চমৎকার একটা গ্লোব কিনেছি। এককথায় অসাধারণ। প্রথমত, আমার টেবিলে তা দারুণ মানিয়ে গেছে; দ্বিতীয়ত, ওটাকে টেবিল ল্যাম্প হিসেবেও ব্যবহার করা যায়। এবং সবচেয়ে বড় কথা, কোনো শিশুকে, বর্তমান ক্ষেত্রে আমাদের মেয়েকে, ভূগোলের প্রতি আকৃষ্ট করতে গ্লোবের চেয়ে শ্রেয় আর কিছু নেই এই ধরাধামে।
সেদিনই আমি পিতা-শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করতে নেমে পড়লাম।
‘তুমি কি জানো, মা, এটা কী?’ গ্লোব দেখিয়ে প্রশ্ন করলাম মেয়েকে।
‘গ্লোব।’ বলল ডোরা।
‘ঠিক বলেছ। তবে গ্লোবটা কেন একটু কাত করে রাখা, তা কি তুমি জানো?’ উত্তরে অপেক্ষা না করে বললাম, ‘কারণ, পৃথিবী ঠিক এই কোণে অবস্থান করে সূযের্র চারপাশ প্রদক্ষিণ করে। তুমি সম্ভবত শুনেছ যে পৃথিবী সূর্যের চারপাশে ঘুরছে, তাই না?’
কোনো উত্তর না দিয়ে জিজ্ঞাসাসূচক দৃষ্টিতে ডোরা তাকিয়ে রইল আমার দিকে।
‘শোনোনি?’
একটু ভেবে নিয়ে ডোরা বলল, ‘তুমি আমাকে মিথ্যে বলছ না তো?’
ডোরা সবেগে মাথা দোলাল দুপাশে, ‘মা বলেছে, তুমি যখন মিথ্যে বলো, তোমার বন্ধুরা তোমার হয়ে ওকালতি করে।’
‘হায় ঈশ্বর! তোমাকে আমি মিথ্যে বলতে যাব কেন?’
‘মা তো বলে, তুমি নাকি সব সময় মিথ্যে বলো। গতকাল যেমন দুপুরের খাবারের আগেই বাসায় আসবে বলে এসেছ রাত দশটায়।’
‘আমার তো কাজ ছিল!’ বিরক্তির সুরে বললাম আমি, ‘মিথ্যেটা ইচ্ছাকৃত ছিল না। তবে পৃথিবীর ব্যাপারে যা বললাম, তা কিন্তু সত্যি। পৃথিবী ঘুরছে সূর্যের চারপাশে। শত শত বছর ধরে মানুষেরা জানতই না যে পৃথিবী ঘোরে। কী করে তারা অনুমান করল, জানো?’
ডোরা সবেগে মাথা দোলাল দুপাশে, ‘মা বলেছে, তুমি যখন মিথ্যে বলো, তোমার বন্ধুরা তোমার হয়ে ওকালতি করে।’
‘যখন আমি তোমাকে মহান বিজ্ঞানী গ্যালিলিওর গল্প করতে চাইছি, তখন আমার বন্ধুদের কথা আসছে কেন?’
‘মা বলে...।’
‘এক্ষুনি রান্নাঘরে গিয়ে মাকে জিজ্ঞেস করো, পৃথিবী সূর্যের চারপাশে ঘুরছে কি না এবং গ্যালিলিও আমার বন্ধু কি না।’
সে সময় স্ত্রী উদয় হলো দরজার পাশে।
‘মেয়ের ওপরে হম্বিতম্বি করছ কেন?’
‘করবই তো! যা-ই বলি না কেন, তাতেই সে সন্দেহ পোষণ করে।’
‘অবাক হওয়ার কী আছে? তুমি ভেবেছ, তোমার আচরণ সে দেখে না, লক্ষ করে না?’
‘কেমন আমার আচরণ?’ ক্রোধোন্মত্ত হয়ে চিৎকার করে উঠলাম।
‘যা-তা সব ফালতু কথা ঢোকাচ্ছ ওর মাথায় আর ভাবছ, ওর শিক্ষা ও লালনপালন এখানেই শেষ!’
‘কী বিষয়ে কথা হচ্ছিল, তুমি কি জানো?’
‘জানি বা না জানি, সেটা কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার নয়। আসল কথা হলো, মেয়েকে মিথ্যে বলবে না, যেমনটা আমাকে বলে এসেছ বহু বছর ধরে।’
‘তার মানে,’ গর্জন করে উঠলাম আমি, ‘গ্যালিলিও মিথ্যে বলেছে? তুমি তা-ই বলতে চাও? উত্তর দাও আমার কথার!’
‘সব কথার পেছনেই তুমি অজুহাত দাঁড় করাতে পারো,’ কথাটা বলেই স্ত্রী হাঁটা ধরল রান্নাঘরের দিকে। যাওয়ার সময় গ্লোবের দিকে নজর গেল তার, সে দাঁড়িয়ে পড়ল, ‘তোমার ধারণা, আমাদের সবচেয়ে বেশি দরকার এই জিনিসটা? অন্য কোনো কিছু কেনার প্রয়োজন আমাদের নেই?’
‘বুঝতে পারছি,’ ক্লান্তস্বরে ডোরার দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। গ্যালিলিওর মতো আমাকেও আমার মতামত ফিরিয়ে নিতে হবে। লক্ষ্মী মেয়ে আমার, মন দিয়ে শোনো আমার কথা। জেনে রাখো, পৃথিবী সূর্যের চারপাশে প্রদক্ষিণ করে না, নিজে ঘোরে না এবং দেখতে তা গোলও নয় আদৌ।’
গ্যালিলিও, বন্ধু আমার, তুমি আমার অবস্থাটা বুঝতে পারছ?
অনুবাদ: মাসুদ মাহমুদ