এখানে বাইক ধুয়ে বৃষ্টি নামানো হয়

আঁকা: জুনায়েদ আজিম চৌধুরী

সকাল সকাল কে যেন কলিংবেলটা চেপে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। হয়তো ময়লা নিতে এসেছে। মেজাজটা বিগড়ে গেল সকাল সকাল! ছুটির দিনে ইচ্ছেমতো ঘুমানোর সাধ এ জীবনে হয়তো আর মিটবে না! প্রচণ্ড অনিচ্ছায় বিছানা ছেড়ে উঠে দরজা খুলে যে–ই না একটা ঝাড়ি মারতে যাব, দেখি, সামনে আধভেজা শরীরে একটা লাউ আকারের বাঙ্গি হাতে দাঁড়িয়ে আছে আমার সবচেয়ে...কী ভাবছেন? ‘প্রিয়’, ‘ভালোবাসার’ কিংবা ‘আদরের’—এসব বিশেষণ জুড়ে দেব? একটু আগেই বলছিলাম, ছুটির দিনে ঘুমানোর যে স্বপ্ন আমি দেখি, সেই স্বপ্ন ভাঙার খলনায়ক, আমার সবচেয়ে অপ্রিয় মন্টু মামা দাঁড়িয়ে আছে দরজায়!

মামা এবং বাঙ্গি—সকাল সকাল দুই অপ্রিয় জিনিসের এমন ‘পারফেক্ট কম্বিনেশন’ দেখেই রাগের একটা ধারা শিরদাঁড়া বেয়ে মাথায় উঠে গেল!

‘গুড মর্নিং মামুজান, আপা এত করে বলল, তাই চলে আসলাম।’

কিছু বলা লাগে বলে জানতে চাইলাম, ‘বাইরে কি বৃষ্টি? তুমি এ রকম ভেজা কেন?’

‘আরে কিয়ের বৃষ্টি, মামু! ঘামছি, ঘাইম্মা ভিজ্যা গেছি, বাইরে মনে হইতাছে এক হাত উপ্রে সূর্য ঝুইল্লা আছে। দেখো, গরমে বাঙ্গিডাও ফাইট্টা গেছে, সেকেন্ড সিরিয়ালে আছে আমার চান্দি! দেহি, বাঙ্গিডা ধরো!’ বলেই আমার হাতে বাঙ্গি ধরিয়ে মামা আমার রুমের দিকে হনহন করে হাঁটা দিল।

মামাকে অপছন্দের বেশ কিছু কারণ আছে। মামা বাসায় আসা মানেই আমার রুম, গ্যাজেট, বাইক এসব তার দখলে চলে যাওয়া। বাড়ির ভেতরে শব্দের মাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়া। মামা এলে আমার নিজের বাড়িতে নিজেকেই কেমন যেন অতিথি মনে হয়! আজকেও আমার রুমের খাট দখল করে ফ্যানের বাতাসে আরামে শুয়ে হালকা ঠান্ডা হয়ে শুরু করল বকবক, ‘বুঝলা মামু, ছোটবেলায় এমন গরম পড়লে আমাগো গ্রামের মানুষের মধ্যে হাহাকার পইড়া যাইত বৃষ্টির লাইগা। গ্রাম ভইরা মানুষ “আল্লা মেঘ দে, পানি দে, ছায়া দে রে তুই” গাইয়া বৃষ্টি কামনা করত! কেউ কেউ আবার দিত ব্যাঙের বিয়া! ভাবত, বিয়া দেওয়ার পর ব্যাঙের ডাকে বৃষ্টি নামব! আমিও তো কত ডাকতাম, না হইল আমার বিয়া, না পড়ল বৃষ্টি! শুনছি, চায়নার বিজ্ঞানীরা নাকি কৃত্রিম মেঘ বানাইয়া বৃষ্টি নামাইতে ঘাম ছুটাইয়া ফালাইতাছে। তবে তুমি যে ম্যাজিক জানো, তাতে অন্য কারও ভাত নাই! এইবার আমি কাস্টমার রেডি কইরা আইছি জেলায় জেলায়। তুমারে হায়ারে নিয়া যামু।’

মামা এমন লম্বা কথার আমি আগামাথা কিছুই বুঝলাম না, ‘কিসের ম্যাজিক, কিসের হায়ার?’

‘বালতি আর মগটা নিয়া বাইর হও, চলো আমার লগে, কইতাছি।’

‘আরে মামা, বালতি–মগ নিয়ে কই যাব? মাত্র তো উঠলাম, একটু পরে বের হই?’

‘ঢাকার মানুষ আজকে তোমার মুখের দিকে চাইয়া আছে, মামু, এদের বাঁচাও, আমারেও বাঁচাও। মামা মইরা গেলে বুঝবা কী হারাইছ!’

না পেরে ঘর থেকে বের হতেই মামা আমাকে নিয়ে এল বাইকের গ্যারেজে। হাতে বালতি আর মগ।

‘মামা, সমস্যা কী তোমার? সাতসকালে ঘুম থেকে উঠিয়ে জোর করে আমাকে গ্যারেজে আনার মানে কী?’

‘তুমি বাইক ধুইলেই তো বৃষ্টি নামে, মামু! আমি তো জানি সেইটা! শোনো, তোমারে আসল কথা কই! আপা–টাপা আমারে আইতে কয় নাই, বাড়িতে এমন গরম পড়ছে কয়ডা দিন, টিকতে না পাইরা ঢাকায় আইছি তোমার ম্যাজিকের উপর ভরসা কইরা। তানসেন গান গাইয়া বৃষ্টি নামাইত, আমার মামু বাইক ধুইয়া বৃষ্টি নামায়, ব্যাপারটা কিন্তু আমার জন্য কম গর্বের না, বুঝলা?’

মামা নিজেও এ রকম একাধিক ঘটনার সাক্ষী। তাই বহুদিন থেকেই মামার ধারণা, ব্যাঙের বিয়ে, ‘মেঘ দে পানি দে’ গানের চেয়ে আমার ‘বাইকে পানি দে’ থিওরি বৃষ্টি নামানোয় বেশি কার্যকর।

এবার ঘটনা বোঝা গেল! একেই বোধ হয় বলে কারও সর্বনাশ করে কারও পৌষ মাসের প্রস্তুতি নেওয়া! আমি আসলে বাইকে ময়লা ব্যাপারটা একদমই নিতে পারি না। আর এই ময়লা ধুয়ে যেদিনই বাইক ঝকঝকে আয়নার মতো বানিয়ে রাস্তায় নামি, সেদিন কাঠফাটা রোদ থাকলেও কিছু যায়–আসে না। যায়–আসে না আবহাওয়া অধিদপ্তরের আগামী কয়েক মাসে বৃষ্টি না হওয়ার ভবিষ্যদ্বাণী থাকলেও। রেইন মাস্ট বি রিডিং! মানে, বৃষ্টি পড়বেই! আর আমার অবস্থা হলো বাইক ধুয়ে কাদার সাগর ঠেলে আগের চেয়েও ভয়ংকর নোংরা একটা বাইক নিয়ে বাসায় ঢোকা!

মামা নিজেও এ রকম একাধিক ঘটনার সাক্ষী। তাই বহুদিন থেকেই মামার ধারণা, ব্যাঙের বিয়ে, ‘মেঘ দে পানি দে’ গানের চেয়ে আমার ‘বাইকে পানি দে’ থিওরি বৃষ্টি নামানোয় বেশি কার্যকর। তবে আমার কাছে ব্যাপারটা মামার মতো শক্তপোক্ত বিশ্বাসের পর্যায়ে এখনো যেতে পারেনি। ব্যাপারটাকে আমি এখনো কাকতলীয়ই ভাবি!

আমি বলি, ‘মামা, গ্রামে থাকতে থাকতে তোমার মাথায় যে কুসংস্কার বেশি কাজ করে, এটা বুঝো? আজকে যে গরম, এর মধ্যে আমি বাইক ধুলেই বৃষ্টি নামবে, এটা আসলেই তুমি বিশ্বাস করো? এই যে দেখো, গুগল ওয়েদারে আজকে সারা দিনে বৃষ্টির কোনো ছিটেফোঁটা হওয়ারও সম্ভাবনা নাই!’

‘ওই সব আমারে বুঝাইস না! আমি বালতিতে পানি পর্যন্ত আইন্না দিতাছি, তুই একটু কষ্ট কইরা ধুয়া ফালা, মামু!’

গ্যারেজে যখন এসেই পড়ছি, আর মামা যখন হাতের কাছে পানি জোগাড় করে দিল, তখন বাইকটা ধুয়ে ফ্রেশ লুকে নিয়ে আসার ব্যাপারটা খুব একটা মন্দ হয় না। আমি বাইক ধুতে শুরু করলাম।

গরমে মামা–ভাগনে টপটপ করে ঘামছি। আমার খারাপই লাগছে, গ্রাম থেকে একটা মানুষ একটা ভ্রান্ত ধারণা নিয়ে দরদর করে ঘামতে ঘামতে ঢাকায় এসেছে, আজকে তার মনটাই ভেঙে যাবে। তবে আমার ইচ্ছা, মন ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে মামার (আমারও) এই ‘আমি বাইক ধুলেই বৃষ্টি নামে’ এই ভ্রান্ত ধারণাটাও ভাঙুক। বাইরে যেমন রোদ, তাতে আগামী কয়েক দিনেও বৃষ্টি তো দূরের কথা মেঘের আড়ালে সূর্য যাওয়ারও সম্ভাবনা নেই। আমি বাইক ধুচ্ছি আর মামার বকবক শুনছি, ‘বুঝলা মামু, আমি আমার নোয়াখালীল এক বন্ধুরে তোমার কথা কইছি; সে কইছে, তোমারেসহ বাইক নিয়া নোয়াখালীতে যাইতে। সে বালতি নিয়া রেডি থাকবে। আরেকজন তো কইছে তোমারে বরিশাল নিয়া যাইব, তুমি যদি বাইক ধুয়াইয়া বৃষ্টি নামানোর ম্যাজিক দেখাইতে পারো তাইলে তুমারে টেকার মালা দিয়া লঞ্চে লঞ্চে...’।

‘মামা, তোমার কারণে বোধ হয় শেষমেশ জুতার মালা গলায় দিয়ে ঘুরতে হবে আমাকে! এগুলা কী শুরু করছ তুমি?’

আমার বাইক ধোয়া প্রায় শেষ। মামার বকবকানি আর আকাশকুসুম কল্পনা শেষ হয় না! আমার পকেটে ফোন বেজে যাচ্ছে অনেকক্ষণ ধরেই। বের করে দেখি, আম্মার ফোন। সকাল থেকে আম্মাকে বাসায় দেখছি না, আম্মা থাকলে মামার বকবকানির ভাগ কিছুটা তার ভাগেও পড়ত, আমি দুদণ্ড শান্তি পেতাম! ফোনটা ধরতেই আম্মার উদ্বিগ্ন কণ্ঠ, ‘কী রে, ফোন ধরস না কেন? আমি সকালে তোর মুনিরা খালার বাসায় আসছি, আসার আগে ছাদে কাপড় শুকাইতে দিয়ে আসছিলাম। তাড়াতাড়ি ছাদে যা, কাপড়গুলো নিয়ে আয়, এদিকে তো বৃষ্টি শুরু হইছে!’