আনন্দপুরে গ্যাস পাওয়ার আনন্দ
সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলার আনন্দপুর গ্রামে দেশের ২৮তম গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে। গ্যাস পাওয়ার খবরটি যেন আনন্দপুর গ্রামের মানুষের জন্য বেশিই আনন্দের।
সকালের চনমনে রোদ সঙ্গী করে যখন সিলেট শহর ছেড়েছিলাম, তখন ভাবনাতেও ছিল না গন্তব্যে পৌঁছে এমন ঝোড়ো বৃষ্টির অভ্যর্থনা পাব। থেমে থেমে বৃষ্টি ঝরল ৮ আগস্ট, দিনভর। জকিগঞ্জ পৌরসভার আনন্দপুর পশ্চিম গ্রামের যে বাড়িতে আচমকা আশ্রয় নিয়েছিলাম, সেখানেই নেওয়ারুন্নেসা খাতুনের সঙ্গে দেখা। পঞ্চাশোর্ধ্ব এই নারী মাটির চুলায় দুপুরের রান্না চড়িয়েছেন। পাশের রান্নাঘর ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন। ধোঁয়া কাটাতে কিছুক্ষণ পরপর গিয়ে তিনি চুলায় ফুঁ দিচ্ছিলেন। একসময় লাকড়ি জ্বলে উঠলে কাছে এসে আমাদের সঙ্গে আলাপ শুরু করেন।
বৃষ্টিবিঘ্নিত সময়ে নেওয়ারুন্নেসার সঙ্গে কী আলাপ হলো, তা বলার আগে জানিয়ে রাখি আনন্দপুর যাওয়ার উদ্দেশ্য। অনেকের জানা, সম্প্রতি দেশে ২৮তম গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে। সেই গ্যাসক্ষেত্র শহর সিলেট থেকে ৯২ কিলোমিটার দূরের সীমান্তবর্তী এই গ্রামে। সরকারিভাবে ৯ আগস্ট তার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা এসেছে। আমরা ঘুরতে এসেছি আনন্দপুর গ্রামের সেই গ্যাসক্ষেত্রে। নেওয়ারুন্নেসা সে কথা শুনে হাসিমুখে বলছিলেন, ‘গ্রামেই গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হলো, এখান থেকে যদি কিছুটা গ্যাস আমাদের দেওয়া হয়, তাহলেই লাকড়ি জ্বালানোর ভোগান্তি থেকে বাঁচি!’
নেওয়ারুন্নেসার কণ্ঠে গ্যাস পাওয়ার যে অধিকার মিশে থাকল, এমন অধিকার গ্রামের অনেকের কণ্ঠেই। নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হওয়ায় শুধু জাতীয় গ্রিডে গ্যাস সরবরাহ বাড়বে তা নয়, স্থানীয়দের জ্বালানি চাহিদা যে মিটবে, পৌর শহরেও চাউর হয়েছে এমনটা। তাই গ্যাসক্ষেত্রের কথা পাড়তেই আনন্দপুর গ্রামের বাসিন্দাদের চোখেমুখে যেন আনন্দের ঝিলিক দেখা গেল।
সিলেট-জকিগঞ্জ সড়কের এক পাশে এই গ্যাসক্ষেত্র, অন্য পাশে ফায়ার সার্ভিস স্টেশন। গ্যাসক্ষেত্রের আশপাশে যেমন ধান চাষের জমি আছে, তেমনি অনাবাদি জমিও আছে। বৃক্ষরাজিতে এমনিতেই ছায়াময় পরিবেশ, তার ওপর মেঘলা দিন বলেই পরিবেশটা প্রায় অন্ধকারাচ্ছন্ন। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি মাথায় নিয়ে হাজির হয়েছিলাম গ্যাসক্ষেত্রের ফটকে।
গ্যাসক্ষেত্রে একচক্কর
কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে প্রবেশ করেছিলাম গ্যাসক্ষেত্রে। তবে প্রবেশের অনুমতি মিললেও কারও সঙ্গে আলাপ করার অনুমতি মিলল না। কিছু শর্ত মেনে ঘুরে দেখলাম গ্যাসক্ষেত্র। চারপাশে লোহালক্কড়ের স্তূপ। খননকাজে ব্যবহৃত নানা যন্ত্র। তখনো বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী গ্যাসক্ষেত্রের খননযন্ত্রের (রিগ) আশপাশে কাজ করছিলেন।
এই গ্যাসক্ষেত্র থেকে জাতীয় গ্রিডে গ্যাস সঞ্চালনের লক্ষ্যে এরই মধ্যে পাইপলাইন নির্মাণের প্রকল্প নিতে নির্দেশনা দিয়েছে জ্বালানি বিভাগ। এখানে ৩৫ কিলোমিটার পাইপলাইন নির্মাণ করতে হবে। জকিগঞ্জে নিযুক্ত বাপেক্সের খনন অধিকর্তা মহসিনুল আলমের কাছে পড়ে জেনেছি গ্যাসক্ষেত্রের এসব তথ্য। তখন তিনি বলেন, ‘(গ্যাসক্ষেত্রে) বাপেক্সের সব ধরনের কাজ শেষ হয়েছে। এখন এখান থেকে আমরা চলে যাব। আশপাশে আরও দুটি ড্রিলিং (খনন) হবে, সেখানে আমরা কাজ করব। তবে পাইপলাইন নির্মাণের আগে যেসব টুকটাক কাজ রয়েছে, সেসব এখন করা হচ্ছে। আগামী দুই বছরের মধ্যে পাইপলাইন নির্মাণ শেষে জকিগঞ্জ গ্যাসক্ষেত্র থেকে জাতীয় গ্রিডে গ্যাস সরবরাহের পরিকল্পনা রয়েছে।’
আবিষ্কৃত গ্যাসক্ষেত্রে গত ১ মার্চ অনুসন্ধান কূপ খনন শুরু হয়। ৭ মে খননকাজ শেষ হয়। এতে চারটি স্তরে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তিনটিতে গ্যাস পাওয়া যায়নি। একটি স্তরে বাণিজ্যিকভাবে উত্তোলনের মতো গ্যাস পাওয়া যায়। বাপেক্স সূত্রে জানা গেছে, জকিগঞ্জে ২ হাজার ৯৮১ মিটার খনন করা হয়। এর মধ্যে ২ হাজার ৮৭২ মিটার অংশ থেকে গ্যাস পাওয়া গেছে। খননকাজে প্রতিদিন গড়ে ৩০০ মানুষ কাজ করেছেন।
হঠাৎ জ্বলে উঠল আগুন
গ্যাসক্ষেত্রের ঠিক পাশেই একটি চায়ের দোকান। সেখানে কয়েকজন যুবক বসে চায়ের আড্ডায় মেতে ছিলেন। তাঁদের সঙ্গে আমাদের আলাপ জমতে সময় লাগল না। একজন বললেন, যে স্থানে গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে, সেখানে একসময় ধান চাষের জমি, কিছু গাছপালা ও জলাশয় ছিল। বাপেক্সের তথ্য বলছে, ২০১৬-১৭ সালে দ্বিমাত্রিক ভূকম্পন জরিপ চালিয়ে গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেওয়ায় আশপাশের প্রায় পাঁচ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়।
২০১৭ সালে আনুষ্ঠানিক কাজ শুরু হয়। এরপর থেকেই আশায় বুক বাঁধতে থাকেন স্থানীয় ব্যক্তিরাও। তবে দিন দিন গ্রামের মানুষের মধ্যে সেই আশা ফিকে হয়ে আসছিল। একজন বললেন, ‘ভেতরে তো গোপনীয়তা রাখা হতো, জানতাম না কী হচ্ছে। তাই মনে হতো, এমনিতেই মনে হয় খনন করছে।’
তবে গ্রামের সবাইকে অবাক করার মতো ঘটনা ঘটল গত ১৫ জুন। সেদিনই অগ্নিশিখা জ্বালায় বাপেক্স। সকাল সোয়া ১০টায় যে অগ্নিশিখা জ্বলল, সে খবর মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ল আনন্দপুর থেকে সমগ্র জকিগঞ্জে। আনন্দপুর গ্রামের মাটির নিচে এত গ্যাস পাওয়া যেতে পারে, এটা যাঁদের কল্পনাতেও ছিল না, সেদিন তাঁরা যেমন বিস্মিত হলেন, তেমনি আনন্দিতও। তিন দিন ধরে অগ্নিশিখাটি জ্বালিয়ে রাখল বাপেক্স। পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে নিভিয়েও দেওয়া হয়। তবে এই সময় হাজার হাজার মানুষ ভিড় করেছিল নতুন গ্যাসক্ষেত্র দেখতে।
চায়ের দোকানে যুবকদের সঙ্গে আলাপের সময় পাশে থেকে যোগ দিলেন দোকানটির মালিক কামাল আহমেদ। স্নাতক পাস এই তরুণ জানালেন, তাঁদের পারিবারিক জমি অধিগ্রহণের আওতাভুক্ত হয়েছে। নিজেদের জমির নিচে গ্যাস আছে, এটা ভাবতেই নাকি তাঁর আনন্দ লাগে। তিনি বললেন, ‘এলপিজি সিলিন্ডার গ্যাসে দোকানে চা বানাই। এতে খরচ বেশি পড়ে। গ্রামে গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে, সুবিধা নিশ্চয় দেবে, এটা ভাবতেই গর্ব লাগে।’
গর্ব শুধু গ্যাস প্রাপ্তির জন্য নয়, এই গ্যাসক্ষেত্রে স্থানীয় কয়েকজন কাজ পেয়েছেন। অনেক তরুণ স্বপ্ন দেখছেন, তাঁদেরও কোনো কর্মসংস্থান হবে। উন্নতির ছোঁয়া লাগবে তাঁদের গ্রামে। সেই ছোঁয়ায় তাঁদেরও যে উন্নতি হবে, তা বলাই বাহুল্য। তবে গ্রামের এই যুবকদের সবচেয়ে গর্বের জায়গা আনন্দপুরের গ্যাসক্ষেত্রের জাতীয় অবদান। তাঁদের কথা অনেকটা যেন এমন, আনন্দপুর আজ শুধু জকিগঞ্জের একটি সাধারণ গ্রাম নয়, আনন্দপুরের স্থান এখন জাতীয় পর্যায়ে!