ফিরোজা রং নক্ষত্র

ফিরোজা বেগম ও ফ​াতেমা তুজ জোহরা
ফিরোজা বেগম ও ফ​াতেমা তুজ জোহরা

ফিরোজা বেগম। আমাদের ফিরোজা বেগম। আমাদের ফিরোজা আপা। কেউ ভাবেন, তিনি মুকুটহীন সম্রাজ্ঞী। এত বড় ধৃষ্টতা কোথা থেকে পাই আমরা যে তিনি মুকুটহীন সম্রাজ্ঞী—এটা ভাবতে? সম্রাজ্ঞী মানেই তো মুকুটশোভিত। অবশ্যই তাই হওয়া উচিত। তবে কেন এমন লৌকিক স্থূল নামকরণ? তিনি সম্রাজ্ঞী, কোহিনূরের মতো দুর্লভ রত্নে নন বটে; তবে আমাদের অন্তরের শ্রদ্ধা, ভালোবাসা আর সুরের জাদুকরি সুতোয় বুটি তোলা, হীরক-দ্যুতিময় রত্নশোভিত দুর্লভ মাণিক্য-মুকুটশোভিতা। তিনি কি স্বর্গের কোনো লাস্যময়ী হুরি অথবা বাংলার মাটির কোনো ইন্দ্রসভার সুরসম্রাজ্ঞী—জানি না। হয়তো তা জানতামও না আমরা। হঠাৎ কেন জানার ধুম পড়ে গেল! তবে মরণে তিনি কী শিখিয়ে দিয়ে গেলেন? নইলে তিনি বেঁচে থাকতে এই মহোৎসবের ধুম কেন পড়েনি তাঁকে জানবার জন্য, চেনাবার জন্য! চোখ দুটো আমার জলের বানে উথালপাতাল তোড়ে এমন পাগলপারা কেন?
না না, থাক, আজ এসব কথা নয়। এখনো দগদগ করছে ৯ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় অ্যাপোলো হাসপাতালে আইসিইউর করিডোরে মৃদু আলোর চোখগুলো, সেখানকার মেঝে আর দেয়ালের নিস্তব্ধ শীতল বুক, সেখানকার ৩ নম্বর বিছানার চারপাশে নানা রকমের চিকিৎসা-সরঞ্জামের মধ্যে সেই জ্ঞানহীন শায়িতার জীবন-মৃত্যু লড়াইয়ের অদৃশ্য তরবারির শাণিত ধারগুলো। রক্তক্ষরণ করছে আমার বুকের মধ্যকার ঢিপঢিপ শব্দের একেকটি স্বগতোক্তি!
আমাকে নাড়িয়ে যাচ্ছে তাঁর পরিবারের সবার অসহায় করুণ চোখ-মুখগুলো। অনেক অনুরোধেই হাসপাতালের কেউ অনুমতি দিয়েছেন আমাকে আর শাহীন সামাদকে ভেতরে আইসিইউর সেই ৩ নম্বর বিছানার কাছে যেতে। মিনিট পাঁচেক দাঁড়িয়েছি। সেটাই ছিল তাঁর সঙ্গে চিরদর্শন। তার মিনিট ২৫ পরই সব শেষ। সেই অচেনা-অশেষ, অগম পৃথিবীর পথে তাঁর যাত্রা শুরু হলো। ফিরোজা রঙের একখানি জ্যোতির্ময় নক্ষত্র যেন ছিটকে পালাল কোথায় নীলাকাশের চাঁদোয়া থেকে। সেদিন আকাশে উজ্জ্বল পূর্ণিমার চাঁদ তখনো ভেসে ছিল, ঠিক অ্যাপোলো হাসপাতালের মাথার ওপর। আমি ততক্ষণ গাড়িতে। মনে হলো, ওই চাঁদটি আজ অসময়ে কেন আমার পাশে? চাঁদটিকে আমি চিনি না—দেখিনি কখনো। তুমি হাসছ, আলোকিত করার খুশিতে ডগডগ, কিন্তু আমার চারপাশ কেন এত আঁধারে ঘিরে? ‘আধখানা চাঁদ হাসিছে আকাশে...আধখানা চাঁদ নিচে’...!
আরও কিছুক্ষণ পর সেই চাঁদ সত্যিই নিচে মাটির কোলে...আহ্! মাথাটা ধরে গেছে, চোখের জলে বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে। চমকে উঠতেই দেখি, চাঁদখানি আমার গাড়ির জানালার আকাশে দুলছে—আনমনে ভাবনাগুলো প্রশ্ন করল, কোথায় গেলেন তিনি অমন করে কিছু না বলে? এক বুক অভিমান বুকে চেপে ছিল কি তাঁর? কার ওপর অভিমান, নাকি অভিযোগ—যদি বলি আমাদেরই ওপর—তবে কি ভুল হবে? মোটেই না। হায়! আজ একটি আফসোস যেন হাহাকারে, শূন্যতায় আমাদের সব সুর আর গানগুলোকে উড়ুক্কু করে তুলছে। কেউ নেই, কিছু নেই, কবে কীইবা কোথায় ছিল, থাকবে? মন বলছে, তাঁকে আরও একটু কাছে পেলে তাতে কার কী এমন ক্ষতি ছিল, জানি না। কিছু জানি না। শুধু জানি, তাঁর ছায়া-সুর আছে। আছে মোহময়ী রূপের মায়ার ছটা, তাঁর গানের নিটোল টোলের অব্যক্ত-অশ্রুত গানের খেলা। আরও আছে যান্ত্রিক পারঙ্গমতার দুর্লভ শক্তিও। তিনি সেখানেও আছেন—এটুকু বলতে পারি। তবে থাকবেন কি না এই দুর্ভাগা বঙ্গোপ-বরেন্দ্রে, তা আমাদের জানা নেই। দেখিনি তো, তাই বুঝি এই না জানা। হতে পারে সেখানেও অভিমানের সুর বেজে যাচ্ছে হয়তোবা। আচ্ছা, কেন এমন হয়—কেন?
হে আমার অস্তিত্বের প্রিয় ভূখণ্ড, এত এত অভিমানের চাপ তুমি রাখবে-ঢাকবে কোথায়—কী দিয়ে? হে আমার প্রিয়তম মাটি, তুমি কি কখনোই বলে-শিখিয়ে দেবে না তোমাদের সন্তানদের যে, বোধোদয় কাকে বলে—কেমন করে এটি সৃষ্টি হয়? কখনোই বলে দেবে না যে সুর কেমন করে ঐশ্বরিক হয়ে ওঠে? বুঝিয়ে দেবে না যে সুরের ভাষার কোনো দেশ, রাষ্ট্র, রাজনীতি, কোনো বেড়া নেই? সুরের মানুষ যিনি, তাঁর কণ্ঠের ইন্দ্রজালই সব বিভেদ আর দূরত্বকে একাকার করে ভালোবাসতে শেখায় একে অপরকে—সারা পৃথিবীকে? বন্ধনের তন্ত্রীদের কথা বলতে শিখিয়ে দেয় সংগীতের ভাষা। যা না হলে যেকোনো সাম্রাজ্যের বাসিন্দারা সব অর্থহীন আর অপ্রয়োজনীয় হয়েই থাকত।
সেই সুর তো আকাশলীনা, বাতাসের গতিময়তা, অধরা অথচ অশ্রুত ধ্বনির আভাস। সুর তাই—সংগীত তাই। তারই একজন ধ্যান-মানবী ফিরোজা বেগম। সুরের রেশমি পালক ছুঁইয়ে দিয়েছেন আমাদের শ্রুতিকে। আমাদের মাটি, নদী, পাখির কলতান তাঁর সেই সুরকে খুব ভালো করে চেনে। তবে আমরা কেন এক বুক গর্ব নিয়ে বলতে পারব না—তিনি আমাদের—আমাদের ফিরোজা বেগম? কেন বলব না, ‘কাছে আমার নাই বা এলে, হে বিরহী দূর ভালো?’