুরোনো হংকংয়ের সাম সুই পো এলাকার পরিবেশ ও মানুষকে নিয়েই এই প্রযোজনাটিতে বলা হয়েছে সেসব আদিবাসীর কথা, যাদের অধিকাংশই ইন্দোনেশিয়া থেকে হংকংয়ে এসেছিল। ভাগ্যের অন্বেষণে আসা হতদরিদ্র এসব মানুষ এবং তাদের প্রাণশক্তির বিষয়ে সারা বিশ্বের মানুষকে জানানোই এই নাটকের মূল লক্ষ্য বলে জানালেন নাটকটির নির্দেশক গ্যাড লিঙ। ইরানের নাটকটিতে সাবটাইটেলের ব্যবহার ছিল, দর্শক সহজেই নাটকের গল্পে ঢুকতে পেরেছিল। নরওয়ের নাটকে শরীরী ভাষার আধিপত্য ছিল বলে সেটা আরও সহজ হয়েছে দর্শকের কাছে।

শুধু সাধারণ দর্শক নয়, মঞ্চনাটকে নিবেদিত নবীন-প্রবীণদের কাছে উৎসবটি সাড়া ফেলেছিল। তিন দিন উৎসবের রং মেখেছিলেন গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের সাবেক মহাসচিব ঝুনা চৌধুরী। বললেন, আরণ্যককে আমরা বলি ‘এভরি ডে থিয়েটার’। প্রতিদিন থিয়েটার চর্চাকারী দল। সেই আরণ্যকের কাছে একটি উৎসবে যেমনটি আমরা চাই, তার শতভাগ পেয়েছি। এখানে এসে পুরোনো অনেকের সঙ্গে দেখা হয়েছে, আড্ডা হয়েছে। মনে হয়েছে, নিজের একটি দলের আয়োজন হচ্ছে।’ জ্যেষ্ঠ অভিনেতা, নির্দেশক ও থিয়েটার আর্ট ইউনিটের প্রধান সমন্বয়ক মোহাম্মদ বারী শেষ দিন এসেছিলেন নাটক দেখতে। এবারের আয়োজনটিকে আরণ্যকের অন্য উৎসবগুলোর থেকে আলাদা মন্তব্য করে মোহাম্মদ বারী বললেন, ‘চোখে লাগার মতো একটি আয়োজন। সত্যিকার অর্থে একটি আন্তর্জাতিক উৎসব।’

আরণ্যকের শুরুর দিকে কথা শুনেছিলাম মামুনুর রশীদের কাছে। এ কথা হয়তো অনেকেই জানেন, স্বাধীনতার পর দেশে ফিরে ১ ফেব্রুয়ারিতেই আরণ্যক নাট্যদল গঠন করা হয়। নামটি দিয়েছিলেন আবদুল্লাহ আল মামুন। মামুনুর রশীদ বললেন, ‘টেলিভিশনে বসে আবদুল্লাহ আল মামুনের সঙ্গে কথা হচ্ছিল, বলেছিলাম, “একটা নাটকের দল করব, কী নাম দেওয়া যায়?” আবদুল্লাহ আল মামুন বললেন, “নাগরিক তো আছেই, তোমরা আরণ্যক হয়ে যাও।” তারপরই নাম দিলাম “আরণ্যক”।’
অক্টোবরের শেষ সপ্তাহটা জাতীয় নাট্যশালা যেন আরণ্যক হয়ে গিয়েছিল।