গরম থেকে ঘাম, নাকি ঘাম থেকে গরম

শব্দের রয়েছে বিচিত্র রকম অর্থ, বিচিত্র রকম প্রয়োগ। অনেক ক্ষেত্রে এক শব্দ একাধিক অর্থে প্রয়োগ হয়; অনেক ক্ষেত্রে মূল অর্থ ছাপিয়ে ভিন্ন অর্থ প্রধান হয়। কিছু অর্থ, কিছু প্রয়োগ আবার অভিধান সমর্থন করে না। শব্দের উৎস, অর্থ আর প্রয়োগবৈচিত্র্য নিয়ে আমাদের এই আয়োজন...

কোলাজ: একটু থামুন

ছুটির দিন। সময় বেলা সাড়ে ১১টার মতো হবে। সৈয়দ ঘণ্টন হাতে কিছু কাপড় ধুয়ে শুকানোর জন্য ছাদে উঠলেন। চড়া রোদ। বেশিক্ষণ থাকা যাবে না। তাই তাড়াতাড়ি করে ভেজা কাপড়গুলো দড়িতে শুকাতে দিলেন। এরপর নেমে আসার আগে কী মনে করে ছাদের কিনারে গিয়ে নিচের রাস্তায় উঁকি দিলেন।

পাশের ফ্ল্যাটের বরকত সাহেব বাজার করে ফিরছেন। এক হাতে বাজারের ব্যাগ নিয়ে, আরেক হাতে একটা মস্ত পাকা তাল ধরে বেশ কায়দা করে হেঁটে আসছেন। তার শরীর দিয়ে দরদর করে ঘাম পড়ছে। সৈয়দ ঘণ্টন ছাদের ওপর থেকে ডাক দিলেন, ‘বাজারে তাল উঠেছে নাকি?’

পাকা তাল দেখে বোঝা যায়, ভাদ্র শুরু হয়েছে। কিংবা অন্যভাবে বলা যায়, ভাদ্রের গরমে তাল পাকতে শুরু করে। ‘তালপাকা গরম’ কথাটা তো আর এমনি চালু হয়নি। বরকত সাহেব নিচ থেকে ঘাড় উঁচু করে ওপরের দিকে তাকালেন। ছাদের ওপর থেকে এই মধ্যদুপুরে কে ডাকছে, বুঝে উঠতে তার কিছু সময় লাগল। তারপর উঁচু গলায় জবাব দিলেন, ‘আজকাল বাজারে তাল ওঠে নাকি? পেলাম আরকি!’

ছবি: প্রথম আলো

ঢাকার রাস্তায় এখানে-ওখানে তালের শাঁস পাওয়া যায়। কাঁচা তালের দাম ভালো পাওয়া যায় বলে আগেই সব তাল কেটে বিক্রি করা হয়। বাজারে সহজে পাকা তাল দেখা যায় না। সৈয়দ ঘণ্টন একটু মজা করে বললেন, ‘তা এই তাল থেকে রস বের করে পিঠা বানানোর কর্মী আছে নাকি আপনার ঘরে?’

বরকত সাহেব ততক্ষণে বিল্ডিংয়ের সামনে চলে এসেছেন। বাজারের ব্যাগ আর তালটা গেটের ভেতর রেখে কপালের ঘাম তর্জনী দিয়ে ঝাড়লেন। তারপর খানিক লাজুক হেসে বললেন, ‘বিকালে এসে পিঠা খেয়ে যাবেন।’

‘সে দেখা যাবেখন!’ এজাতীয় একটা বাক্য বলে সৈয়দ ঘণ্টন ছাদের কিনার থেকে সরে এলেন। গরমের মধ্যে ছাদে দাঁড়ানো যাচ্ছে না। আর নিচে বরকত সাহেবও ঘেমেনেয়ে একশেষ। ছাদের ওপর থেকে আর নিচের রাস্তা থেকে কথা চালাতে দুজনকেই জোরে কথা বলতে হচ্ছিল।

পাশের ফ্ল্যাটে গিয়ে দাওয়াত খাওয়া, কিংবা রাস্তায় দাঁড়িয়ে আড্ডা দেওয়া সৈয়দ ঘণ্টনকে দিয়ে হয় না। তিনি দাওয়াতের প্রসঙ্গটি তাই আর মনে রাখেননি। কিন্তু সন্ধ্যার আগে আগে বরকত সাহেব তাকে জোর করে নিয়ে গেলেন নিজের ফ্ল্যাটে। বললেন, ‘না গেলে আপনার ভাবি খুব রাগ করবে। দুপুরবেলা বলছিলেন, আমার বাড়িতে পিঠা বানানোর কর্মী আছে কি না। কথাটা আমার স্ত্রী শুনেছে।’

সৈয়দ ঘণ্টন এবার নিজেই লজ্জিত হলেন। বরকত সাহেবের পীড়াপীড়িতে তার ফ্ল্যাটে গেলেন। দুরকম পিঠা আর সঙ্গে পায়েসও আছে। বরকত সাহেবের স্ত্রী ডাইনিং টেবিলে সেগুলো সাজিয়ে রেখে অতিথি আপ্যায়নের অপেক্ষা করছিলেন। ঘণ্টন সাহেব ভোজনপ্রিয় লোক নন। তবে পিঠা-পায়েস পরিবেশনের ভঙ্গি তাকে মুগ্ধ করল। বরকত সাহেব বিনয়ের সঙ্গে বললেন, ‘তখন গরম থেকে ঘেমে গিয়েছিলাম। বেশিক্ষণ নিচ থেকে দাঁড়িয়ে আপনার সঙ্গে কথা বলতে পারিনি।’

জবাবে সৈয়দ ঘণ্টন বললেন, ‘না, না, রোদের কারণে আমিও তো ছাদ থেকে নেমে এলাম।...তবে গরম থেকে ঘাম হয়, এটা আপনাকে কে বলল? আমি তো জানি, ঘাম থেকে গরম হয়েছে।’

সৈয়দ ঘণ্টনের কথার দ্বিতীয় অংশ বেশ রহস্যময় মনে হলো বরকত সাহেবের কাছে। তিনি ঘণ্টন সাহেবের চোখের দিকে তাকিয়ে নিচু গলায় টেনে টেনে বললেন, ‘আপনার কথা ঠিক বুঝতে পারছি না।’

কোলাজ: একটু থামুন

‘বলছিলাম, গরম থেকে ঘাম হয়েছে? নাকি ঘাম থেকে গরম হয়েছে?’ সরাসরি প্রশ্ন রাখেন সৈয়দ ঘণ্টন।

আমতা আমতা করে বরকত সাহেব বললেন, ‘গরমের কারণেই তো ঘাম হয় জানি!’ এরপর হঠাৎ তার মনে হলো, সৈয়দ ঘণ্টন শব্দের উৎস নিয়ে পড়াশোনা করেন। তাই দ্রুত নিজের কথার সঙ্গে যোগ করলেন, ‘আপনি কি শব্দের উৎপত্তির কথা বলছেন?’

এবার সৈয়দ ঘণ্টন মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ, শব্দের উৎসের কথা বলছি। সংস্কৃত “ঘর্ম” আর বাংলা “গরম” শব্দের একই অর্থ। ঘর্ম থেকেই বাংলা গরম শব্দটি এসেছে। ইংরেজি Warm এবং জার্মান Thermos শব্দও একই অর্থ প্রকাশ করে। ঘর্ম, গরম, Warm, Thermos এসব শব্দের মধ্যে ধ্বনিগত মিলও অনেক। তাই বলা হয়ে থাকে, ভারতের ভাষা আর ইউরোপের ভাষা একই বংশ থেকে এসেছে। এর নাম ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাবংশ।’

‘ঘর্ম, গরম শব্দের একই অর্থ?’ বরকত সাহেব খানিক দ্বিধার মধ্যে পড়ে যান, ‘আমি তো জানি ঘর্ম বা ঘাম মানে গরমের কারণে শরীর থেকে যে পানি বের হয়।’

সৈয়দ ঘণ্টন মৃদু হেসে বললেন, ‘ঘাম থেকে ঘামাচি হয়েছে, কিংবা বলা যায় ঘর্ম থেকে ঘর্মচর্চিকা হয়েছে। তবে ঘামাচির ঘাম কিংবা ঘর্মচর্চিকার ঘর্মের মূল অর্থ গরম।’

‘সংস্কৃতে ঘর্ম মানে গরম। আর গরমের কারণে শরীর থেকে যে পানি বের হয়, তাকে বলে “স্বেদ”। সংস্কৃত স্বেদ আর ইংরেজি Sweat শব্দের মধ্যেও কিন্তু ধ্বনিগত মিল আছে।’

‘তাহলে পুরো ব্যাপারটা কী দাঁড়াল?’ বরকত সাহেব বিষয়টা সহজ করে বুঝে নিতে চাইলেন।

‘ব্যাপার দাঁড়াল এই, সংস্কৃত ঘর্ম থেকে বাংলায় ঘাম শব্দটি এসেছে। কিন্তু মূলে ঘর্ম বা ঘাম শব্দের অর্থ গরম। আমরা অবশ্য ঘর্ম আর ঘাম দুটি শব্দই স্বেদ অর্থে ব্যবহার করি।’

এতক্ষণ বরকত সাহেবের স্ত্রী চুপ করে শুনছিলেন। সুযোগ বুঝে তিনি বললেন, ‘এই ঘাম থেকেই ঘামাচি হয়েছে; তাই না, ভাই?’

সৈয়দ ঘণ্টন মৃদু হেসে বললেন, ‘ঘাম থেকে ঘামাচি হয়েছে, কিংবা বলা যায় ঘর্ম থেকে ঘর্মচর্চিকা হয়েছে। তবে ঘামাচির ঘাম কিংবা ঘর্মচর্চিকার ঘর্মের মূল অর্থ গরম।’

‘তাহলে কি আমরা ভুল অর্থে ঘাম বা ঘর্ম শব্দ ব্যবহার করছি?’ বরকত সাহেব দ্বিধা নিয়ে জানতে চান।

‘মোটেই না।’ সৈয়দ ঘণ্টন হেসে বললেন, ‘এক ভাষার শব্দ আরেক ভাষায় এ রকম অর্থবৈচিত্র্য নিয়ে ঢুকতে পারে।’

‘ঘাম নিয়ে অনেক হয়েছে, ভাই!’ মিসেস বরকত পিঠা-পায়েসের বাটি দুটি এগিয়ে দিলেন, ‘এবার শুরু করুন তো!’

তারিক মনজুর: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক

আরও পড়ুন