প্রাচীন পাণ্ডুলিপির রহস্য উন্মোচনে মারুফ ঢালী

এপ্রিলের শেষ দিকে বিজ্ঞানের একটি চমৎকার আবিষ্কার বিশ্বের বিজ্ঞানী, কৌতূহলী মানুষ এবং সংবাদমাধ্যমে ব্যাপক সাড়া ফেলে। আবিষ্কারটি ‘ডেড সি স্ক্রল’ নামে পরিচিত দুই হাজার বছরের বেশি পুরোনো ধর্মীয় পাণ্ডুলিপির পাঠোদ্ধার। প্রাচীন পাণ্ডুলিপির ওপর গবেষণার কাজটি করেছেন নেদারল্যান্ডসের একদল গবেষক। যাঁদের মধ্যে আছেন বাংলাদেশি প্রকৌশলী এবং গবেষক মারুফ আহমেদ ঢালী।

ডেড সি বা মৃত সাগরে পানিতে লবণের অত্যধিক মাত্রার কারণে মাছ বা অন্য কোনো জলজ প্রাণী জন্মাতে পারে না। ইহুদি, খ্রিষ্ট ও ইসলাম—তিন ধর্মের সঙ্গেই নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে মৃত সাগরের ইতিহাস। ডেড সির তীরে পশ্চিম তীরের শহর কুমরানের মরুভূমিতে ১৯৪৭ সালে প্রথম আবিষ্কৃত হয় ডেড সি স্ক্রল। ডেড সি স্ক্রলগুলোকে পৃথিবীর সবচেয়ে আলোচিত প্রত্নতাত্ত্বিক নথি হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

প্রাচীন পাণ্ডুলিপির একটি এই আইজায়াহ স্ক্রল

পাণ্ডুলিপির পরিচয়

ডেড সি স্ক্রল খুঁজে পাওয়ার সঙ্গে প্রচলিত গল্পটি অনেকটা এমন—এক বেদুইন তরুণ তার হারানো মেষ খুঁজতে রুক্ষ পাহাড়ি এলাকায় ঢিল ছুড়তে ছুড়তে এগোচ্ছিলেন। হঠাৎ একটি গুহার মধ্যে তার ছোড়া ঢিলের আঘাতে কিছু একটা ভেঙে যাওয়ার শব্দ শুনতে পান। কৌতূহলী তরুণ গুহার ভেতরে প্রবেশ করে দেখতে পান আটটি মাটির বয়াম। দুটি বয়ামের ভেতরে কাপড় দিয়ে প্যাঁচানো অবস্থায় খুঁজে পান দুটি স্ক্রল (আড়াআড়ি বা লম্বালম্বি প্যাঁচানো নথি)। পরবর্তী সময় বেদুইনদের সঙ্গে নিয়ে প্রত্নতত্ত্ববিদেরা অন্যান্য গুহায় অনুসন্ধান চালাতে থাকেন। গুহার ভেতর থেকে একে একে বেরিয়ে আসতে থাকে প্রত্নতাত্ত্বিক পাণ্ডুলিপি।

এই পাণ্ডুলিপিগুলো লেখা হয়েছে খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০ থেকে ১০০ অব্দের মধ্যে। এসব লেখায় আছে সে সময়ের মানুষের ধর্মবিশ্বাস, সংস্কৃতি, সামাজিক রীতিনীতি, যুদ্ধ ও অর্থনীতির ইতিহাস। এ ছাড়া সময়ের স্রোতে বিবর্তনের ধারায় সেই অঞ্চলের ভাষা এখন কী রূপ ধারণ করেছে, এ ধরনের তুলনামূলক পর্যালোচনার জন্য গবেষকেরা এ ধরনের ঐতিহাসিক পাণ্ডুলিপির ওপর নির্ভর করে থাকেন। ইহুদি ও খ্রিষ্টধর্মের শুরুর দিকের অনেক ধর্মগ্রন্থের বিভিন্ন অংশও আছে এসব পাণ্ডুলিপিতে, ফলে আবিষ্কারের পর থেকেই লাখো মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু এসব প্রাচীন পাণ্ডুলিপি।

পুরোনো পাণ্ডুলিপিগুলোর অবস্থা নাজুক। কীভাবে সংরক্ষণ করা হবে এসব মূল্যবান পাণ্ডুলিপি? এ প্রশ্নের উত্তরও গবেষকেরা খুঁজেছেন সেসব গুহায়। তাঁরা এসব গুহার জলবায়ু-তাপমাত্রা, আর্দ্রতা এবং আলো পরীক্ষা করে দেখেছেন এবং সে আদলে কিছু অন্ধকার জায়গা তৈরি করেছেন। বর্তমানে এসব পাণ্ডুলিপি জেরুজালেম শহরে ‘ইসরায়েল অ্যান্টিকুয়েটি অথরিটি’র প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে সংরক্ষিত আছে।

ডেড সি স্ক্রল গবেষক দলের সদস্যদের সঙ্গে মারুফ ঢালী (সর্বডানে দাঁড়ানো)
সংগৃহীত

ইতিহাসের পাঠোদ্ধার

প্রাচীন পাণ্ডুলিপিগুলো পাঠোদ্ধারের সংবাদটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশিত হওয়ার পরই বিস্তারিত জানতেই মারুফ আহমেদ ঢালীর সঙ্গে যোগাযোগ। কুমিল্লা ক্যাডেট কলেজের প্রাক্তন ছাত্র মারুফ ঢালী গাজীপুরের ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) তড়িৎ ও ইলেকট্রনিকস প্রকৌশবিভাগের স্নাতক। ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে যুক্তরাজ্যে পড়াশোনা করেছেন কম্পিউটার ভিশন ও রোবটিকসের ওপর। যুক্তরাজ্যে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করে ২০১৬ সালে নেদারল্যান্ডসের খ্রনিংগেন বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি গবেষক হিসেবে কাজ শুরু করেন। বিশ্ববিদ্যালয়টির কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) অধ্যাপক ল্যামবার্ট স্কোমেকার এবং ধর্মতত্ত্বের অধ্যাপক ম্লাদেন পপোভিচের সঙ্গে তাঁর গবেষণার বিষয় ডেড সি স্ক্রলের রহস্য উন্মোচন।

মারুফ বলেন, ‘গবেষণা শুরুর কিছুদিনের মধ্যেই বুঝতে পারি, এই প্রাচীন পাণ্ডুলিপিগুলো নিয়ে কাজ করার দুটি মৌলিক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। প্রথমত, পাণ্ডুলিপি থেকে লেখাগুলোকে তুলে আনা। ডেড সি স্ক্রলের পাণ্ডুলিপিগুলো দুই হাজার বছরের বেশি পুরোনো। প্যাপিরাস, চামড়া এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ধাতব পাতের ওপর লেখা এসব স্ক্রলের হরফ অনেক ক্ষেত্রে প্রায় পড়াই যায় না। দ্বিতীয়ত, কতজন এগুলো লিখেছেন, সেটাও নিশ্চিত হওয়া যায় না। স্ক্রল লেখকেরা কেউই লিখিত পাণ্ডুলিপিগুলোর শেষে তাঁদের নাম লেখেননি। ফলে কয়জন লেখক এসব লিখেছেন, এটা জানার একমাত্র উপায় তাঁদের হাতের লেখা পর্যালোচনা করা।’

কাজের শুরু

প্রাথমিক কিছু গবেষণা শেষে মারুফ ঢালীর দল প্রায় ২৪ ফুট লম্বা ও ৫৪ কলামে বিস্তৃত বিখ্যাত আইজায়াহ স্ক্রলটির ওপর মনোনিবেশ করেন। স্ক্রলটি দেখে ধারণা করা হচ্ছিল, পুরো স্ক্রল একজন লেখকের হাতে লেখা। চোখের দেখার ওপর ভিত্তি করে এত বড় একটি পাণ্ডুলিপির এত কলাম আসলেই একজন মানুষের হাতে লেখা হয়েছিল কি না, এ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া প্রায় অসম্ভব। তখন মারুফ ঢালীরা সাহায্য নিলেন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার।

মারুফ বলেন, এখানেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রত্যেক মানুষের হাতের লেখায় নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্যের ছাপ থাকে, যা অন্য কারও পক্ষে নকল করা সম্ভব নয়। ব্যাপারটি অনেকটা আঙুলের ছাপের মতো। দুজন মানুষের আঙুলের ছাপ দেখতে একই রকম হলেও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে আমরা বুঝতে পারি যে এটা আসলে পৃথক দুজন মানুষের আঙুলের ছাপ। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং অত্যাধুনিক প্যাটার্ন রিকগনিশন লেখকদের কলম ধরা, লেখার গতি-প্রকৃতির ভিত্তিতে ব্যক্তিবিশেষের হাতের লেখা শনাক্তকরণের কাজে আমাদের সাহায্য করতে পারে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে যদি একে একে সব ডেড সি স্ক্রল এভাবে পর্যালোচনা করা যায়, তাহলে সব লেখকের একটা সঠিক প্রোফাইল তৈরি করা সম্ভব হবে, যা মানুষের ব্যক্তিগত মতামতনির্ভর নয়।

বর্ণমালা শনাক্ত করা

ডেড সি স্ক্রল থেকে বর্ণমালা শনাক্ত করার কাজটি ছিল দুরূহ। আগেও অনেকে এ কাজ সফলভাবে করতে ব্যর্থ হন। মারুফদেরও এ কাজে অনেক বেগ পেতে হয়। দুই বছরের বেশি সময় ধরে চেষ্টার পরে মারুফের তৈরি করা আর্টিফিশিয়াল নিউরাল নেটওয়ার্ক স্ক্রলের অস্পষ্ট ছবি থেকে লেখাগুলো উদ্ধার করতে সক্ষম হয়। এরপর স্ক্রলের লেখা বিশ্লেষণ করে মারুফ দেখতে পান, পুরো স্ক্রলের লেখা দেখতে হুবহু একই রকম হলেও কম্পিউটার অ্যালগরিদম এদের দুটি আলাদা ক্লাস্টার বা গুচ্ছে ভাগ করেছে। এ থেকে তিনি সিদ্ধান্তে আসেন, স্ক্রলটি একজন নয়, বরং দুজন লেখক লিখেছেন। মারুফের দলের অন্য সদস্যরাও আলাদাভাবে কাজটি পর্যালোচনা করে একই সিদ্ধান্তে আসেন।

গবেষকদের সম্মিলিত প্রয়াস

মারুফ ঢালীর কথায় পরিষ্কার হলো, তাঁদের এ কাজের কয়েকটি যুগান্তকারী দিক আছে। কোনো ধর্মতত্ত্বের পণ্ডিত বা এআই গবেষক আলাদাভাবে কাজটি করলে অন্য পক্ষের মানুষজনের কাছে এটি খুব বেশি গ্রহণযোগ্যতা লাভ করত না। বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনের জন্য এ কাজে দরকার ছিল ধর্মতত্ত্ব ও বিজ্ঞান—দুই বিষয়ের গবেষকদের সম্মিলিত প্রয়াস, যা এখানে ছিল। এতে কাজটি ধর্ম ও বিজ্ঞান দুই সম্প্রদায়ের মানুষদের কাছেই প্রশংসিত হয়েছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে হলে দরকার বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের সমন্বিত প্রয়াস, এ কাজ এর আদর্শ প্রমাণ। ভবিষ্যতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানুষের প্রতিস্থাপন করবে না, বরং বিভিন্ন কাজে সহযোগী হবে, যদি মানুষ জানে কী করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে প্রশ্ন করতে হয়, দিকনির্দেশনা দিতে হয় এবং কখন সন্দেহ করতে হয়। এ গবেষণার মাধ্যমে অস্পষ্ট সব ঐতিহাসিক পাণ্ডুলিপি থেকে লেখা উদ্ধার করার একটি ব্লু প্রিন্ট তৈরি হয়েছে এবং ইতিহাস পুনঃপাঠের সুযোগ তৈরি হয়েছে।

আশা করা হচ্ছে, মারুফ ঢালীদের এ আবিষ্কারের ফলে ইহুদি, খ্রিষ্টান এবং ইসলামের ইতিহাস গবেষণার ক্ষেত্রে মৌলিক অগ্রগতি হবে। চ্যালেঞ্জিং এবং সময়সাপেক্ষ এ কাজে গবেষকদের সফলতা বিশ্বের অনেক তরুণ গবেষককে অনুপ্রাণিত করবে। নতুন এ পথের সূচনা করার জন্য বাংলাদেশি গবেষক মারুফ ঢালীকে অভিনন্দন!

লেখক: তড়িৎ প্রকৌশলী, আইন্ডহোভেন, নেদারল্যান্ডস