‘কী একটা রাত গেল—হরিবল!’
ফেলুদার সঙ্গী জটায়ুর কায়দায় ‘হরিবল’ শব্দটি উচ্চারণ করলেন আমাদের ফুফা।
বাবা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী হয়েছিল রাতে? কারেন্ট তো ছিল। মশা ঢুকেছিল নাকি?’
ফুফা খানিকক্ষণ হাঁ করে তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘আপনি কিছু জানেন না, ভাইজান?’
বাবা বললেন, ‘তুমি না বললে জানব কীভাবে? আমি কি জ্যোতিষী?’
ফুফা চায়ে চুমুক দিতে গিয়েও দিলেন না, ‘ভাইজান, গতকাল রাতে ফেসবুক ডাউন ছিল।’
বাবা ভুরু কুঁচকে বললেন, ‘তুমি কি ফেসবুকে ঢেউটিন বেচো?’
ফুফা বললেন, ‘ঢেউটিন বেচতে যাব কেন? কী আশ্চর্য! এই সব আপনি কী বলেন!’
‘তাহলে ফেসবুক ডাউন থাকলে তোমার সমস্যা কী?’
কথা আর বেশি দূর এগোল না। মেসেঞ্জারে ফুফার একটা ফোন এসেছে। তিনি নাশতার টেবিল ছেড়ে উঠে গেলেন।
বাবা শুধু বিড়বিড় করে ‘বেকুবের বেকুব! সে আছে ফেসবুক নিয়ে!’ বলে চায়ে চুমুক দিলেন।
আমাদের এই ফুফার বয়স ৪৫ থেকে ৪৬ হবে। অথচ মাঝেমধ্যে তাঁকে দেখলে মনে হয়, এই তো কুড়িতে পড়লেন! তিনি আজকাল খেতে বসলে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসেন। গোসল করতে গেলেও ফোন নিয়ে যান! মুরব্বি তো বটেই, কনিষ্ঠদের সামনেও তাঁর মাথা থাকে নত! এক, ফেসবুক তাঁর বয়স কমিয়ে দিয়েছে, ফেসবুকেই কাটছে তাঁর দিনের অধিকাংশ সময়। ফলে জীবনযাপনেও এটার প্রভাব পড়ছে। সেদিন যেমন তাঁর মেয়ে, মানে আমাদের ফুফাতো বোন টুনি আপুকে এয়ারপোর্টে সি অফ করতে গিয়ে বলে বসলেন, ‘সি ইউ, নট ফর মাইন্ড।’ আমরা কতক্ষণ হাঁ করে ফুফার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। ফুফা বিষয়টা অগ্রাহ্য করে বললেন, ‘হ্যাভ আ রিলাক্স!’
বুঝতেই পারছেন, ফেসবুক ফুফার ওপর কতটা আছর করেছে! মানুষ আজকাল শিশু-কিশোর-তরুণদের ইন্টারনেটে আসক্তি নিয়ে দুশ্চিন্তা করে। আমাদের মাথাব্যথা ফুফাকে নিয়ে।
মাথাব্যথা অবশ্য মার্ক জাকারবার্গেরও আছে। ৬ ঘণ্টায় বেচারার ৬০০ কোটি ডলার লস হয়ে গেল! তা-ও আবার এমন এক সমস্যা, যেটা আমাদের কাছে পান্তাভাত হয়ে গেছে—রাউটারের গন্ডগোল। এ খবর পড়ার পর একটা খোঁচা মারা ক্যাপশন লিখে খবরের লিংকটা ফেসবুকে শেয়ার করতে যাচ্ছিলাম। দেখি ওয়াই-ফাই নেই! রাউটার চেক করে দেখি লাল বাতি জ্বলছে। একেই বলে কাকতালীয় ব্যাপার! ফোন করলাম ইন্টারনেটওয়ালা বজলু ভাইকে।
‘হ্যালো, বজলু ভাই...!’
বজলু ভাই ফোন করার কারণ ধরে ফেলে বললেন, ‘ছোট ভাই, লাইনের গন্ডগোল হইছে। ১০ মিনিট ওয়েট করো।’
‘ঠিক আছে’ বলে ফোন কাটতে যাচ্ছিলাম, কী মনে করে বললাম, ‘বজলু ভাই, আমার একটা প্রশ্ন ছিল।’
বজলু ভাই বললেন, ‘কী প্রশ্ন?’
‘এই যে গতকাল ফেসবুক ডাউন ছিল। সেটা নাকি আবার রাউটারের সমস্যার কারণে। জাকারবার্গ আপনাকে ফোন করলে কী বলতেন?’
বজলু ভাই রসিকতাটা ধরতে পেরে বললেন, ‘তোমরা মিয়া খালি মশকরা করো! এই যে আমি কি এখন তোমারে রাউটার অফ কইরা অন করতে বলছি? বলো, বলছি?’
‘না না, তা বলেন নাই।’
‘তাইলে?’ বজলু ভাই বললেন, ‘শোনো, কোথায় কী বলতে হবে না হবে, এইটা আমরা বুঝি। সব জায়গায় তো চালাকি চলে না।’
ভেবো না এই ক্ষতি শুধু তোমার; এই ক্ষতি জনগণের ক্ষতি, এই ক্ষতি মা, মাটি, মানুষের! তবু বলব, হাল ছেড়ো না, পাশে আছি সব সময়...’
বজলু ভাইয়ের মতো আমাদের মোটিভেশনাল স্পিকাররা তা বোঝেন কি না, এটা আমি বুঝি না! সব জায়গায় একই ‘খাঁজ কাটা খাঁজ কাটা’ সূত্র প্রয়োগ করতে তাঁদের কেমন লাগে, তাই-বা কে জানে! ফেসবুক ডাউন হওয়ার পর জাকারবার্গ দুঃখ প্রকাশ করে ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দিয়েছেন। সেটার নিচে একজন যেমন লিখেছেন, ‘গতকাল যা ঘটল, যা শুনলাম, তাতে তোমায় অনেক আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়েছে। ভেবো না এই ক্ষতি শুধু তোমার; এই ক্ষতি জনগণের ক্ষতি, এই ক্ষতি মা, মাটি, মানুষের! তবু বলব, হাল ছেড়ো না, পাশে আছি সব সময়...’।
এই কমেন্ট পড়ে মোটিভেশনাল স্পিকারদের চোখেও নিশ্চয়ই পানি এসে গেছে! জাকারবার্গের ওই পোস্টের নিচে আরও অনেক বাংলাভাষীই কমেন্ট করেছেন। তাঁদের মধ্যে একজন যেমন লিখেছেন, ‘এর পর থেকে আগের দিন এলাকায় মাইকিং করে ঘোষণা দিয়ে ফেসবুক বন্ধ রাখবেন। গতকাল দুবার অ্যাপ আনইনস্টল-ইনস্টল করেছি, ফোনটা রিস্টার্ট দিয়েছি কয়েকবার। বাটনটা চেপে ধরে থাকতে থাকতে আঙুল ব্যথা হয়ে গেছে!’
একজন আবার প্রশ্ন করেছেন, ‘তুমি কি ভালো হবে না, মার্কসুদ?’
ওই কমেন্টে একজন রিপ্লাই করেছেন, ‘ভাই, আইডি গায়েব হয়ে যেতে পারে!’
অনেকেই অবশ্য জাকারবার্গকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন, কেউ কেউ আর্থিক ক্ষতির জন্য সমব্যথী হয়েছেন। তবে একজনের পরামর্শ ছিল সবচেয়ে সময়োপযোগী, ‘এত প্যারা নিয়ে কী লাভ! বয়স ঠিক থাকলে বিসিএসটা দাও!’
জীবনের রাউটার অফ-অন করে সবকিছু ঠিক করা গেলে জাকারবার্গ হয়তো পরামর্শটা শুনেও ফেলতেন!