নানা রঙে রঙিন টিভি ও ওয়েব প্রযোজনা
>

এক দশকের ভিডিও ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে অল্প কথায় কিছু লেখা বেশ কঠিন। অনেক সময় স্মৃতিও প্রতারণা করে, গুরুত্বপূর্ণ অনেক কিছু বাদ পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। তারপরও চলতি দশকে বাংলাদেশি নাটক, টেলিছবি ও ভিডিও প্রযোজনার সামগ্রিক চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন নির্মাতা রেদওয়ান রনি
ধারাবাহিকের সুবাতাসের শেষ হাওয়া
দশকের শুরুর দিকে টিভির দর্শক কয়েকটি ধারাবাহিক যেমন তোমার দোয়ায় ভালো আছি মা, গ্র্যাজুয়েট, এফএনএফ, চৈতা পাগলা, চাঁদের নিজের কোনও আলো নেই, এইম ইন লাইফ, ফিফটি ফিফটি ইত্যাদি ধারাবাহিক গুলো নিয়মিতই অনুসরণ করতো বলা চলে। যা আগের দশকের একান্নবর্তী, ৬৯, রঙের মানুষ, রমিজের আয়না, হাউজফুলের ই সাফল্যের রেশ। কিন্তু এরপর পর ধারাবাহিক গুলো তাদের শ্রী হারাতে শুরু করে। যতদূর বুঝি যে, টেকনোলজি চেঞ্জের সাথে প্রোডাকশনের খরচের ব্যয় বৃদ্ধি পেলেও নির্মাণের বাজেট কমতে থাকে টিভি ইন্ডাস্ট্রির ব্যবসায় অসম প্রতিযোগিতার কারনে। কাজেই কন্টেন্ট শক্তিশালী না করে সবাই ফুটেজ বানানোর প্রতিযোগিতায় নেমে পরায়, জনপ্রিয়তা কমতে শুরু করে এসব ধারাবাহিকের। একটা বড় সময় সেই অর্থে টিভিতে দেখার মতো ধারাবাহিক ই আর থাকে না। আঞ্চলিক ভাষায় গ্রামের পটভূমি তে নির্মিত ধারাবাহিক গুলো শুরুতে জনপ্রিয়তা পেলেও ধীরে ধীরে এগুলোতেও একঘেয়েমি চলে আসতে শুরু করে।
তবে দশকের প্রথমার্ধে নির্মিত এক ঘন্টার ভিডিও ফিকশন গুলো আজও দর্শকের মন জয় করে থাকে। উল্লেখযোগ্য, কাঁটা (অনিমেষ আইচ), সেলুলয়েড ম্যান (ইফতেখার আহমেদ ফাহমি), ফেরার পথ নেই, থাকে না কোনকালে (মেজবাউর রহমান সুমন), পাড়ি (ওয়াহিদ আনাম), নীলপরি নীলাঞ্জনা (শিহাব শাহিন), ভালোবাসি তাই ভালোবেসে যাই (শিহাব শাহিন), ল্যান্ডফোনের দিনগুলিতে প্রেম (আশফাক নিপুণ),@ ১৮ অলটাইম দৌড়ের উপর (আদনান আল রাজীব), সুবর্ন পুর বেশী দূর নয় (রেদওয়ান রনি), মনপুরা জংশন (শিহাব শাহিন), মিডলক্লাস সেন্টিমেন্ট (আদনান আল রাজীব), ভালোবাসা ১০১ (রেদওয়ান রনি), মনফড়িং এর গল্প (শিহাব শাহিন), সার্ভিস হোল্ডার (সালাহউদ্দিন লাভলু), বিনি সুতোর টান (শিহাব শাহিন), রুপা (চয়নিকা চৌধুরী), রাতারগুল (সুমন আনোয়ার), শত ডানার প্রজাপতি (মাবরুর রশিদ বান্নাহ) সহ কাছে আসার গল্পের কিছু ফিকশন জনপ্রিয়তা পায়। এছাড়াও ঈদের মিনি সিরিজ হিসেবে সিকান্দার বক্স, পিন্টু-মিন্টু সিরিজ-বিহাইন্ড দ্যা সিনের পরবর্তী ভার্সন, আরমান ভাই সিরিজ ও জমজ (শুরুর দিকের সিজন) গুলো বেশ জনপ্রিয়তা পায়।
অনলাইন কন্টেন্টের বাজার শুরু
টিভি কনটেন্টের দুর্দিনে অনলাইন প্ল্যাটফর্ম নতুন বাতাস নিয়ে হাজির হয় এই দশকেই। দশকের মাঝামাঝি সময়ে থার্ডবেল, পপকর্ন লাইভ ও র্যাবিটহোল যাত্রা শুরু করে। শুরুতে মৌলিক প্রযোজনাগুলো দর্শক বিনামূল্যে দেখা শুরু করে। কিন্তু কিছুদূর এগোতে না–এগোতেই দেশীয় বেশির ভাগ স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মকে তুড়ি মেরে ইউটিউব রাজত্ব শুরু করে দুনিয়াজুড়ে। এর তোড়ে প্রভাবিত হয় বাংলাদেশের কন্টেন্ট ইন্ডাস্ট্রিও। নতুন দৃশ্যায়নে মিউজিক ভিডিও তৈরি হয়, এগুলোর আবার লক্ষ–কোটি ‘ভিউ’ হতে থাকে। দেশীয় ইউটিউব চ্যানেলগুলোর সাবস্ক্রাইবার বাড়তে থাকে হু হু করে।
মিউজিক ভিডিওর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অনলাইনে ফিকশনের চাহিদা ও জনপ্রিয়তাও বাড়তে থাকে। ভিকি জাহেদসহ অনেকে ভিডিও শেয়ারিং প্ল্যাটফর্মে শর্টফিল্মের জন্য দর্শক তৈরি করতে থাকে। সেই সঙ্গে বিভিন্ন ব্র্যান্ডও তাদের ব্যানারে নির্মাণ করতে থাকে নাটক, স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমা ও মিউজিক ভিডিও। লাভ এক্সপ্রেস, ট্রিবিউট টু লিজেন্ডসহ বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক স্বল্পদৈর্ঘ্যে চলচ্চিত্র/মিউজিক্যাল ফিল্ম তৈরি করার চল শুরু হয়। এর মধ্যে মিজানুর রহমান আরিয়ানের বড় ছেলের সাফল্য উল্লেখযোগ্য। এই নাটকে মেহ্জাবীনের কান্নার দৃশ্যের অভিনয় প্রশংসা পায়। সেই সঙ্গে অনলাইনে আলোচনায় চলে আসে ও জনপ্রিয়তা পায় অপূর্ব, আফরান নিশো, তানজিন তিশাদের অভিনয়ও। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ‘শেয়ার’ আর ‘ভিউ’র কারসাজিতে ‘কন্টেন্ট মার্কেটিং’ বা প্রযোজনার বিপণন এই দশকে পৌঁছে যায় এক অনন্য উচ্চতায়। বাঙালি দর্শক একবার যা গিলতে শুরু করে, তার বারোটা না বাজা পর্যন্ত আর থামা নেই! নানা ভিডিও প্রযোজনায় মেহ্জাবীনের আদলে কান্না বেচা শুরু হয়ে, ফলে প্রয়োজনে–অপ্রয়োজনে কান্নার দৃশ্যের অতিচিত্রায়নের কারণে এসব প্রযোজনা মুখ থুবড়ে পড়ে। আশার আলো হয় বিভিন্ন উৎসবে নির্মিত দলগত প্রকল্পের অধীনে বানানো প্রযোজনাগুলো। নাটক ও টেলিছবি প্রযোজনার অঙ্গনে সুবাতাস ছড়ায় ছবিয়াল রি-ইউনিয়ন, আয়নাবাজি অরিজিনাল সিরিজ, অস্থির সময়ে স্বস্তির গল্প, ছবিয়াল ভাই বেরাদর এক্সপ্রেসের নান্দনিক সব গল্প। এই প্রকল্পগুলোর অভূতপূর্ব সাফল্যে আর নানা ধরনের বৈচিত্র্যময় গল্পের সংমিশ্রণে আমরা পেয়ে যাই একঝাঁক তরুণ নির্মাতা। ২০১০ সালের দশকের শেষভাগে এসে আবারও আশাবাদী হয়ে উঠি আমরা।
এই দশকেই আমরা পাই বিকাল বেলার পাখি (আদনান আল রাজীব), মার্চ মাসে শ্যুটিং (অমিতাভ রেজা), মিস্টার জনি (রেদওয়ান রনি), সোনালি ডানার চিল (আশফাক নিপুণ), কথা হবে তো? (সৈয়দ আহমেদ শাওকী), বুকের ভেতর কিছু পাথর থাকা ভালো (তানভীর আহসান), ২৬ দিন মাত্র (মুহাম্মদ মোস্তফা কামাল রাজ), মডার্ন টাইমস (মাহমুদুল হাসান আদনান ও নাজমুল নবীন), দি আর্টিস্ট (মাহমুদুল ইসলাম), পাতা ঝরার দিন (রেদওয়ান রনি), আয়শার (মোস্তফা সরয়ার ফারুকী) মতো কিছু বৈচিত্রময় নাটক। এছাড়াও বুকের বা পাশে (মিজানুর আরিয়ান), আশ্রয় (মাবরুর রাশিদ), ব্যাচেলর পয়েন্ট (কাজল আরফিন), মিস শিউলি (আশফাক নিপুণ), আলো (তানিম রহমান), ব্যাচ ২৭ সিরিজ (মিজানুর রহমান), আমাদের সমাজবিজ্ঞান (শাফায়েত মনসুর), কিংকর্তব্যবিমুঢ় (ইফতেখার আহমেদ ফাহমি), এই শহরে (আশফাক নিপুণ) প্রযোজনাগুলোয় পায় দর্শকপ্রিয়তা।
এই দশকে নুসরাত ইমরোজ তিশা, অপি করিম, মম, নাবিলা, মিথিলাসহ গুণী অভিনেত্রীদের অভিনয় টিভির দর্শকদের মুগ্ধ করে রাখে। বিশেষ করে বিভিন্ন উৎসবকে কেন্দ্র করে কিছু নাটকে তাঁদের দেখার জন্য আলাদাভাবে অপেক্ষা করে দর্শক।
প্রতিযোগিতায় প্রযোজনার বাজার
২০১০–এর দশকের শেষভাগ থেকে অনলাইনের জন্য প্রযোজনা তৈরির বাজার ভালো কন্টেন্ট তৈরির প্রতিযোগিতা শুরু করে। যদিও দু–তিনটি জুটিকে কেন্দ্র করে প্রেম ও পরিবারকেন্দ্রিক গল্পের নাটক ও এর ভিউয়ের দৌরাত্ম্যে নান্দনিক প্রযোজনাগুলো কিছুটা কোণঠাসা হয়ে পড়ে। ভিউ গুণে প্রযোজনার সাফল্য নির্ধারণের ব্যাপারে তৈরি হতে থাকে নানা মত।
ওয়েব সিরিজ আর ওয়েব ফিল্মের সময়
বাংলাদেশে নেটফ্লিক্স স্ট্রিমিং শুরুর পর সচ্ছল দর্শকদের মধ্যে নতুন উত্তেজনা দেখা যায়, টরেন্ট সাইট থেকে অবৈধভাবে ডাউনলোড করে সিরিজ আর ফিল্ম দেখার ডামাডোলে বৈধ উপায়ে মৌলিক প্রযোজনা দেখার আগ্রহ বাড়তে শুরু করে। পরবর্তী সময়ে আমাজন প্রাইম এতে আরও বৈচিত্র্যময় মাত্রা যোগ করে। ব্রেকিং ব্যাড থেকে শুরু করে সেকরেড গেমস, আমাজনের মির্জাপুর দেশীয় দর্শকের মনে ওয়েব সিরিজের নতুন ক্ষুধা তৈরি করে। সেই সঙ্গে লাভ পার স্কয়ার ফিট, লাস্ট স্টোরিজ, রোমার মতো ভিনদেশি ওয়েব ফিল্মগুলো দেশের দর্শকের রুচিকে করে সমৃদ্ধ।
দেশের বাজারে বঙ্গ, বায়োস্কোপ, আইফ্লিক্স, পরবর্তীতে হৈচৈ ও এয়ারটেল টিভি প্লাস ওয়েব সিরিজ, মৌলিক ওয়েব প্রযোজনা নিয়ে এই দশকেই মাঠে নামে। অমিতাভ রেজার ঢাকা মেট্রো, কৃষ্ণেন্দু চট্টোপাধ্যায় ও তানিম নূরের মানি হানি, আবরার আতাহারের কলি ২.০, নুহাশ হুমায়ূনের পিজ্জা ভাইসহ আই ফ্লিক্সের কিছু প্রযোজনা দর্শকদের ভিডিও স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মের প্রতি আগ্রহী করে তোলে। আরও একটি আশার খবর দিয়ে শেষ করি, দেশীয় কন্টেন্ট ইন্ডাস্ট্রিতে নতুন দশকের শুরুতেই যুক্ত হচ্ছে নতুন ভিডিও স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম প্রদর্শন। ২০১৯–এর শেষে কাজ শুরু হওয়া প্ল্যাটফর্মটি নতুন দশকের শুরুতেই যাত্রা করবে বৈচিত্র্যময় সিরিজ, সিনেমা ও মৌলিক সব প্রযোজনা দিয়ে।