ছাগল মন, মন রে, মন কেন ফুলগাছে টানে...

বাংলাদেশ ছাগলের দুধ উৎপাদনে বিশ্বে দ্বিতীয়, আর ছাগলের সংখ্যা ও মাংস উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ
ছবি: একটু থামুন

বিশ্ব অর্থনীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান ভালো করতে ছাগলের একটি বড় ভূমিকা আছে। যেমন ছাগলের সংখ্যা, মাংস ও দুধ উৎপাদনের দিক থেকে বাংলাদেশ বৈশ্বিক সূচকে ধারাবাহিকভাবে ভালো করছে। বাংলাদেশ ছাগলের দুধ উৎপাদনে বিশ্বে দ্বিতীয়, আর ছাগলের সংখ্যা ও মাংস উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ। আবার ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল বিশ্বের অন্যতম সেরা জাত হিসেবে পরিচিত।

অর্থনীতিতে ভালো করলেও বৈশ্বিক অবস্থানে বাংলাদেশ পিছিয়ে আছে শাসনব্যবস্থা–সংক্রান্ত সব কটি সূচকে। যেমন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) দুর্নীতির ধারণা সূচকে বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১২তম। ট্রেস ইন্টারন্যাশনালের তৈরি করা বিশ্ব ঘুষ সূচকে বাংলাদেশ ২০০ দেশের মধ্যে ১৮২তম। আবার যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা দ্য ওয়ার্ল্ড জাস্টিস প্রজেক্ট (ডব্লিউজেপি) আইনের শাসন সূচক প্রতিবেদন-২০২০-এ বিশ্বের ১২৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১১৫তম।

এ রকম এক অবস্থায় প্রশাসনের কেউ যখন একটি ছাগলকে জরিমানা করে, তখন এর পেছনে কোনো প্রতিহিংসা কাজ করেছে কি না, সে সন্দেহ আমরা করতেই পারি। ঘটনাটি অবশ্য এখন কমবেশি সবারই জানা। বগুড়ার আদমদীঘিতে ফুলগাছ খাওয়ায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে একটি ছাগলকে জরিমানা করেন। তবে ছাগলের অতি দরিদ্র মালিক সাহারা বেগমের অভিযোগ, তাঁর অনুপস্থিতিতে জরিমানা করে ছাগলটি ইউএনও আটকে রাখার পর বিক্রি করে দিয়েছিলেন। মজার ব্যাপার হলো, ভ্রাম্যমাণ আদালতে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে শাস্তি দিতে হলে উপস্থিত থেকে দায় স্বীকার করতে হয়। ছাগলটি কী পদ্ধতিতে দায় স্বীকার করার পর জরিমানার কবলে পড়ল, তা অবশ্য জানা যায়নি। বিষয়টি নিয়ে সংবাদ প্রকাশের পরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তুমুল বিতর্কের পর সেই ইউএনও সীমা শারমিন অবশ্য মালিককে ছাগল ফেরত দিয়েছেন

২.

বগুড়ার জরিমানা গোনা সেই ছাগল
ছবি: ফেসবুক থেকে

ছাগল ফেরত দেওয়ায় আলোচনা যে শেষ হয়ে গেল, তা কিন্তু নয়; বরং একজন সরকারি আমলার এই কর্মকাণ্ড অনেকেই সহজে ভুলতে পারবেন না। যেন না ভুলতে পারেন, সে জন্যেই হয়তো সাংবাদিক পিনাকী রায় ফেসবুকে আলোচিত ও নিরীহ সেই ছাগলের ছবিই প্রকাশ করে দিয়েছেন। সেখানে তিনি লিখেছেন, ‘এটা বগুড়ার জরিমানার সেই ছাগল। কিউট না? এটাকে ঢাকায় প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা হোক।’

প্রদর্শনের ব্যবস্থা শেষ পর্যন্ত হচ্ছে কি না, তা অবশ্য জানা যায়নি।

৩.

ছাগল মন, মন রে...
অ্যানিমেশন: একটু থামুন

ইউএনও হঠাৎ একটি ছাগলকে জরিমানা কেন করলেন, তারও পর্যালোচনা আসলে হওয়া প্রয়োজন। তার আগে একটি কবিতার দুটি লাইন পড়া যাক। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত (১৮১২-১৮৫৯) ছিলেন ঊনবিংশ শতাব্দীর কবি। বলা হয়, তাঁর হাত ধরেই বাংলা কবিতার জগৎ মধ্যযুগীয় সীমানা অতিক্রম করে আধুনিকতার পথে পা বাড়িয়েছিল। তিনি একজন সাংবাদিকও ছিলেন। তিনি ‘পাঁঠা’ নামে একটি কবিতা লিখেছিলেন। সেই কবিতার দুই লাইন ছিল এ রকম—

‘রসভরা রসময় রসের ছাগল।

তোমার কারণে আমি হয়েছি পাগল।।’

৪.

শ্রীব্যাকরণ শিং বি. এ. খাদ্যবিশারদ
অলংকরণ: সুকুমার রায়

ছাগলটির বিরুদ্ধে অভিযোগ, প্রাণীটি ইউএনওর বাগানের ফুলের গাছে মুখ দিয়েছিল। এখন তো বলবেন যে ছাগলে কী না খায়। ইউএনও যখন জরিমানা করছিলেন, তখন ছাগলটি কীভাবে দায় স্বীকার করেছিল, তা সরকারি নথিতে লিখে রাখা হয়েছে কি না, জানা যাচ্ছে না। তবে এখন পর্যন্ত ছাগল একবারই খাওয়া প্রসঙ্গে দায় অস্বীকার করেছিল, সেটা অবশ্য জানা যায়। আর সেই ছাগলের কথা জানিয়েছিলেন সুকুমার রায়, ‘হযবরল’তে। ছাগলটির নাম ছিল ‘শ্রীব্যাকরণ শিং বি. এ. খাদ্যবিশারদ’।

‘হযবরল’ থেকে পড়ি—

‘অমনি কথা নেই বার্তা নেই, ঝোপের আড়াল থেকে একটা মস্ত দাড়িওয়ালা ছাগল হঠাৎ উঁকি মেরে জিজ্ঞাসা করল, “আমার কথা হচ্ছে বুঝি?”

‘আমি বলতে যাচ্ছিলাম “না”, কিন্তু কিছু না বলতেই তড় তড় করে সে বলে যেতে লাগল, “তা তোমরা যতই তর্ক কর, এমন অনেক জিনিস আছে যা ছাগলে খায় না। তাই আমি একটা বক্তৃতা দিতে চাই, তার বিষয় হচ্ছে—ছাগলে কি না খায়।” এই বলে সে হঠাৎ এগিয়ে এসে বক্তৃতা আরম্ভ করল—“হে বালকবৃন্দ এবং স্নেহের হিজি বিজ্ বিজ্, আমার গলায় ঝোলানো সার্টিফিকেট দেখেই তোমরা বুঝতে পারছ যে আমার নাম শ্রীব্যাকরণ শিং বি. এ. খাদ্যবিশারদ। আমি খুব চমৎকার ব্যা করতে পারি, তাই আমার নাম ব্যাকরণ, আর শিং তো দেখতেই পাচ্ছ। ইংরাজিতে লিখবার সময় লিখি B. A. অর্থাৎ ব্যা। কোন কোন জিনিস খাওয়া যায় আর কোনটা কোনটা খাওয়া যায় না, তা আমি সব নিজে পরীক্ষা করে দেখেছি, তাই আমার উপাধি হচ্ছে খাদ্যবিশারদ। তোমরা যে বলো—পাগলে কি না বলে, ছাগলে কি না খায়—এটা অত্যন্ত অন্যায়। এই তো একটু আগে ওই হতভাগাটা বলছিল যে রামছাগল টিকটিকি খায়। এটা এক্কেবারে সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা। আমি অনেকরকম টিকটিকি চেটে দেখেছি, ওতে খাবার মতো কিচ্ছু নেই। অবশ্যি আমরা মাঝে মাঝে এমন অনেক জিনিস খাই, যা তোমরা খাও না, যেমন—খাবারের ঠোঙা, কিম্বা নারকেলের ছোবড়া, কিম্বা খবরের কাগজ, কিম্বা “সন্দেশ”-এর মতো ভালো ভালো মাসিক পত্রিকা। কিন্তু তা বলে মজবুত বাঁধানো কোনো বই আমরা কক্ষনো খাই না। আমরা ক্বচিৎ কখনো লেপ কম্বল কিম্বা তোশক বালিশ এসব একটু-আধটু খাই বটে, কিন্তু যারা বলে আমরা খাটপালং কিম্বা টেবিল চেয়ার খাই, তারা ভয়ানক মিথ্যাবাদী। যখন আমাদের মনে খুব তেজ আসে, তখন শখ করে অনেকরকম জিনিস আমরা চিবিয়ে কিম্বা চেখে দেখি, যেমন, পেনসিল রবার কিম্বা বোতলের ছিপি কিম্বা শুকনো জুতো কিম্বা ক্যামবিসের ব্যাগ। শুনেছি আমার ঠাকুরদাদা একবার ফুর্তির চোটে এক সাহেবের আধখানা তাঁবু প্রায় খেয়ে শেষ করেছিলেন। কিন্তু তা বলে ছুরি কাঁচি কিম্বা শিশি বোতল, এসব আমরা কোনোদিন খাই না। কেউ কেউ সাবান খেতে ভালোবাসে, কিন্তু সেসব নেহাত ছোটোখাটো বাজে সাবান। আমার ছোটোভাই একবার একটা আস্ত বার সোপ খেয়ে ফেলেছিল...।’

হয়তো সেই আমলা ইউএনওর সুকুমার রায় পড়া ছিল। ভেবেছিলেন, সাহারা বেগমের এই ছাগলও কিছু একটা বলতে পারবে।

৫.

‘বাংলা শব্দের উৎস-অভিধান’ বইয়ের সূচিপত্র
ছবি: একটু থামুন

ইউএনওর বিচার, ভ্রাম্যমাণ আদালত ও আমলার বিচার–বুদ্ধির প্রসঙ্গ যখন এলই, তখন একটি ভাষাচর্চা করা যাক। ‘বাংলা শব্দের উৎস-অভিধান’ নামে ফরহাদ খানের একটা বই আছে। সেখানে ‘আমলা’ কথাটার উৎপত্তি নিয়ে তিনি লিখেছেন, আমলা অর্থ হচ্ছে, ‘ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। কর্মচারী। বাংলাদেশের বর্তমান শাসনব্যবস্থায় আমলা বা আমলাতন্ত্র বহুল ব্যবহৃত শব্দ। আমলা বলতে বোঝায় উঁচু মাপের সরকারি কর্মকর্তা। আমলার ইংরেজি প্রতিশব্দ ব্যুরোক্র্যাট। সাধারণ মানুষ অহরহ আমলা শব্দ ব্যবহার করলেও আমলারা নিজেদের ব্যুরোক্র্যাট ভাবতেই সম্ভবত বেশি পছন্দ করেন। এটি নিছক মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার। ইংরেজি ভাষার প্রতি খানিকটা প্রীতি ও পক্ষপাত।’

ফরহাদ খান আরও লিখেছেন, ‘আমলা আরবি ভাষার শব্দ। আরবি আমিল শব্দের বহুবচন হলো আমলা। আরবি আমিল শব্দের মোটামুটি অর্থ—শ্রমিক; কেরানি; সাধারণ কর্মচারী ইত্যাদি। আরবি ভাষার বিচারে আমাদের মন্ত্রণালয়গুলোর কেরানি, পিয়ন, ড্রাইভার প্রমুখ অধস্তন কর্মচারীদেরই আমলা বলার কথা।’

তাহলে তো মুশকিলে পড়া গেল। আমলারা কি ফরহাদ খানের এ ভাষ্য মেনে নেবেন?

৬.

২০১৭ সালের প্রাথমিকের প্রথম শ্রেণির আমার বাংলা বইয়ে বর্ণ পরিচয়ে (পাঠ-৭) ‘আ’ শেখাতে গিয়ে ছাগলের ছবি ব্যবহার করা হয়েছিল
ছবি: সংগৃহীত

আমলাদের আরেকটা ঘটনার কথা বলা যাক। প্রাথমিক পাঠ্যবইয়ের সেই ছাগলের গাছে ওঠার কথা মনে আছে? সেই যে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) কীর্তির কথা। ২০১৭ সালের প্রাথমিকের প্রথম শ্রেণির আমার বাংলা বইয়ে বর্ণ পরিচয়ে (পাঠ-৭) ‘আ’ শেখাতে গিয়ে ছাগলের ছবি ব্যবহার করা হয়েছিল। একটি ছবিতে দেখা যায়, ছাগল আমগাছে উঠছে, যা নিয়ে তীব্র সমালোচনা হয়। কারণ, স্বাভাবিকভাবে ছাগল গাছে উঠতে পারে না। তীব্র সমালোচনার মুখে সেটি পরিমার্জন করে ছাগল গাছের নিচ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে—এমন ছবি দেওয়া হয়েছিল।

৭.

সরকারি ফুলগাছ হইতে সাবধান!
কোলাজ: একটু থামুন

ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের একটি কবিতা দিয়েই শেষ করি। ‘কে’ নামে তাঁর একটি বিখ্যাত কবিতা আছে। তিনি লিখেছেন, ‘বল দেখি এ জগতে বিজ্ঞ বলি কারে,/ হিতাহিত বোধ যার, বিজ্ঞ বলি তারে।/ বল দেখি এ জগতে ধীর বলি কারে,/ বিপদে যে স্থির থাকে, ধীর বলি তারে।/ বল দেখি এ জগতে মূর্খ বলি কারে,/ নিজ কার্য নষ্ট করে, মূর্খ বলি তারে।/ বল দেখি এ জগতে সাধু বলি কারে,/ পরের যে ভাল করে, সাধু বলি তারে।/ বল দেখি এ জগতে জ্ঞানী বলি কারে,/ নিজ বোধ আছে যার জ্ঞানী বলি তারে।’