ভয়ংকর সুন্দর অর্থ খুঁজতে দর্শকদের বহুবার দেখতে হবে

ভয়ংকর সুন্দর ছবির দৃশ্যে পরমব্রত ও ভাবনা
ভয়ংকর সুন্দর ছবির দৃশ্যে পরমব্রত ও ভাবনা

নয়নতারা নামের জেদি মেয়ের বিয়ে ভেঙে বাড়ি থেকে পালানো তত্সহ সুবোধ মকু নামের ছেলের প্রেমে পড়া এবং পানিরসংকটের লড়াইয়ের গল্প ভয়ংকর সুন্দর

একটি চলচ্চিত্রের টাইটেল অথবা নামকরণ গল্পের সূচনা নির্দেশ করে। আলোচ্য চলচ্চিত্রটির নাম কেন ভয়ংকর সুন্দর এই অর্থ খুঁজতে দর্শকদের বহুবার চলচ্চিত্রটি দেখতে হবে।

রাতের স্টিমারে নয়নতারা ঢাকার সদরঘাটে আসে। পথ না চেনা নয়নতারা বর্ষীয়ান রিকশাচালকের সাহায্যে পুরান ঢাকার একটি আবাসিক হোটেলে আশ্রয় পায়। যে হোটেলের একমাত্র ওয়েটার মকু (পরমব্রত) ও একমাত্র বোর্ডার নয়নতারা (ভাবনা)।

হোটেলে নয়নতারার সেবা-যত্নে মকুর দিন গড়িয়ে রাত আসে। উভয়ের মনে প্রেমের পাখি কলরব করে উঠতেই খলনায়কের আগমন ঘটে। যথারীতি প্রতিবাদ, খুন এবং হোটেল থেকে পালিয়ে বস্তিঘরে আশ্রয়। অবশেষে মুসলমান কন্যা নয়নতারা ও হিন্দু যুবক মকুর বিয়ে ও বাসরশয্যা। এর সঙ্গে যুক্ত হয় বস্তির মানুষের নিত্যদিনের ঘটনা, মাতাল ফারুকের মাতলামি অথবা নয়নতারার পিতা-মাতার আগমন, পিতার হুংকার এবং মায়ের ন্যাকা কান্না। প্রেমের গল্প ভয়ংকর সুন্দর এ প্রধান দ্বন্দ্ব পানিসংকট।

একদিন যে বস্তিবাসী নয়নতারাকে একটু পানি দিতে অস্বীকার করে, তাদের ওপর প্রতিশোধ নিতে মায়ের হাতের বালা বিক্রি করে বোতল, জার ও ড্রামে পানি জমানো এক মহাযজ্ঞ শুরু করে নয়নতারা। একসময় পানিশূন্য বস্তিতে হাহাকার দেখা দেয়। প্রতিশোধ স্পৃহায় নয়নতারা কাউকে পানি দেয় না। তৃষ্ণার্ত মানুষেরা পানি লুণ্ঠন করে নেয়। নয়নতারা ও মকু দৃশ্যটি উপভোগ করে। ভয়ংকর সুন্দর গল্পটির ইতি ঘটে।

ভয়ংকর সুন্দর চলচ্চিত্রটির নির্মাতা অনিমেষ আইচ। একটি চলচ্চিত্রের দায়ভার সাধারণত নির্মাতার ওপরই বর্তায়। কিন্তু ভয়ংকর সুন্দর-এরদায়ভার সব ইউনিট কর্মীর। প্রারম্ভ দৃশ্যে রাতের আলো-আঁধারে স্টিমারের ও নদী-নগরের নানা মুহূর্তের শটগুলো গ্রহণে ক্যামেরাম্যান প্রমাণ করতে পেরেছেন চলচ্চিত্র হলো আলোর শিল্প। কিন্তু বস্তিঘর ও হোটেলকক্ষে আলোর খেলায় তিনি ছিলেন পরাজিত খেলোয়াড়।

পরিচালক গৃহীত শট ছেদ করা অথবা পরস্পর সংযোগ ঘটানো শুধু সম্পাদকের কর্ম নয়। এই বোধে সম্পাদক সজাগ থাকলে বস্তির মেয়েদের কাছে নয়নতারার পানি সংগ্রহের দৃশ্যটি দর্শক-মনে লজিক ও ধৈর্যের চ্যুতি ঘটাত না। পরিচালকও দৃশ্যান্তর ও সময়-স্থান সংকোচে নগরের টপ শটের বহু ব্যবহারের সুযোগ পেতেন না।

 ‘আমি পড়ে থাকি’সহ প্রতিটি গানের গীত বাণী ও দৃশ্যায়নরূপ নকশায় অঙ্কিত। আবহসংগীত চলনসই। শব্দগ্রহণ অহেতুক বিরক্তিকর গন্ধমাখা। বস্তিজনের মিশ্র কোলাহল শ্রুতিকটু, উঁচু ও নীচুলয়ের নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতায় স্পষ্ট।

পুরুষ প্রধান চরিত্রে মকু (পরমব্রত) অনেক ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রিত। নয়নতারা (ভাবনা) সম্পূর্ণই অনিয়ন্ত্রিত। তাঁর বাচিক ভঙ্গি, সংলাপ প্রক্ষেপণ, রূপসজ্জা, বিশেষ করে পোশাকসাজ প্রশ্নবিদ্ধ। কখনো মনে হয়েছে এইটিন প্লাস নয়নতারা হয়তো প্রতিবন্ধী। এবং পরিচালক ও ক্যামেরার নানা কোণে ভাব রূপ প্রতিবন্ধী নয়নতারার উর্বর দেহসৌন্দর্য দর্শকদের উপহার দিতে পেরেছেন। দর্শকদের মনে করাতে পেরেছেন নয়নতারার বয়স এইটিন ডবল প্লাস। পরোক্ষে দর্শকদের জৈব-মানসিক সংকটে পতিত করেছেন।

বস্তির মেয়েদের কাছ থেকে নয়নতারার পানি সংগ্রহের দৃশ্যটি বীভৎসতার কারণে এর ভিজ্যুয়াল কনস্ট্রাকশন দর্শক-মনে করুণা সৃষ্টিতে ব্যর্থ হয়েছে। গল্পের অন্তিম ভাগে নয়নতারার ঘর থেকে মজুত পানির লুণ্ঠন দৃশ্য এবং মকু ও নয়নতারার প্রতিশোধ গল্পের সার মূলে আঘাত করেছে।

যদি নয়নতারা তৃষ্ণার্ত বস্তিজনকে নিজের হাতে পানি বণ্টন করে দিত, তাহলে পানির অপর নাম জীবন, জীবন দানের বিষয়—এ সত্য প্রতিষ্ঠিত হতো। দর্শক-মনও নয়নতারাকে খল অভিনেত্রী ভাবার সুযোগ পেত না।