ডায়াবেটিসে আইএপি কেন গুরুত্বপূর্ণ, বুঝিয়ে বললেন ড. মালো

গবেষণার মাধ্যমে ডায়াবেটিসের নতুন এক কারণ আবিষ্কার করেছেন ড. মধু এস মালোর দল। তাঁর কাছ থেকে বিষয়টি বুঝলেন ডা. মো. শরিফুল ইসলাম

প্রশ্ন :

আপনাদের গবেষণা বলছে, ডায়াবেটিসের কারণ আইএপি কমে যাওয়া। এই আইএপি কী?

আইএপি বা ইন্টেস্টিনাইল অ্যালকেলাইন ফসফেটাস একটি এনজাইম। পৃথিবীর সব প্রজাতির মধ্যেই এনজাইমটি বিদ্যমান। এই এনজাইমের অভাবে বা স্বল্পতায় ডায়াবেটিস হয়ে থাকে। ডায়াবেটিস জেনেটিক মিউটেশনের কারণে ১৫ শতাংশ ও আইএপি স্বল্পতা বা অভাবে ৮৫ শতাংশ হয়ে থাকে। তাহলে আমরা সুস্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, বিশাল পরিমাণ অর্থাৎ ৮৫ শতাংশ ডায়াবেটিসকে প্রতিরোধ করা যেতে পারে।

প্রশ্ন :

কীভাবে প্রমাণ করলেন আইএপি এনজাইম ডায়াবেটিসের জন্য দায়ী

সুস্থ মানুষের আইএপি গড় সাধারণত ৬৫ ইউনিটের বেশি। এই এনজাইম যাদের ৬৫ ইউনিটের বেশি, তাদের ক্ষেত্রে দেখা গেছে মাত্র ৩ শতাংশ মানুষের পরবর্তী সময়ে ডায়াবেটিস হয়েছে। আর যাদের ৬৫ ইউনিটের কম, তাদের মধ্যে ৪২ শতাংশ মানুষের ডায়াবেটিস হয়েছে। আরেকভাবেও দেখা যায়। আইএপির মাত্রা অনুযায়ী মানুষকে ৫ ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন: ০-১৫ ইউনিট, ১৫-৩৩ ইউনিট, ৩৩-৫৫ ইউনিট, ৫৫-১১৫ ইউনিট এবং ১১৫ ইউনিটের বেশি। সবচেয়ে বেশি ইউনিট আইএপিএর তুলনায় সবচেয়ে কম ইউনিট আইএপির ক্ষেত্রে ডায়াবেটিস হওয়ার আশঙ্কা ১৪ গুণ।

প্রথম আলো কার্যালয়ে ড. মধু এস মালো
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

প্রশ্ন :

আইএপি কীভাবে ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করে থাকে?

এপি বা অ্যালকেলাইন ফসফেটাস মানবশরীরে কয়েক ধরনের আছে। যার মধ্যে আইএপি খাদ্যনালিতে তৈরি হয়ে সেখানেই কাজ করে। আমাদের খাদ্যনালিতে ১০০ ট্রিলিয়ন ব্যাকটেরিয়া থাকে। বেড়ে বা কমে গেলে শরীরের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করে। ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা বেড়ে গেলে অতিরিক্ত ব্যাকটেরিয়াকে শরীর মেরে ফেলে। সেসব মৃত ব্যাকটেরিয়া এন্ডোটক্সিন হিসেবে শরীরে প্রবেশ করলে শরীরের প্রতিরোধব্যবস্থা প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করে। ফলে শরীরের প্রতিরোধব্যবস্থার সঙ্গে টক্সিনের যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধ দীর্ঘমেয়াদি হলে যুদ্ধক্ষেত্রের যোদ্ধারা ছাড়াও আশপাশের অন্য কোষ বা টিস্যু ক্ষতির মুখে পড়ে। যেমন ইনসুলিন প্রস্তুতকারী কোষ বা ইনসুলিন যার সঙ্গে বন্ধন তৈরি করে তার ক্ষতিসাধন করে। একে দীর্ঘমেয়াদি লঘু প্রদাহ বলা হয়ে থাকে। ফলে ধীরে ধীরে তার ডায়াবেটিস হয়। আইএপি এই কাজ প্রতিরোধ করে। এই এনজাইম খাদ্যনালিতে ব্যাকটেরিয়াল টক্সিনের সঙ্গে বন্ধন তৈরি করে টক্সিনকে নষ্ট বা অকার্যকর করে ফেলে। ফলে দীর্ঘমেয়াদি কোনো প্রদাহ তৈরি হয় না, যাঁর আইএপি পর্যাপ্ত বা বেশি থাকে তাঁদের ডায়াবেটিস হতে পারে না।

প্রশ্ন :

ব্যাকটেরিয়াল টক্সিন কীভাবে শরীরে ঢোকে?

ব্যাকটেরিয়াল টক্সিন সাধারণত ফ্যাটি অ্যাসিডের সঙ্গে বন্ধন তৈরি করে রক্তে প্রবেশ করে। যাঁরা ফ্যাট বেশি খান, তাঁদের ক্ষেত্রে এই টক্সিন শরীরে বেশি প্রবেশের আশঙ্কা থাকে। অ্যালকোহল খাদ্যনালির ছিদ্রকে বড় করে দেয়, ফলে টক্সিন সহজেই রক্তে প্রবেশ করতে পারে। কোমল পানীয়ে প্রচুর ফ্রুক্টোজ থাকে, যা অ্যালকোহলের মতোই কাজ করে। ফলে রক্তে সহজেই টক্সিন প্রবেশ করতে পারে। যাদের আইএপি কম থাকে, তাদের অবশ্যই এসব খাবার এড়িয়ে যাওয়া উচিত। তাহলে ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করা সম্ভব।

প্রশ্ন :

কীভাবে আইএপি বাড়ানো যায়?

এটি এখনো গবেষণার বিষয়। প্রাকৃতিকভাবে কীভাবে বাড়ানো যায় বা কী কী খাবার থেকে এই এনজাইম পাওয়া যায়, তা নিয়ে গবেষণার ব্যাপক সুযোগ আছে। হলুদ ও ক্যাপসিকাম এই এনজাইম বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। খাদ্যনালিতে কিছু ব্যাকটেরিয়া আছে যারা আইএপিকে কার্যকর করে তোলে। বলা যায় সেই ব্যাকটেরিয়াগুলো খাদ্যনালির কোষের ওপর কাজ করে আইএপির কার্যকারিতা নির্ধারণ করে।

প্রশ্ন :

আইএপি কমে যায় কেন?

আইএপি কমে যাওয়ার ঠিক কারণ এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে যেসব ব্যাকটেরিয়া আইএপির কার্যকারিতা বাড়িয়ে তোলে তারা কোনো কারণে কমে গেলে বা ব্যাকটেরিয়ার অসামঞ্জস্য তৈরি হলে এমনটি হতে পারে। অনিয়ন্ত্রিত অ্যান্টিবায়োটিক খেলে, বিভিন্ন ডাই বা রং খেলে বা রেডিয়েশন নিলে এসব ব্যাকটেরিয়ার অসামঞ্জস্যতা তৈরি হয়।

প্রশ্ন :

ডায়াবেটিসে আক্রান্তদের আইএপি কীভাবে বাড়ানো যায়?

যাঁদের ইতিমধ্যে ডায়াবেটিস হয়ে গেছে, তাঁদের গড় আইএপি সাধারণত ২৫ ইউনিটের মতো, যেখানে সুস্থ–স্বাভাবিক মানুষের ৬৫ ইউনিটের বেশি। গবেষণায় দেখা গেছে, যাঁদের আইএপি একবার কমে গেছে, তাঁদের এই এনজাইম বাড়ানো খুবই কঠিন বা অসম্ভব প্রায়।

প্রশ্ন :

স্থূলতা বা ওবেসিটির সঙ্গে ডায়াবেটিসের সম্পর্ক তাহলে কী দাঁড়াবে?

আমাদের গবেষণায় সুস্পষ্ট দেখা গেছে, স্থূলতার সঙ্গে ডায়াবেটিসের সম্পর্ক নেই। এটিকে এখন বলা যায় ভুল ধারণামাত্র। কারণ, আমাদের গবেষণায় দেখা গেছে, যাঁদের স্থূলতা আছে কিন্তু আইএপি ভালো, তাঁদের ডায়াবেটিস হওয়ার আশঙ্কা নেই বললেই চলে।