'এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী'র নির্মাতার চলে যাওয়ার দিন আজ

বাদল রহমান (জন্ম ১৯৪৯ সালের ৪ জুন: মৃত্যু ২০১০, ১১ জুন)
বাদল রহমান (জন্ম ১৯৪৯ সালের ৪ জুন: মৃত্যু ২০১০, ১১ জুন)

খেলাঘর রচনা প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে প্রথম পুরস্কার জিতে যায় খুলনার ছোট্ট ছেলে এমিল। পুরস্কার নিতে একা একা ঢাকার পথে রওনা হয়। তাতেই ঘটে বিপত্তি। আসার আগে ওর হাতে কিছু টাকা দিয়েছিলেন মা। কিন্তু ট্রেনের মধ্যেই এমিল হঠাৎ খেয়াল করে, তার পকেটে টাকা নেই। এমিলের মনে হয়, ট্রেনেই তার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল এক লোকের। লোকটার আচরণ কেমন যেন সন্দেহজনক ছিল। টাকাটা তিনিই নিয়েছেন। কান্নাকাটি নয়, নাছোড়বান্দা এমিল নিজের টাকা উদ্ধারে অভিযানে নামে। তার সাহায্যে এগিয়ে আসে নতুন পরিচয় হওয়া ঢাকার একদল ছেলে। তারা এমিলের পক্ষে স্বেচ্ছায় গোয়েন্দাগিরি শুরু করে। কিন্তু টাকা চোরও কিন্তু কম সেয়ানা নন। এমিলের জন্য তিনিও ফাঁদ পাতেন। শুরু হয় রুদ্ধশ্বাস এক উত্তেজনা। 

এই হচ্ছে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম শিশুতোষ চলচ্চিত্র ‘এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী’র গল্প। জার্মান লেখক এরিখ কাস্টনারের লেখা ‘এমিলের গোয়েন্দা দল’ (১৯২৯) নামের কিশোর গোয়েন্দা উপন্যাসের আলোকে এটি নির্মিত হয়েছে। চলচ্চিত্রটির চিত্রনাট্য রচনা ও পরিচালনা করেছেন বাদল রহমান। এ ছবির মাধ্যমে দেশের যুদ্ধ-পরবর্তী সমাজ-বাস্তবতাকে তুলে ধরতে পরিচালক ছবির কাহিনিতেও এনেছেন অনেক পরিবর্তন। আজ গুণী এই নির্মাতার চলে যাওয়ার দিন। ২০১০ সালের এই দিন ভোরে তিনি মারা যান।

মাহবুবুর রহমানের পরিবর্তে বাদল রহমান
তাঁর প্রথম নাম ছিল মাহবুবুর রহমান। বাবার কর্মস্থল ছিল করাচিতে। সেখানে ১৯৪৯ সালের ৪ জুন জন্মগ্রহণ করেন মাহবুবুর রহমান। পাঁচ ভাই ও এক বোনের মাঝে মাহবুবুর রহমান ছিলেন মা-বাবার প্রথম সন্তান। ১৯৫৭ সালে পিতার কর্মস্থল বদলি হয় খুলনায়। খুলনায় এসে মাহবুবুর রহমান ১৯৫৮ সালে খুলনার সেন্ট যোসেফ স্কুলে চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তি হন। স্কুলে অধ্যয়নকালীন তিনি বাম ছাত্র সংগঠন ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। তবে বাবার ছিল বদলির চাকরি। সেই বদলির ধারাবাহিকতায় তিনি বেশ কয়েকটি জেলার বেশ কয়েকটি স্কুলে অধ্যয়ন সম্পন্ন করে অবশেষে ১৯৬৫ সালে ময়মনসিংহের নান্দিনা পাইলট হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর পিতার আবারও চাকরি স্থল বদলির কারণে কুষ্টিয়া সরকারি কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হন। কিন্তু কুষ্টিয়া সরকারি কলেজে তুখোড় ছাত্র-আন্দোলনে সামনের সারি থেকে নেতৃত্ব দানসহ সক্রিয় অংশগ্রহণের কারণে তিনি স্থানীয় প্রশাসনের কোপানলে পড়েন। মিছিলে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের কারণে তিনি গ্রেপ্তার হন। ছাত্রজীবন থেকেই সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ার কারণে তিনি বিকল্প নামে লেখালিখি এবং রাজনৈতিক ছদ্মনাম ‘বাদল রহমান’ গ্রহণ করেন। মূলত সেই সময় থেকেই তিনি মাহবুবুর রহমানের পরিবর্তে বাদল রহমান নামে পরিচিত হয়ে ওঠেন।

বলিউড তারকা মিঠুন চক্রবর্তীর সঙ্গে বাদল রহমান, পুনে
বলিউড তারকা মিঠুন চক্রবর্তীর সঙ্গে বাদল রহমান, পুনে

চলচ্চিত্রের বাদল রহমান
নিভৃতচারী মানুষ ছিলেন বাদল রহমান। ছিলেন একাধারে চলচ্চিত্র পরিচালক, সম্পাদক, চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক, চলচ্চিত্রের শিক্ষক ও টিভি অনুষ্ঠান নির্মাতা। সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি দায়বদ্ধ এক চলচ্চিত্রকার বাদল রহমান। কর্মময় জীবনে তিনি ছিলেন পূর্ণাঙ্গ এক নির্মাতা।
তবে শুধু চলচ্চিত্র নির্মাণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেননি বাদল রহমান। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র আন্দোলনকে বেগবান করতে গিয়ে তিনি নিজের জন্য কোনো দিনই কিছু চাননি। ব্যক্তিস্বার্থ বা পরিবারের কথা না ভেবে কাজ করে গেছেন চলচ্চিত্রশিল্পের বিকাশে। বিভিন্ন সময় সরকারের সঙ্গে চলচ্চিত্র নিয়ে তাঁকে লড়াই করতে হয়েছে। বাংলা চলচ্চিত্রকে একটি নিজস্ব ভাষা প্রদানের পাশাপাশি ফিল্ম আর্কাইভ প্রতিষ্ঠা, চলচ্চিত্র নির্মাতাদের জন্য ফিল্ম অ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্সের ব্যবস্থা করাসহ নানা কাজে যুক্ত ছিলেন। চলচ্চিত্র নিয়ে বাদল রহমানের অবদানের কথা বলে শেষ করা যাবে না। ‘এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী’র জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন ১৯৮০ সালে।
পরবর্তী সময়ে স্বাধীন দেশে শিল্পচর্চার তাগিদে অনবদ্য ভূমিকা রেখেছেন চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনে। চলচ্চিত্র বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নিয়ে বাংলাদেশে কাজ শুরু করা ব্যক্তিত্বের মধ্যে তিনি অন্যতম। ভারতের পুনা ফিল্ম ও টিভি ইনস্টিটিউট থেকে চলচ্চিত্র সম্পাদনায় তিনি ডিপ্লোমা করেন। চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের শুরু থেকে তাঁর বলিষ্ঠ ভূমিকা ছিল। চলচ্চিত্র সংসদ ফেডারেশনের একাধিকবার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধেও তিনি সক্রিয় ছিলেন। ‘এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী’ ছাড়াও বাদল রহমানের বানানো ভালো চলচ্চিত্রের মধ্যে অন্যতম ‘কাঁঠালবুড়ির বাগান’, ‘ছানা ও মুক্তিযুদ্ধ’ প্রভৃতি। তাঁর স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবির মধ্যে রয়েছে ‘প্রত্যাশার সূর্য’, ‘সেলফ পোর্ট্রেট’, ‘শিল্পীর শিল্প’, শিশুতোষ চলচ্চিত্র প্রভৃতি। ‘চলচ্চিত্রের ভাষা’ নামে তাঁর একটি গ্রন্থও রয়েছে।

পরিবারের সঙ্গে বাদল রহমান
পরিবারের সঙ্গে বাদল রহমান

পেলেন না একুশে বা স্বাধীনতা পদক

‘এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী’ ছবির পোস্টার
‘এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী’ ছবির পোস্টার

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও তিনি স্মরিত হয়েছেন নানাজনের আলোচনায়। গবেষক ও লেখক অনুপম হায়াৎ বাদল রহমানকে নিয়ে বলেন, ‘এ দেশের চলচ্চিত্রশিল্পের বিকাশে বাদল রহমান আমাদের কাছে স্বপ্নপুরুষ ছিলেন। স্বাধীন দেশে যখন নানা কর্মকাণ্ড হচ্ছে, তখন তাঁর মতো মানুষেরা চলচ্চিত্রে প্রত্যাশার সূর্য হয়ে এসেছিলেন। আত্মত্যাগী এই মানুষটি মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসায় অংশ নিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধে। স্বাধীন দেশে চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনে রেখেছেন অনন্য ভূমিকা; এ দেশের চলচ্চিত্র সংস্কৃতিকে আলোকিত করেছেন।’
চলচ্চিত্রকার সৈয়দ সালাউদ্দীন জাকী বলেন, ‘বাদল রহমান ছিলেন আমাদের চলচ্চিত্র আন্দোলনের প্রতিবাদী চরিত্র। চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনসহ যেকোনো সামাজিক অসংগতির বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সাহস ছিল এই মানুষটির।’
বর্তমানে যে চলচ্চিত্রের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো দাঁড়িয়ে আছে তার মধ্যে এফডিসি ছাড়া প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের গড়ে ওঠার লড়াইটা মুক্তিযোদ্ধা ও চলচ্চিত্রকার বাদল রহমান করেছেন, এমনটাই মনে করেন ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজের সাধারণ সম্পাদক বেলায়াত হোসেন মামুন। তিনি বলেন, কেউ কেউ শুধু চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য চলচ্চিত্র মাধ্যমটিতে যুক্ত হন, আর কেউ কেউ চলচ্চিত্র মাধ্যমটিকে আগামী প্রজন্মের জন্য সহায়ক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য, দেশ ও সমাজের পশ্চাৎপদতার বিরুদ্ধে লড়াই করে সুস্থ ও সৎ চলচ্চিত্রের জন্য ক্ষেত্র প্রস্তুতির জন্য কাজ করে যান। বাদল রহমান হলেন এই দ্বিতীয় গোত্রের মানুষ। তিনি শুধু চলচ্চিত্র নির্মাণ করার জন্যই চলচ্চিত্রের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেননি। তিনি সত্তরের দশক থেকে চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের নেতৃত্বে দিয়েছেন। চলচ্চিত্র শিক্ষা নিয়ে লড়ে গেছেন সেই সময়ে, যখন এই দেশে কেউ চলচ্চিত্রকে শিক্ষার বিষয় মনে করতেন না। আক্ষেপ নিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের রাষ্ট্র এই গুণী মানুষটিকে একুশে পদক বা স্বাধীনতা পদক দিয়ে আজও সম্মানিত করেনি। এটা দুঃখজনক।’