লিখেও সফল

বাংলাদেশে নাট্যকার হিসেবে পেশা বেছে নিতে সাহস প্রয়োজন। বিশেষ করে দুই দশক আগে এমন পেশায় আসার সময় অনেক বাঁধাই পেরোতে হতো। তারপরও ভালোবাসার টানে টিভি নাটক লেখাকেই জীবনের লক্ষ্য ঠিক করেছিলেন কজন নাট্যকার। আজ তাঁরা প্রতিষ্ঠিত। অনেক সময় নির্মাতার চেয়ে তাঁদের নামই দর্শকের কাছে হয়ে ওঠে গুরুত্বপূর্ণ। তেমন কজন নাট্যকারের গল্প শোনাচ্ছেন মনজুরুল আলম
বৃন্দাবন দাস,মাসুম রেজা,জাকির হোসেন,মাসুম শাহরিয়ার,পান্থ শাহরিয়ার,শফিকুর রহমান ও মেজবাহ উদ্দিন সুমন
বৃন্দাবন দাস,মাসুম রেজা,জাকির হোসেন,মাসুম শাহরিয়ার,পান্থ শাহরিয়ার,শফিকুর রহমান ও মেজবাহ উদ্দিন সুমন

মাসুম রেজা

মাসুম রেজার জন্ম কুষ্টিয়া জেলায়। বেড়ে উঠেছেন লালনের গান শুনতে শুনতে। ১৯৭৯ সালে ঢাকায় বাংলা একাডেমিতে ঘুরতে এসে প্রথম পথনাটক দেখে মুগ্ধ হন। কুষ্টিয়ায় ফিরে গিয়ে লেখেন নাটক চাঁদ আলীর ডকুমেন্টারি। মাসুম রেজা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় নাটক নির্দেশনার পাশাপাশি অভিনয়ও করতেন। টিভি নাটক লেখার দিকে ঝুঁকে পরেন বলতে গেলে হঠাৎ করেই।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুশীলন থিয়েটারে অভিনয় করার সময় কাজটি বেশ কষ্টের মনে হতো মাসুম রেজার কাছে। তাই পর্দার সামনে থাকার কাজটি খুব বেশি টানেনি তাঁকে। তখন থেকেই মনযোগী হয়ে ওঠেন নির্দেশনায় এবং চলতে থাকে চিত্রনাট্য লেখা। পরে ঢাকায় এসে থিয়েটারের পাশাপাশি আরও বেশি ব্যস্ত হয়ে যান নাটক লেখায়। নতুন গল্পের নাটক দিয়ে দর্শকের কাছে প্রিয় হয়ে ওঠেন অচিরেই।

মাসুম রেজার লেখা প্রথম টিভি নাটকের নাম কৈতব। বিটিভিতে দেখানো হয় ১৯৯৬ সালে। ২০০২ সালে রঙের মানুষ, পরে ভবের হাট ধারাবাহিক লিখে তুমুল জনপ্রিয়তা পান মাসুম রেজা। ব্যস্ততা বাড়তে থাকে তাঁর। এরপর বিরামহীনভাবে লিখে চলেছেন, বদলে দিয়েছেন টিভি নাটকের ধারা। আর মোল্লা বাড়ির বউ সিনেমার চিত্রনাট্য লিখে পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। প্রায় তিন যুগে লিখেছেন চার শর বেশি নাটক।

বৃন্দাবন দাস

নাট্যকারও যে পরিচালকের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারেন, তার প্রমাণ রেখেছেন বৃন্দাবন দাস। মূলত গ্রামকেন্দ্রীক নাটক লিখে জনপ্রিয় হয়েছেন এই নাট্যকার। তাঁর জন্ম পাবনায়, ঢাকায় আসেন ১৯৯৫ সালে। যুক্ত হন মঞ্চনাটকে। আরন্যক নাট্যদলে অভিনয়ের পাশাপাশি নাটক লিখতে শুরু করেন বৃন্দাবন। ১৯৯৭ সালে লেখেন প্রথম নাটক বন্ধুবরেষু। নির্মাতা ছিলেন সাইদুল আনাম টুটুল। নাটকটি দেখা গিয়েছিল একুশে টিভিতে। প্রায় দুই যুগ ধরে বৃন্দাবন দাস নাটক লিখে চলেছেন।

পাবনা জেলার চাটমোহর উপজেলার সন্তান বৃন্দাবন দাস। তাঁর লেখা অধিকাংশ নাটকের কেন্দ্র এই গ্রাম। সেখানে শুটিং না হলেও, শিল্পীদের মুখের সংলাপের কারণে দর্শকের কাছে চাটমোহর এখন চেনা এক স্থান। আঞ্চলিক ভাষায় লেখা বৃন্দাবন দাসের নাটকগুলোর সংলাপ দর্শকের মুখে মুখে ফেরে। স্বয়ং নাট্যকারকে কাছে পেলে অনেকই তাঁর লেখা সংলাপ শুনিয়ে দেন। জিজ্ঞেস করেন, ‘দাদা, কেবা আছেন?’

আরন্যক নাট্যদলে বৃন্দাবন সঙ্গী হিসেবে পেয়েছিলেন সালাউদ্দিন লাভলুকে। বৃন্দাবনের লেখা প্রথম নাটকের চিত্রগ্রাহক ছিলেন সালাউদ্দিন লাভলু। এরপর থেকে এখনো তাঁরা একসঙ্গে কাজ করছেন। বৃন্দাবন দাস বলেন, ‘একটি নাটকের শুটিং করতে করতেই লাভলু জানিয়ে দেয়, “আরেকটা কাজ পাস হয়েছে, দাদা; লিখে দিতে হবে।” আমাদের সম্পর্কটাও এরকমই।’ হিসেবের খাতাও তেমনটাই বলে। বৃন্দাবনের লেখা চিত্রনাট্যের ৯০ শতাংশই পরিচালনা করেছেন সালাউদ্দিন লাভলু।

২০১৯ সাল পর্যন্ত বৃন্দাবনের লেখা একক নাটকের সংখ্যা প্রায় ৩৫০। ছোট–বড় মিলিয়ে ধারাবাহিক লিখেছেন প্রায় ৫০টি। ধারাবাহিকের পর্ব হিসেবে আড়াই হাজারের বেশি হওয়ার কথা।

কখনো চাপ নিয়ে মৌসুমী নাটক লেখেন না বৃন্দাবন দাস। তিনি বলেন, ‘চাইলে এক দিনে ১০ পর্ব লিখতে পারি। তাহলে হয়তো আরও ভালো থাকতে পারতাম। আমি নাটকের মানে বিশ্বাসী। দেশের মানুষ আমাকে নাট্যকার হিসাবে চেনে, এটাই আমার বড় পাওয়া।’ বৃন্দাবন দাসের নাটকের চাহিদা থাকার পরও গত দেড় যুগ ধরে তিনি সম্মানী বাড়াননি। সালাউদ্দিন লাভলু বলেন, ‘তুমুল চাহিদা থাকা সত্ত্বেও দাদা সম্মানী বাড়াননি। প্রতিটা নাটকের জন্য সামান্য কিছু টাকা বাড়ালেও প্রায় কোটি টাকা পার হয়ে যেত।’ এখন বৃন্দাবন দাসের একটি নাটক প্রচার হচ্ছে। আরও দুটির শুটিং শুরু হয়েছে। ব্যস্ততা কমলে একটি সিনেমার চিত্রনাট্য লেখার খুব ইচ্ছে বৃন্দাবন দাসের। তাঁর উল্লেখযোগ্য নাটকগুলো হলো—সার্ভিস হোল্ডার, ঘরকুটুম, হাড়কিপটে, গরুচোর ইত্যাদি।

পান্থ শাহরিয়ার

২০০০ সালে জনপ্রিয় ধারাবাহিক নাটক বন্ধন দিয়ে পান্থ শাহরিয়ার টেলিভিশনে নাটক লেখা শুরু করেন। শুরুতেই বাজিমাত। এরপর থেকে নিয়মিত নাটক লিখে চলেছেন পান্থ শাহরিয়ার। একুশে টিভিতে নাটকটি প্রচারের পর থেকেই পান্থ শাহরিয়ার নাম অনেকের প্রিয় হয়ে ওঠে। ১৯৯৭ সালে প্রথম একক নাটক লেখেন জনান্তিক। তাঁর লেখা একক ও ধারাবাহিক নাটকের সংখ্যা ৩৫০।

মাসুম শাহরিয়ার

মাসুম শাহরিয়ার প্রথম নাটক লেখেন ১৯৯৯ সালে। তখন তিনি স্নাতক প্রথম বর্ষের ছাত্র। প্রথম নাটক সায়াৎসায় সে বছরই বিটিভিতে প্রচারিত হয়। এরপর দীর্ঘ ক্যারিয়ারে তিনি লিখেছেন তিন শর বেশি একক নাটক। ধারাবাহিক লিখেছেন ২০টির বেশি। পর্ব হিসেবে সংখ্যাটি দুই হাজারের ছাড়িয়েছে। প্রতি মাসে ৪–৫টি একক নাটক তো লিখছেনই। পাশাপাশি লিখছেন ধারাবাহিক। মাসুম শাহরিয়ারের লেখা একটি ধারাবাহিক এখন প্রচারিত হচ্ছে। বর্তমানে হাতে রয়েছে আরও ৪টি ধারাবাহিক নাটক লেখার কাজ।

জাকির হোসেন

দুই দশক ধরে নাটক লেখাতেই ব্যস্ত জাকির হোসেন। চারটি ধারবাহিক লেখার কাজ চলছে। টিভিতে প্রচারিত হচ্ছে ইষ্টিকুটুম এবং তোলপাড় নামে দুটি ধারাবাহিক। প্রচারের অপেক্ষায় আছে হুলস্থুল এবং একটি বাড়ি একটি শহর ধারাবাহিক। দখিনা হাওয়া নামে একটি ধারাবাহিকের ৫২ পর্ব লিখে রেখেছেন। শুটিং শুরু হবে শিগগিরই।

উজ্জ্বল প্রায় দুই শর মতো নাটক লিখেছেন। প্রতি মাসে ৪০ থেকে ৬০ পর্বের ধারাবাহিক লিখতে হয়। পেশা হিসেবে নাটক লেখা বেছে নিয়েছেন। এতেই তাঁর আনন্দ। দিনের বেশির ভাগ সময় তাঁর লেখালেখিতেই কাটে।

শফিকুর রহমান

পঞ্চম শ্রেণীতে বৃত্তি পাওয়ার পর বাবা খুশিতে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেবেন। সেখানে লেখা থাকবে ছেলে শান্তনু (শফিকুর রহমানের ডাক নাম) ভবিষ্যতে কী হতে চায়। জিজ্ঞেস করা হলো, ‘কী হতে চাও?’ ডাক্তার–ইঞ্জিনিয়ার নয়, ছোট শান্তনু বলল, ‘লেখক হতে চাই।’ সেই ছেলে এখনকার পুরোদস্তুর নাট্যকার। লেখালেখির শুরু আইয়ুব বাচ্চুর জন্য কয়েকটি গান দিয়ে। নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় শফিকুর রহমান লিখেছিলেন ‘কেউ ভালোবেসে কাছে টানে’ ও ‘সবুজঘর’ গান দুটি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নাটক ও নাট্যতত্ব বিভাগে ভর্তি হন লেখালেখি করবেন বলে। প্রথম লেখেন ২০০৭ সালে ধারাবাহিক নাটক ডাঙ্গুলি। এখন পর্যন্ত একক ও ধারাবাহিক মিলিয়ে লিখেছেন তিন শর বেশি নাটক।

মেজবাহউদ্দিন সুমন

গত ঈদে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে মেহবাহউদ্দিন সুমনের লেখা ২২টি নাটক প্রচারিত হয়েছে। বিজ্ঞাপনের কপিরাইটার হিসেবে এক সময় সুনাম কুড়িয়েছিলেন। তবে এই সুনাম ছিল চেনা গণ্ডিতেই সীমাবদ্ধ। পরে চাকরি ছেড়ে নাটক লেখাতেই মন দেন। প্রথম নাটক কক্ষপথের যুদ্ধ লেখেন ২০০৭ সালে। নাটকটি ২০০৯ সালে প্রচারিত হয়। ১১ বছরের ক্যারিয়ারে লিখেছেন দুই শর মতো নাটক। এখন দুটি ধারাবাহিক এবং একাধিক এক ঘণ্টার নাটক লেখায় ব্যস্ত আছেন তিনি। লেখাই তাঁর নেশা ও পেশা।

চিত্রনাট্যের পারিশ্রমিক
বাংলাদেশের প্রথম সারির একজন চিত্রনাট্যকার এক ঘণ্টার একটি নাটকের জন্য পারিশ্রমিক নেন ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা। ধারাবাহিক নাটকের প্রতি পর্বে চিত্রনাট্যকাররা পান ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা। দ্বিতীয় সারির একজন চিত্রনাট্যকার প্রতি এক ঘণ্টার নাটকের জন্য পারিশ্রমিক নেন ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। ধারাবাহিক নাটকের প্রতি পর্বে পারিশ্রমিক নেন ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা। অনেক সময় সম্পর্কের ওপর পারিশ্রমিক ওঠানামা করে।