অণুজীব দিয়ে ছবি এঁকে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছিলেন বাংলাদেশের জহুরুল

ছবিটি আঁকা হয়েছে অণুজীব দিয়ে, আর একেই বলে আগার আর্ট
চিত্রকর্ম: মেলানি সুলিভান, সেন্ট লুইস স্কুল অব মেডিসিন, ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র

একেই বলে কাকতালীয় ব্যাপার। প্রতিদিনের মতো গত ১৭ জুন ‘রিপলি’স বিলিভ ইট অর নট!’-এর একটা কিস্তি নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করছিলাম। ওই কিস্তিতে ছিল আমেরিকান সোসাইটি ফর মাইক্রোবায়োলজি আয়োজিত আগার আর্ট নামের এক বার্ষিক প্রতিযোগিতার তথ্য। ২০১৫ সালে শুরু হওয়া ওই প্রতিযোগিতায় সারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, গবেষক ও বিজ্ঞানীরা অংশ নেন। তাঁরা ছবি আঁকেন গবেষণাগারের ছোট্ট স্বচ্ছ পাত্রে, যেটাকে ইংরেজিতে বলে ‘পেট্রি ডিশ’। এ তথ্যে হয়তো অতটা চমক নেই। চমক লুকিয়ে আছে ছবি আঁকার মাধ্যম বা উপকরণের নামটাতে। লেখার শিরোনাম দেখেই বুঝতে পেরেছেন, মাধ্যমটা হলো অণুজীব! জীবনে ছবি আঁকার বিচিত্র সব মাধ্যমের কথা জেনেছি। বিখ্যাত মার্কিন চিত্রশিল্পী অ্যান্ডি ওয়ারহোলের কথাই ধরা যাক; মূত্র দিয়েও ক্যানভাসে ছবি এঁকেছেন পপ আর্টের এই গুরু। এত সব মাধ্যমের কথা জানলেও অণুজীব দিয়ে যে ছবি আঁকা যায়, তা আগে জানতাম না। কাজেই বিষয়টা কৌতূহলী করে তুলল।

কৌতূহল মানেই এখন গুগল। ‘আগার আর্ট’ লিখে খুঁজতেই পেয়ে গেলাম ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের একটি লিংক। সেখানে ২০১৬ সালের প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের আঁকা ছবিগুলো দেখছিলাম। দারুণ সব ছবি। হঠাৎ খেয়াল করলাম, সেবার প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছিলেন ইউনিভার্সিটি অব কোপেনহেগেনের মো. জহুরুল ইসলাম। পিঠ সোজা করে বসলাম। মনে হলো, ভিনদেশের পথে এক বাংলাদেশি ‘ভাই’য়ের দেখা পেয়ে গেছি। সঙ্গে সঙ্গে গুগলের সার্চ বারে নামটি টাইপ করলাম। মুহূর্তেই পেয়ে গেলাম জহুরুলের লিংকডইন অ্যাকাউন্ট। আন্দাজ সত্যি হয়ে গেলে যা হয়, তা-ই হলো, মুখে একটা বিজয়ীর হাসি খেলে গেল। হ্যাঁ, মো. জহুরুল ইসলাম বাংলাদেশের কৃতী।

মো. জহুরুল ইসলাম এখন হার্ভার্ডের পোস্ট ডক্টরাল গবেষক
ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

সংক্ষেপে জানিয়ে রাখি, মো. জহুরুল ইসলাম পড়াশোনা করেছেন চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ে (সিভাসু)। পড়াশোনা শেষ করে শিক্ষক হিসেবে সেখানেই যোগ দেন ২০১১ সালে। এখন তিনি পোস্টডক্টরাল গবেষক হিসেবে কর্মরত আছেন বিশ্বখ্যাত হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। গুগল ঘেঁটে তথ্য পাওয়ার পর তাঁর সঙ্গে ই-মেইলে যোগাযোগ করেছিলাম। পরে ফেসবুক মেসেঞ্জারে কথাও হলো। তারপর একটা সাক্ষাৎকারই নিয়ে ফেললাম ই-মেইলে। আগার আর্ট, আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় প্রথম হওয়া, বর্ণাঢ্য শিক্ষাজীবন, ক্যারিয়ার—সব মিলিয়ে মো. জহুরুল ইসলামের অনুপ্রেরণাদায়ী কথা পড়ুন এই সাক্ষাৎকারে...

আগার আর্ট প্রতিযোগিতায় প্রথম হওয়া জহুরুলের আঁকা সেই ছবি
ছবি: মো. জহুরুল ইসলাম

প্রশ্ন :

যে ছবি এঁকে আগার আর্ট প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছিলেন, সেটি কী দিয়ে এঁকেছিলেন?

২০১৬ সালের আগার আর্ট প্রতিযোগিতার জন্য আঁকা ওই ছবির নাম ছিল ‘দ্য ফার্স্ট রেস’, অর্থাৎ ‘প্রথম দৌড়’। প্রাণীর নিষিক্তকরণ প্রক্রিয়া কীভাবে হয়, তা-ই দেখিয়েছিলাম ওই চিত্রকর্মে। ছবিটি আঁকতে আমি চারটি ব্যাকটেরিয়া ব্যবহার করেছিলাম। ক্যানভাস হিসেবে ছিল একটি আগার (জেলির মতো একধরনের বস্তু)। লাল রঙের মাধ্যমটি ছিল স্ট্যাফিলোকক্কাস অরিয়াস নামক ব্যাকটেরিয়া, যা মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণীর বেলায় উপকারী জীবাণু। সবুজ রঙের মাধ্যমটি ছিল স্ট্যাফিলোকক্কাস জাইলোসাস, এটি মানুষের ত্বকের একটি অণুজীব। সাদা রঙেরটি ছিলস্ট্যাফিলোকক্কাস হাইকাস, যা শূকরের দেহের একধরনের জীবাণু। আর হলুদ রঙের অণুজীবটি ছিল কোরিনেব্যাকেরিয়াম গ্লুটামিকাম, যা একটি বন্ধু অণুজীব। অন্য রংগুলো তৈরি করেছিলাম এই চার অণুজীবের বিভিন্ন সংমিশ্রণ থেকে।

প্রশ্ন :

ছবিটি আঁকতে কত দিন লেগেছিল? কীভাবে এঁকেছিলেন?

আগার আর্ট অত্যন্ত সূক্ষ্ম ও সময়সাপেক্ষ এক কাজ। ছবিটি আঁকতে সময় লেগেছিল সাত দিন। প্রথম দু-তিন দিন লেগেছিল প্রয়োজনীয় অণুজীবকে রং হিসেবে ব্যবহারের উপযোগী করে তুলতে। এরপর জীবাণুমুক্ত ক্যানভাস তৈরি করতে সময় লেগেছিল আনুমানিক ৬ থেকে ১২ ঘণ্টা এবং ক্যানভাসটি জীবাণুমুক্ত হয়েছে কি না, সেটি পরীক্ষা করতে লেগেছিল আরও ২৪ ঘণ্টা। সেই ক্যানভাসে এক বিশেষ ধরনের জীবাণুমুক্ত রংতুলি দিয়ে অণুজীব ব্যবহার করে ছবি আঁকতে সময় লেগেছিল প্রায় ৮ ঘণ্টা। এ ধরনের ছবি আঁকার সময় আন্দাজের ওপর নির্ভর করতে হয়। কারণ, ছবি আঁকার সময় রং হিসেবে ব্যবহার করা অণুজীবগুলো খালি চোখে দেখা যায় না। অনেকটা সাদা পানি দিয়ে ছবি আঁকার মতো। আঁকা শেষে ক্যানভাসটি ইনকিউবেটরে ৪৮ ঘণ্টা রেখে দিলে অণুজীবগুলো দ্রুত বংশবিস্তার করে এবং ওদের নিজস্ব রঞ্জক দৃশ্যমান হয়। যার ফলে শিল্পকর্মটির আসল চেহারা তখন দেখা যায়।

‘জার্ম আর্ট’ চর্চার সময় বিজ্ঞানী আলেকজান্ডার ফ্লেমিং, ইনসেটে তাঁর আঁকা তিনটি জার্ম আর্ট
ছবি: উইকিপিডিয়া

প্রশ্ন :

এ রকম বিচিত্র মাধ্যমে ছবি আঁকার প্রচলন হয়েছে কত দিন আগে?

অণুজীব ব্যবহার করে ছবি আঁকার প্রচলন অনেক আগে থেকেই। পেনিসিলিনের আবিষ্কারক বিজ্ঞানী আলেক্সান্ডার ফ্লেমিংকেই আগার আর্টের পথিকৃত বলা হয়। যুক্তরাজ্যের চেলসি আর্টস ক্লাবের সদস্য ছিলেন তিনি। তো ওই ক্লাবের সদস্য থাকার সময় অণুজীব দিয়ে ছবি আঁকতেন ফ্লেমিং।

প্রশ্ন :

ফ্লেমিংয়ের ওই চিত্রকর্মগুলোকে তো ইংরেজিতে ‘জার্ম পেইন্টিং’ বলা হয়, সে হিসাবে এটাকে সহজ বাংলায় কি জীবাণুচিত্র বলা যায়?

জীবাণুচিত্র বলা যাবে না, অণুজীবচিত্র বলাই যুক্তিযুক্ত। প্রকৃতপক্ষে এটাই আগার আর্ট প্রতিযোগিতার অন্যতম উদ্দেশ্য। অর্থাৎ সাধারণ মানুষকে অণুজীবের সঙ্গে পরিচয় করানো। অধিকাংশ মানুষ অণুজীব বলতে রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু মনে করেন, যা আসলে সত্য নয়। শুধু মানবদেহেই কয়েক ট্রিলিয়ন অণুজীব বসবাস করে, যাদের মধ্যে অতি সামান্যসংখ্যক অণুজীব রোগব্যাধি সৃষ্টি করে, যাদের আমরা বলি জীবাণু। কিন্তু ৯৯ শতাংশের বেশি অণুজীব মানবদেহের অবিচ্ছেদ্য অংশ ও পরম বন্ধু। সেসব বন্ধু অণুজীব সুরক্ষিত না হলে মানুষের শরীরে অনেক রোগব্যাধি জন্মায়।

সংক্ষেপে আগার আর্ট

অণুজীবের সৌন্দর্য ও প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যময়তা সাধারণ মানুষের সামনে তুলে ধরার উদ্দেশ্যে ২০১৫ সালে আমেরিকান সোসাইটি ফর মাইক্রোবায়োলজি (এএসএম) আগার আর্ট প্রতিযোগিতা শুরু করে। অল্প সময়ের মধ্যে ব্যতিক্রমধর্মী এ বিজ্ঞান প্রতিযোগিতা বেশ জনপ্রিয়তা পায়। ইতিমধ্যে বিভিন্ন দেশের শতাধিক প্রতিযোগী তাতে অংশ নিয়েছেন। এ প্রতিযোগিতার খবর প্রকাশিত হয়েছে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ম্যাগাজিন, দ্য গার্ডিয়ান ও নিউইয়র্ক টাইমসের মতো বিশ্বের নামকরা সব সংবাদমাধ্যমে। এ ছাড়া ডেনমার্কে স্কুলশিক্ষার্থীদের পাঠ্যক্রমে আগার আর্ট অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সি সিটির লিবার্টি সায়েন্স সেন্টারে বিজ্ঞান প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছে এই চিত্রকর্ম। নিউইয়র্কে ২০১৯ সালের জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশন চলাকালে অ্যান্টিমাইক্রোবায়াল রেজিস্ট্যান্স (এএমআর) চ্যালেঞ্জ উদ্‌যাপনে বিগত বছরের আগার আর্ট বিজয়ীদের চিত্রকর্ম তুলে ধরা হয়। অদৃশ্য অণুজীবকে রং হিসেবে এবং অণুজীবের খাদ্যকে ক্যানভাস হিসেবে ব্যবহার করে সৃষ্টিশীল ছবি আঁকাই আগার আর্টের মূল প্রতিপাদ্য। ছবি আঁকার দিন শিল্পীকে অনুমান করেই ছবি আঁকতে হয়। কারণ, অণুজীব অত্যন্ত ক্ষুদ্র হওয়ায় খালি চোখে দেখা যায় না। অদৃশ্য রং দিয়ে আঁকা শিল্পকর্মটি সঠিক তাপমাত্রায় কয়েক দিন ইনকিউবেটরে রেখে দিলে অণুজীবগুলো বংশবৃদ্ধি করে এবং তাদের দ্বারা সৃষ্ট প্রাকৃতিক রঞ্জকের কারণে তা দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। এভাবেই অণুজীবকে কাজে লাগিয়ে তৈরি করা হয় আগার আর্ট।
জহুরুলের আঁকা আরেকটি আগার আর্ট—বাংলাদেশ ভিক্টরি
ছবি: মো. জহুরুল ইসলাম

প্রশ্ন :

আগার আর্ট প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার আগেও কি আপনি এ রকম ছবি এঁকেছিলেন?

হ্যাঁ, আগার আর্ট প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের আগেও আমি এ রকম ছবি আঁকতাম। ২০১৫ সালে বাংলাদেশের মহান বিজয় দিবসে বাংলার বীর মুক্তিযোদ্ধাদের উৎসর্গ করে ‘বাংলাদেশ ভিক্টরি’ নামক একটি ছবি এঁকেছিলাম।

দি ইলুমিনাতি ডায়মন্ড
ছবি: মো. জহুরুল ইসলাম

আমার আঁকা আরেকটি আগার আর্ট হলো ‘দি ইলুমিনাতি ডায়মন্ড’ (২০১৬)। এটি একটি অ্যামবিগ্রাম এবং এটি বেস্টসেলার লেখক ড্যান ব্রাউনের লেখা উপন্যাস ‘অ্যাঞ্জেলস অ্যান্ড ডেমনস’ থেকে অনুপ্রাণিত।

দ্য হিউম্যান মাইক্রোবায়োম
ছবি: মো. জহুরুল ইসলাম

২০১৮ সালে এঁকেছিলাম ‘দ্য হিউম্যান মাইক্রোবায়োম’ ছবিটি। মানুষ কেবল একটি একক সত্তা নয়, মানবদেহ সমন্বিত একটি জটিল বাস্তুতন্ত্র, যা ছত্রাক, আরকিয়া, ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাসসহ কোটি কোটি অণুজীব নিয়ে গঠিত। মানবদেহের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে বসবাস করা এসব অণুজীব হিউম্যান মাইক্রোবায়োম হিসেবে পরিচিত। ধারণা করা হয়, মানব–জিনোম ও মাইক্রোবায়োম একসঙ্গে বিবর্তিত হয়। এ শিল্পকর্মে আমি বিভিন্ন অণুজীব ব্যবহার করে মানব–মাইক্রোবায়োমের বৈচিত্র্যটা চিত্রিত করেছি।

প্রশ্ন :

এখন আপনি আগার আর্ট প্রতিযোগিতার বিচারক...

হ্যাঁ, ২০১৯ ও ২০২০ সালের প্রতিযোগিতায় আমি প্রাথমিক ও চূড়ান্ত পর্বে বিচারক হিসেবে ছিলাম।

হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োম গবেষণাগারে জহুরুল
ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

প্রশ্ন :

আপনি এখন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় কী করছেন?

এখন আমি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পোস্ট ডক্টরাল গবেষক হিসেবে কাজ করছি। ব্যাপারটা এখনো স্বপ্নই মনে হয় আমার কাছে! বাংলাদেশের ছোট একটা গ্রামের স্কুলে পড়ালেখা শুরু করে পৃথিবীর সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার সুযোগ পাওয়া স্বপ্নের মতোই! হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি ও ইমিউনোলজি ডিপার্টমেন্টে প্রশিক্ষণ নিচ্ছি প্রায় দেড় বছর হলো। অল্প সময়ে অনেক কিছু জানার ও শেখার সুযোগ হয়েছে এখানে। কাজ করছি মাইক্রোবায়োম ও ইমিউনোলজির (রোগপ্রতিরোধ) বিভিন্ন প্রায়োগিক দিক নিয়ে। মাইক্রোবায়োম আমাদের দ্বিতীয় অস্তিত্বের মতো। একটি মানুষের দেহে মানবকোষের সংখ্যার প্রায় ১০ গুণ বেশি থাকে অণুজীব। ওজন পরিমাপ করলে তা হবে এক থেকে তিন কেজি। দেহের সব অণুজীবকে সামষ্টিকভাবে আমরা বলি ‘মাইক্রোবায়োম’। এদের বসবাস মূলত অন্ত্র, ত্বক, নাসারন্ধ্র, ফুসফুস, যৌনাঙ্গ, মুখগহ্বর ও দেহাভ্যন্তরের বিভিন্ন স্থানে। প্রায় অদৃশ্য এসব অণুজীব প্রাণিদেহের নানাবিধ কার্যকলাপে কলকাঠি নাড়ায়।

পোস্টডক্টরাল গবেষণায় মাইক্রোবায়োম ও প্রাণিদেহের মধ্যে মিথস্ক্রিয়ার সম্পর্ক নিয়ে কাজ করি আমরা। অর্থাৎ অন্ত্রের মাইক্রোবায়োম কীভাবে স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলে, সেটি দেখি। মাইক্রোবায়োম এবং দেহের মধ্যে যান্ত্রিক সংযোগ খুঁজে বের করা আমার গবেষণার লক্ষ্য। গবেষণাকাজে ব্যবহার করতে হয় জীবন্ত অ্যানিমেল মডেল ও একাধিক ওমিকস প্রযুক্তি। হার্ভার্ডের বিভিন্ন গবেষণাগারে এসব বিষয়ে সরাসরি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে অনেক নতুন প্রযুক্তি শেখার সুযোগ হচ্ছে।

প্রশ্ন :

আপনার গবেষণার ফলে আমরা কীভাবে উপকৃত হব?

বৈজ্ঞানিক গবেষণার মাধ্যমে উপকার আসে সামষ্টিকভাবে। অর্থাৎ বিজ্ঞানের অগ্রগতিকে যদি একটি দালানের সঙ্গে তুলনা করি, তাহলে আমাদের প্রতিটি গবেষণা একেকটি ইটের মতো। একেকটি গবেষণার মাধ্যমে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জ্ঞান তৈরি হয়, আর এ রকম অসংখ্য ক্ষুদ্র জ্ঞানের সমষ্টিই হচ্ছে আজকের বিজ্ঞান। আমার গবেষণাও এ রকম একটি ক্ষুদ্র জ্ঞান সৃষ্টির প্রয়াস, যার মাধ্যমে আমি অণুজীবকে ব্যবহার করে মানুষ ও পশুপাখির বিভিন্ন রোগের প্রতিষেধক উদ্‌ঘাটন করতে চাই।

প্রশ্ন :

আপনার জন্ম জয়পুরহাটে, ছেলেবেলার কথা শুনতে চাই...

১৯৮৫ সালে জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার মুড়াইল গ্রামে আমার জন্ম। আমার মায়ের নাম বিউটি বেগম, বাবা মো. হজরত আলী। দুই ভাইয়ের মধ্যে আমি বড়। ছোট ভাই মো. রবিউল হাসান। শৈশব-কৈশোর কেটেছে গ্রামবাংলার প্রকৃতির মধ্যে।

হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে স্ত্রী শাহানা আহমেদের সঙ্গে জহুরুল
ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

প্রশ্ন :

পরিবারে আর কে কে আছেন? সম্প্রতি আপনি বাবা হয়েছেন...

আমার সহধর্মিণী শাহানা আহমেদ এখন যুক্তরাষ্ট্রের টাফটস বিশ্ববিদ্যালয়ে পোস্টডক্টরাল গবেষক হিসেবে কর্মরত। ৯ জুলাই আমরা কন্যাসন্তানের মা-বাবা হয়েছি।

প্রশ্ন :

আপনার শিক্ষাজীবন সম্পর্কে শুনতে চাই...

পড়ালেখায় হাতেখড়ি গ্রামের একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। মাধ্যমিক বিদ্যালয় ছিল হারুঞ্জা নমিজন আফতাবী উচ্চবিদ্যালয়। সেখান থেকে ২০০০ সালে স্টার মার্কস পেয়ে বিজ্ঞান বিভাগে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হই। তারপর বগুড়া সরকারি আজিজুল হক কলেজ থেকে ২০০৩ সালে বিজ্ঞান বিভাগে উচ্চমাধ্যমিক সম্পন্ন করি।

বিজ্ঞান নিয়ে পড়ালেখার আগ্রহ ছিল। তাই বেছে নিয়েছিলাম চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়কে। সেখান থেকে ২০১০ সালে পাঁচ বছর মেয়াদি ডক্টর অব ভেটেরিনারি মেডিসিন (ডিভিএম) ডিগ্রি অর্জন করি। এরপর ২০১২ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাইক্রোবায়োলজি বিষয়ে মাস্টার্স সম্পন্ন করি। অনার্স ও মাস্টার্স—উভয় ডিগ্রিতেই সর্বোচ্চ ভালো ফল করায় দুটিতে আলাদাভাবে রাষ্ট্রপতি স্বর্ণপদকেও ভূষিত হওয়ার সৌভাগ্য হয়।

জহুরুলের কর্মজীবন শুরু চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ে
ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

প্রশ্ন :

কর্মজীবন শুরু হলো কোথায়?

কর্মজীবনের শুরুতে ৩০তম বিসিএসে উত্তীর্ণ হওয়ায় সরকারি চাকরির সুযোগ হয়েছিল। একই সঙ্গে নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে মাইক্রোবায়োলজি বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগদানেরও সুযোগ আসে। শেষমেশ বিসিএসের পরিবর্তে বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১১ সালে প্রভাষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করি। এরপর ২০১৪ সালে সহকারী অধ্যাপক এবং ২০১৮ সালে সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পেয়ে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো কর্মরত।

প্রশ্ন :

তারপর উচ্চশিক্ষার জন্য কোথায় গেলেন?

কানাডা ও ডেনমার্কের দুটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইন্টারভিউয়ের ডাক এসেছিল। ইন্টারভিউ দেওয়ার কয়েক সপ্তাহের মধ্যে দুটিতেই বৃত্তিসহ ডক্টরেট করার সুযোগ পাই। শেষমেশ ডেনমার্কের কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয়েই ভর্তির সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। ডেনমার্ক সরকারের অর্থায়নে পূর্ণ বৃত্তি নিয়ে কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডিতে ভর্তি হই ২০১৫ সালে। পরবর্তী সময়ে আমার স্ত্রীও একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি ডিগ্রিতে ভর্তি হওয়ায় পরিবারসহ ডেনমার্কে বসবাস করার সুযোগ হয়। ২০১৮ সালে ডক্টরেট শেষে ডেনমার্ক থেকে বাংলাদেশে এসে আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা চালিয়ে যেতে থাকি।

মাইক্রোবায়োম ও প্রাণিদেহের মধ্যে মিথস্ক্রিয়ার সম্পর্ক নিয়ে কাজ করছেন জহুরুল
ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

প্রশ্ন :

হার্ভার্ডে গেলেন কত সালে?

ডেনমার্কে পিএইচডি চলাকালে থেকেই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পোস্টডক্টরাল গবেষণার জন্য অধ্যাপকদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করি। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে হার্ভার্ডে পোস্টডকের জন্য একটি আন্তর্জাতিক ফেলোশিপে আবেদন করি। ফেলোশিপের ফলের জন্য অপেক্ষায় থাকি এবং এর মধ্যে ২০১৮ সালে পিএইচডি শেষে দেশে ফিরে শিক্ষকতা পেশায় যোগদান করি। কিছুদিন পরই চিঠি পেলাম যে আমি হার্ভার্ডে পোস্টডকের জন্য আন্তর্জাতিক ফেলোশিপ প্রতিযোগিতায় জয়ী হয়েছি। তখন আবারও কর্মক্ষেত্র থেকে শিক্ষাছুটি নিয়ে ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে তিন বছরের জন্য পোস্টডক্টরাল বিজ্ঞানী হিসেবে যোগদান করি। এখন পর্যন্ত আমার পোস্টডকের বেতনভাতা ও গবেষণা ব্যয়ভার যৌথভাবে বহন করছে ডেনমার্কের লুন্ডবেক ফেলোশিপ ও যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়।

যুক্তরাষ্ট্রের স্যান ফ্রান্সিসকোয় এক বৈজ্ঞানিক সম্মেলনের অণুজীব গ্যালারিতে স্থান পায় জহুরুলের আগার আর্ট
ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

প্রশ্ন :

আন্তর্জাতিক পুরস্কার ও সম্মাননাও পেয়েছেন একাধিক...

২০১৫ সালে প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মাননা আসে ইউরোপিয়ান সোসাইটি ফর ক্লিনিক্যাল মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজেস থেকে প্রাপ্ত কনফারেন্স অ্যাটেন্ডেড গ্রান্টসের মাধ্যমে। এরপর ২০১৬ সালে আমেরিকান সোসাইটি ফর মাইক্রোবায়োলজি আয়োজিত আন্তর্জাতিক আগার আর্ট প্রতিযোগিতায় সারা পৃথিবীর মধ্যে সেরা প্রতিযোগী হিসেবে পুরস্কৃত হই। ২০১৭ সালে আমেরিকান সোসাইটি ফর মাইক্রোবায়োলজির বাংলাদেশের জন্য তিন বছর মেয়াদি সায়েন্স অ্যাম্বাসেডর হিসেবেও নিযুক্ত করে আমাকে। এ ছাড়া ২০১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ওরলিয়ান্সে ও ২০১৯ সালে স্যান ফ্রান্সিসকোতে এএসএম প্রদত্ত এএসএম মাইক্রোব কনফারেন্সে ট্রাভেল অ্যাওয়ার্ড পাই। আর ২০১৯ সালে ডেনমার্কের লুন্ডবেক ফাউন্ডেশন প্রদত্ত বহুল প্রতিযোগিতামূলক আন্তর্জাতিক পোস্টডক্টরাল ফেলোশিপ অর্জন করি, যার অর্থায়নে বর্তমানে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি।

প্রশ্ন :

আপনি দেশে ফিরবেন কবে? ভবিষ্যতে কী কী করতে চান?

পোস্টডক্টরাল ফেলোশিপ শেষেই দেশে ফিরব। ভবিষ্যতে বাংলাদেশেও বিশ্বমানের গবেষণা করা ও নতুন প্রজন্মকে বিজ্ঞান গবেষণায় প্রশিক্ষিত করার ইচ্ছা আছে। মাইক্রোবায়োম বিষয়টি প্রিবায়োটিক ও প্রোবায়োটিক শিল্পের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত থাকায় এটি ভবিষ্যৎ স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের এক নতুন সম্ভাবনাময় খাত। তাই হার্ভার্ডে অর্জিত জ্ঞান কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশের বিজ্ঞান গবেষণায় ভূমিকা রাখতে চাই।

(২০১৬ সালের আগার আর্ট প্রতিযোগীতায় বিজয়ীদের আঁকা ছবিগুলো দেখতে পারেন এখানে)