গোপালভোগের আরেক চেহারা

পেক্সেলস

বন্ধুদের আড্ডায় ফট করে একজন কথাটা বলে বসল। সে বলল, ‘আমার মামা বলেছিলেন, নামে কী বা আসে যায়।’

পাশের বন্ধু বলল, ‘ওরে মামা, চাপাবাজি থামা! নামের কথাটা তো শেক্‌সপিয়ারের!’

‘আরে ব্যাটা, শেক্‌সপিয়ারকে আমার মা ভাই বানাইছিল, তাই...।’

ঢাকা শহরে পথঘাটে মামার অভাব নেই। চা–দোকানি মামা, রিকশাওয়ালা মামা, বাস কন্ডাক্টর মামা... আরও কত মামা! পুরো ঢাকা শহরকেই খাঁটি নানাবাড়ি হিসেবে মেনে নেওয়া এখন সময়ের ব্যাপারমাত্র। আমজনতার এহেন আচরণ থেকে আমরা বরং আমের দিকে নজর দিই।

ছোট্ট পৃথ্বী পড়াশোনা করছে, ‘অ’–তে অজগর ওই আসছে তেড়ে, ‘আ’–তে আমটি আমি খাব পেড়ে... পড়তে পড়তেই পৃথ্বী ভাবল, এত উঁচু গাছ থেকে আম কীভাবে পাড়বে সে! আমার কাছে এসে বলল, ‘বাবা, বাবা, আমটা পেড়ে দাও।’

আমি বললাম, ‘আমার হাত তো অত লম্বা না। তুমি এক কাজ করতে পারো। দোতলায় উকিল আঙ্কেলের কাছে যাও। উনি পারবেন নিশ্চয়ই।’

পৃথ্বীর পাল্টা প্রশ্ন, ‘উনি কেন পারবেন?’

‘শুনেছি, আইনের হাত অনেক লম্বা।’ আমার ঝটপট উত্তর। পৃথ্বী এই কৌতুকের সারমর্ম বুঝল কি বুঝল না, তা নিয়ে আমি মাথা ঘামালাম না।

অলংকরণ: একটু থামুন

আর পৃথ্বী আম পাড়াতে পেড়েছিল কি না, সেটা নিয়েও মাথা ঘামালাম না আমি। ভাবতে বসলাম অন্য এক বিষয় নিয়ে। আচ্ছা, আমের নামগুলো এমন কেন? প্রথমেই আসি গোপালভোগের কথায়। ভোগ কথাটা শুনলে আমার প্রথমেই মনে পড়ে বিশ্ববিখ্যাত ফ্যাশন ম্যাগাজিন ভোগ–এর কথা। আর এখান থেকেই চট করে মাথায় আইডিয়া খেলে গেল, যদি হাসির রাজা গোপাল ভাঁড় এই ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদের জন্য মডেল হিসেবে নির্বাচিত হতো, তাহলে কী হতো? ভোগ এর আগে ছোট ফন্টে গোপাল লিখে দিলেই হয়ে যেত ‘গোপালভোগ’! এমন অদ্ভুত ভাবনায় পেয়ে বসল আমাকে। তারপর ভাবনা ডালপালা মেলতে শুরু করল।

অলংকরণ: একটু থামুন

ভাবনার সেই ডালে দেখা পেলাম হাঁড়িভাঙা আমের। ব্যাপারটা ভেবে চিন্তায় পড়ে গেলাম। এই যে হাঁড়িভাঙা আম কেউ যদি হাটে বিক্রি করতে যায়, তাহলে ব্যাপারটা কী দাঁড়াবে? হাটে হাঁড়িভাঙা—ব্যাপারটা কি ঠিক হবে? আমরা কত বিচিত্র বিষয় লালন করি। লালনের কথায় মনে পড়ল পালনের কথা। আচ্ছা, আমরা কি কখনো আম পালি? তাহলে এই প্রশ্নটারও জবাব দিন, আম্রপালি নামটা কেন রাখা হয়েছে? আমরা আম পালি নাকি আম ফলটা পালি ভাষার পণ্ডিত?

স্কুলজীবনে একবার এক বন্ধুর সঙ্গে তর্কে জড়ানোয় স্যারের মার খেতে হয়েছিল। এত সুস্বাদু ফল আম থাকার পরও কাঁঠাল কেন জাতীয় ফল, তর্কের বিষয় ছিল এটাই। স্যার বললেন, ‘হাত পাত।’ তারপর সপাং সপাং করে দুই জনের দুটি করে মোট চার হাতে আটটা বেতের বাড়ি পড়ল। মারার পর স্যার বললেন, ‘এই বেতটা আসলে বেত না। আম গাছের ডাল। ইস্যু যেহেতু জাতীয়, তাই জাতীয় গাছের ডাল দিয়েই মারলাম।’

অলংকরণ: একটু থামুন

মার খাওয়া দিনের কথা ভুলিয়ে দিল আম খাওয়া দিন। আমের দিনে বাড়ির চারপাশের নানান জাতের আমগাছের কথা মনে পড়ে গেল। গাছের ডালে বসে পাকা আম খাওয়া, আহা! হাতের কবজি বেয়ে রস চুইয়ে পড়ার সময় সেই রস চেটে খাওয়া...আহা শৈশব–কৈশোর! সেসব দিনের কথা কি ভোলা যায়! স্বাদে অনন্য ল্যাংড়া আম। এত সুন্দর আর সুস্বাদু আমটা হাতে নিয়ে ভালো করে দেখলাম। না আছে এর পা, না আছে ক্রাচ। তাহলে এর নাম ল্যাংড়া হলো কেন? এখানে নামকরণের সার্থকতা দারুণভাবে ব্যর্থতায় পর্যবসিত।

পেক্সেলস

এক বন্ধুর সঙ্গে হিমসাগর নামটা নিয়েও কথা বললাম, ‘সাগর হিম হয় কীভাবে?’

বন্ধু বলল, ‘অ্যান্টার্কটিকায় যাও। টেস্ট করে আসো সাগর কেমন হিম থাকে।’

টেস্টের কথায় মনে পড়ল আরেকটি আমের কথা। ফজলি আম। এই একটিমাত্র আম আমার অপছন্দের। এত বড় সাইজ, কিন্তু কোনো ‘টেস্ট’ বা মজা নেই। পুরো আম্রসমাজের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে এই একটি আমই যথেষ্ট। আমাদের সমাজে কিছু ক্ষেত্রে অনেকে অনেক বড় পদে আসীন। দেখতে বড় দেখালেও এরা আসলে কাজকর্মে বড় নয়। যেমনটা ফজলি আম। এসব মানুষের চারপাশে থাকে অনেক অনেক ‘পাতি’ লোকজন। পাতি লোকজনের কথাপ্রসঙ্গে একটা পাতি আমের নাম মনে পড়ল। আমটার নাম ক্ষীরশাপাতি। সমাজে পাতি লোকদের কদর না থাকলেও ক্ষীরশাপাতির ব্যাপক কদর।

ছবি: প্রথম আলো, কোলাজ: একটু থামুন

প্রতিটি জাতের আম চেহারা, রং, ঘ্রাণ আর স্বাদে আলাদা হয়। একসময় ভারতীয় উপমহাদেশের গবেষকেরা আমের প্রায় ১ হাজার ৬৫০টি জাতের একটা তালিকা তৈরি করেছিলেন বলে জানা যায়। এখনো নাকি হাজার রকমের আম পাওয়া যায়। ভেবে আফসোস হচ্ছে, সব মিলিয়ে সম্ভবত ১০–১২ জাতের আমের স্বাদ গ্রহণ করতে পেরেছি। সুন্দর সুন্দর নামের অনেক আম আছে। একটা আমের নাম শীতলপাটি! এটা খেতে হয়, না বিছাতে হয়, সেটাই ভাবছি!

অদ্ভুত অদ্ভুত আরও কিছু নামের আমের কথা বলি, শুনুন। যেমন ইটাকালি। শুনলেই মনে হয় ইটের মধ্যে কালি মাখানো! তারপর আছে বাদশাপছন্দ, রানিপছন্দ, বেগমপছন্দ, রাজাপছন্দ। আচ্ছা, এখন গণতান্ত্রিক বিশ্বে এসব নাম কতটুকু গ্রহণযোগ্য?

বউ ফুসলানি—না না, যা ভাবছেন, তা নয়। এটাও একটা আমের নাম। আপনারা সবাই জানেন, ফুলের মালা হয়। কিন্তু মিছরিমালাও একটা আম। সিন্দুরা, কুয়াপাহাড়ি, চিনি মিছরি, জগৎমোহিনী, রাঙাগুড়ি, তোতাপুরি, মিশ্রিকান্ত, জালিবান্ধা, পাহাড়িয়া, গোলাপখাস, কাকাতুয়া, দাদভোগ, সূর্যপুরি, কাঁচামিঠা, কলামোচা, গোলাপবাস, কিষাণভোগ, বান্দিগুড়ি, রাংগোয়াই, ভাদুরিগুটি, ক্ষীরমন, দুধসর, রংভিলা, পারিজা, বেগমবাহার, পূজারিভোগ, পলকপুরি, রাজলক্ষ্মী, দুধকুমারী, শ্যামলতা, খাট্টাশে, জাওনা, দমমিছরি, মিছরিবসন্ত, মেসোভুলানি, ফুনিয়া, গোলাপবাস, বাতাসাভোগ, মোহনবাঁশি, পরানভোগ, বিড়া, কালিগুটি, পাকচারা, কালিয়াভোগ, দুধসর, কোহিতুর, কালিগুলি, বালিশা... আর কত নাম বলব, বলুন!

এত এত আমের নাম শুনে বলতে বাধ্য হচ্ছি, নামে অনেক কিছুই আসে–যায়। শেক্‌সপিয়ার এত বিচিত্র সব নামের আম খেলে কথাটা তুলে নিতেন নিশ্চিত!