বাঁধভাঙা বাঁধন

কানে সবার নজর কেড়েছেন বাঁধন।
ছবি: রয়টার্স

রেহানা মরিয়ম নূর-এর প্রিমিয়ারে কাঁদছিলেন কেন?
প্রশ্নটা ছিল ৭৪তম কান চলচ্চিত্র উৎসবের আ সাঁর্তেঁ রিগা বিভাগের প্রতিযোগিতায় মনোনয়নপ্রাপ্ত বাংলাদেশি রেহানা মরিয়ম নূর ছবির নামভূমিকায় অভিনয় করা অভিনেত্রী আজমেরী হক বাঁধনের প্রতি। কথা হচ্ছিল ১২ জুলাই বিকেলে, মেসেঞ্জারে।
প্রশ্ন শুনে কয়েক সেকেন্ড যেন থমকে গেলেন বাঁধন। ‘প্রথম একসঙ্গে ওই দিনই (৭ জুলাই) আমরা পুরো ছবিটা দেখলাম। এর আগে আমরা কেউই দেখিনি। ছবিতে চার-পাঁচটা দৃশ্য খুবই ডিপ্রেসিং। শেষ দৃশ্যটা আরও বিষণ্নতার। এসব দৃশ্যের শুটিং এক দিনে একটা করে হতো, তারপর দুই-তিন দিন লাগত আমার স্বাভাবিক হতে।’ শুটিং হয়েছিল ২০১৯ সালে।

কানে পুরো ছবিটা দেখার সময় সেই বিষণ্নতা যে ভর করেছিল বাঁধনের ওপর, তা বোঝা গেল তাঁর কণ্ঠেই। ‘আমি এখন জগিং করলাম, সে জন্য একটু হাঁপাচ্ছি, এর বাইরেও আমার কণ্ঠস্বরে কিছু টের পাচ্ছেন?’

‘হ্যাঁ, টের পাচ্ছি।’ বাঁধনের কণ্ঠ খানিকটা আর্দ্র শোনাচ্ছিল ওই প্রশ্নের পরই।
বাঁধন বলে যান, ‘যেসব মানুষ ভাষা জানেন না, তাঁরা রেহানার বেদনার সঙ্গে মিশে গেলেন। এক হাজার আসনের হলে সেদিন ছিল প্রায় ৯৫০ জন। আমরা তো আগে থেকে জানতাম না, সব দর্শক দাঁড়িয়ে অভ্যর্থনা দেবেন আমাদের। আমার জীবনের যাত্রাটা খুব পেইনফুল, রেহানার দৃশ্য দেখে ডুকরে ডুকরে কাঁদছিলাম। অন্য দর্শকদের কান্নার শব্দও শুনতে পাচ্ছিলাম। আমার আনন্দ-বেদনা-সুখের দৃশ্য দেখে সবাই যেভাবে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেন, তা অভাবিত।’

বাঁধনের কান্নার যে ভিডিও দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে দেখা গিয়েছিল, সেটা প্রথম থেকে তোলা নয়। সাংবাদিকেরাও নির্বাক হয়ে গিয়েছিলেন। শেষ দিকে ভিডিও করেছেন। প্রথম অংশ ভিডিও করতে পারেননি। বাঁধনের ভাষায়, যা হয়েছে তা আচমকাই হয়ে গেছে।

কানের অফিশিয়াল মনোনয়ন পাওয়াকেই এগিয়ে রেখেছেন বাঁধন। বললেন, ‘মাস্টার মেকারদের পাশাপাশি আমাদের ছবি মনোনয়ন পেয়েছে, এটাই যথেষ্ট। পুরস্কার পেলে সেটা হবে বোনাস।’

ফ্রান্সের কানে রেহানা মরিয়ম নূর ছবির পুরো দল পৌঁছেছিল গত ২৫ জুন। কান উৎসব শুরু হওয়ার পর অভিনেত্রী বাঁধনের ছবি, বিশেষ করে তাঁর পোশাকগুলো নজর কেড়েছে সবার। প্রিমিয়ারে পরেছিলেন আড়ংয়ের শাড়ি ও ব্লাউজ। শাড়িটা ছিল জামদানি। ‘আমি ঠিক করেছিলাম, কানে দেশি কাপড়ের পোশাক পরব। মসলিন নিয়ে এসেছি দুটি।’

বাঁধন ভেবেছিলেন, বিশ্ব চলচ্চিত্রের অন্যতম সেরা এই উৎসবে বিশ্বখ্যাত ফ্যাশন ব্র্যান্ডের পোশাক অনুষঙ্গ পরেই হাজির হন তারকারা। সেটা নিয়ে ভাবনা ছিল বাঁধনের। কিন্তু রেহানার পরিচালক আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ তাঁকে বলেন দেশকে তুলে ধরতে। ‘সাদ বলেছে, “অন্যরা যাবে ব্যান্ড প্রোমোট করতে। আর তুমি নিজেই ব্র্যান্ড। দেশের প্রতিনিধিত্ব করছ।” সাদ এ রকমই। ওদের পোশাকগুলোও টেইলরের কাছ থেকে বানিয়ে নেওয়া। শাড়ি পরে এত সাড়া যখন পেলাম, খুবই খুশি হলাম।’

কানে দম ফেলার সময়ই পাচ্ছিলেন না বাঁধন। পরিচালক সাদ বেশ অন্তর্মুখী। তাই গণমাধ্যম, এজেন্টদের সঙ্গে যোগাযোগের দায়িত্বটাও এসে পড়েছিল বাঁধনের ওপর। তিনি জানান, প্রযোজক জেরেমি চুয়া অনেক বলে সাদকে দিয়ে কিছু যোগাযোগ করাতে পেরেছেন শেষ পর্যন্ত।

দীর্ঘদিন আড়ালেই ছিলেন বাঁধন। বলা যায় নিজেকে প্রস্তুত করছিলেন। সব বাধা ভেঙে কানে এমনভাবে পৌঁছালেন, যা তাঁর এবং বাংলাদেশের জন্যই এক অনন্য ঘটনা। তাঁকে অভিভূত করে কানের রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় যখন এক প্রবীণ এসে জিজ্ঞেস করেন, ‘আর ইউ রেহানা?’ প্রশংসা করেন তাঁর অভিনয়ের, তখন বাঁধন মনে করেন, এর চেয়ে আর বেশি কী পাওয়ার আছে?

মেয়ে সায়রা ঢাকায়। প্রতিদিনই ভিডিও কলে কথা হয় মা-মেয়ের। মেয়ে কী বলে? ‘মা, ইউ রক!’
সত্যিই তো তাই।