শুধু মনে রেখো

আরমানিটোলার সেকেলে বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে প্রথমে মনে হলো, ঐতিহ্যের কাছাকাছি হলাম। ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে সোজা জানালার দিকে উঁকি দিতেই তাঁকে দেখলাম। সহাস্যে উঠে এসে আলিঙ্গন করলেন, ‘তোমাকে সেই ছোট্টটা দেখেছি! কত আদর করেছি!’
শঙ্কা ছিল মনে। অসুস্থ লাকী আখান্দকে কী অবস্থায় দেখব, তা নিয়েই ভয়। কিন্তু নিমেষে সে ভয় দূর হলো আর আমরা যেন শুনতে পেলাম ঝরনার কলরোল। সাদা শার্ট গায়ে সেই লাকী ভাইকে দেখছি, যাঁর দিকে তাকালেই গুনগুন করে ওঠে মন: ‘...তোমায় দিয়ে গেলাম, শুধু মনে রেখো’।
গোলটেবিলে রাখা ফ্লাস্কে সবুজ চা। একটু ঢেলে খেলেন। কথা বলতে গিয়ে কাশি এলে আদা মুখে পুরে দিলেন। দূর হলো কাশি।
সুরের রাজ্যে সাঁতার কাটা লাকী আখান্দের অসাধারণ সৃষ্টির কয়েকটির উল্লেখ করে নিই আগে। ‘এই নীল মণিহার’, ‘আবার এলো যে সন্ধ্যা’, ‘আগে যদি জানতাম’, ‘যেখানে সীমান্ত তোমার’, ‘কবিতা পড়ার প্রহর এসেছে’—এ ধরনের কোমল, মনে স্থায়ী আসন গেড়ে বসা বহু গানের সুরস্রষ্টা তিনি।
গানের মানুষ, ঠোঁটে তাই উঠে আসে গান, মৃদু স্বরে সুর ভাজেন, ‘ও কি ও বন্ধু কাজল ভ্রমরা রে/ কোন দিন আসিবেন বন্ধু কয়া যাও’-‘কয়া যাও’ উচ্চারণ করার সময় ঘরে থাকা প্রতিটি মানুষের মন হাহাকারে ভরে যায়। লাকী আখান্দ্ বলেন, ‘আমাদের সংগীতের অনেক শাখা। তার মধ্যে মাটির গান, যেমন লালন, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, কীর্তন—সবগুলোই গুণেমানে ধনী। শহরের আধুনিক গানও অসাধারণ। তবে শহুরে গান করার সময় খেয়াল রাখা দরকার, তা যেন অস্থির না হয়ে যায়।’

লাকি আখান্দ। ছবি: সুমন ইউসুফ
লাকি আখান্দ। ছবি: সুমন ইউসুফ

‘অস্থির’ শব্দটারও ব্যাখ্যা করেন তিনি, ‘যেমন ধরো, এই যে গানটির কয়েক ছত্র গাইলাম, তা খুব কোমল, কষ্টের; বাণীপ্রধান গান। কী অসাধারণ তার সুর। এ ধরনের গানের সঙ্গে যদি অকারণে সাত-আটটি বাদ্যযন্ত্র বাজানো হয়, তাহলে গানটির প্রাণই উড়ে যাবে। কি-বোর্ড, গিটার, বাঁশি আর তাল রাখার জন্য মন্দিরা—ব্যস, তাতেই এই গানের হাহাকারটা প্রাণে পৌঁছাবে। সালাদ তো কত রকমেরই হয়। কোন সালাদে ধনেপাতা দেব, কোনটায় দেব না, সেটা তো রুচির ব্যাপার। অস্থিরতা বলতে এটাই বলতে চাইছি, আর বলতে চাইছি গানের প্রতি সাধনার প্রতি মনোযোগ না দেওয়াকে। সস্তা জনপ্রিয়তা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষাকেও বলছি অস্থিরতা।’
সৃষ্টির তাড়নায় তাঁর ভেতরে লাভা স্রোত বহমান। বললেন, ‘সমাজে সংস্কৃতির জন্য একটা ভালো দিকনির্দেশনা থাকতে হয়। ভালো মিউজিক তৈরি করতে হয়। এইচএমভি যেমন ভারতে পরিকল্পনা করে বছর ধরে শিল্পী, গীতিকার, সুরকারদের দিয়ে গান করাত, তেমনি এখানেও একটা সিস্টেম দাঁড় করানো দরকার। এ জন্য দেশের সংস্কৃতি, শিক্ষা, তথ্য ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মিলে যদি আমাকে সাপোর্ট দেয়, আমি কিছু করে দেখাতে পারব। যেমন ধরো, রাশিয়া থেকে অ্যাকোর্ডিয়ানের শিক্ষক আনা যেতে পারে, স্পেন থেকে ফ্ল্যামিংগোর শিক্ষক। এ রকম পৃথিবীর সেরা কাজগুলোকে যুক্ত করতে পারি আমাদের কাজের সঙ্গে।’ তারপর হঠাৎ মনে পড়েছে, এভাবে বললেন, ‘১৯৭৫ সালের জুন-জুলাই মাসে একদিন ঢাকা কলেজের সামনে শেখ কামালের সঙ্গে দেখা। কামাল ভাই বললেন, “কই যাস? জিপে উঠে আয়। কথা আছে।”’
ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের সেই স্মৃতিময় বাড়িটিতে লাকীকে নিয়ে গেলেন বঙ্গবন্ধুপুত্র শেখ কামাল। বাড়ির ছাদে উঠে প্রথমে কিছুক্ষণ সেতার বাজালেন। লাকী বললেন, ‘খুব মিষ্টি হাত আপনার।’ শেখ কামাল হেসে বললেন, ‘তোরা তো আমাকে চান্সই দিবি না।’ তারপর বললেন, ‘তুই সারা বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যাবি। সারা বাংলার আঞ্চলিক গানগুলো সংগ্রহ করবি। তোকে একটা জিপ দেব, টাকা দেব আর টেপরেকর্ডার দেব। গানগুলো নিয়ে আয়। “স্পন্দন” থেকে এই গানগুলো আমরা করব।’
এর কিছুদিন পরই ১৫ আগস্ট। এর কিছুদিন পরই সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়। লাকী আখান্দ্কে দিয়ে শেখ কামাল আর কাজটা করে যেতে পারেননি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যদি লাকী আখান্দ্কে দিয়ে এই কাজটি করাতে চান, তাহলে নিজেকে উজাড় করে দেবেন লাকী। তবে কোনো মন্ত্রণালয়ের অধীনে এ কাজ হওয়ার নয়। কোনো পদ দিয়ে চেয়ারে বসে এ কাজ হওয়ার নয়। কিছু দক্ষ মানুষ নিয়ে কাজগুলো সানন্দে করতে চান তিনি।
লাকী ভাই, কবিতা পড়েন?
হাসেন লাকী আখান্দ্। বলেন, ‘গানগুলোও কবিতা হয়ে আসে আমার কাছে। “তুমি কোন কাননের ফুল, তুমি কোন গগনের তারা”—এটা তো কবিতাই। ভালো লাগে।’
কাদের গান শুনতে বলবেন?
‘তুমি যদি সুরকে প্রাধান্য দাও, তাহলে আমি জিপসি কিং, অ্যাল স্টুয়ার্ট, ইগলস, ইয়ানির গান শুনতে বলব। আর রবীন্দ্রনাথ ও লালন।’
আপনি তো আধুনিক গান করেন। রবীন্দ্রনাথ আপনাকে কী দেয়?
‘রবীন্দ্রনাথ কী দেয়? রবীন্দ্রনাথ কী দেয় না, সেটা বলো? রবিঠাকুর তো বিশাল এক পৃথিবী। তিনি তো স্কটল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, লোকসংগীত থেকে নিয়ে অনেক সৃষ্টি করেছেন। শুধু রবিঠাকুরের গান অনুসরণ করে যদি কিছু করা যায়, তাহলে তো আর কোনো সংগীত লাগে না।’
২৪ অক্টোবর আবার ব্যাংককে যাচ্ছেন লাকী আখান্দ্। ভয়ানক যে কর্কটব্যাধিতে তিনি আক্রান্ত, তারই চিকিৎসার জন্য। এবার মাস পাঁচেক থাকতে হবে সেখানে।
বিদায় নিচ্ছিলাম যখন, তখন বলছিলেন, ‘আমি ফিরে আসি। কত কিছু বাকি আছে করার। মনে রেখো আমাকে। পাশে থেকো।’