বাংলাদেশের কোটিপতি ব্যবসায়ী যখন আর্জেন্টিনা ফুটবল দলের কোচ

কোলাজ: একটু থামুন

এক সুন্দর সকালে ঘুম থেকে উঠে ঢাকার মনোয়ার তালুকদার আবিষ্কার করলেন, তিনি আর্জেন্টিনা ফুটবল দলের হেড কোচ হয়ে গেছেন। তালুকদার সাহেব ভেবেছিলেন এটা স্বপ্ন। তিনি তালুকদার গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রির এমডি, বাংলাদেশের একজন কোটিপতি ব্যবসায়ী। তার কথায় অনেকে অনেক কিছু হয়ে যায়, কিন্তু তিনি আর্জেন্টিনার মতো একটা বড় দলের কোচ হয়ে গেলেন কী করে? এটা কি সম্ভব?

বিছানা থেকে উঠে তালুকদার সাহেব দেখেন, তার পরনে ট্র্যাকস্যুট। নামীদামি ব্র্যান্ডের নানান রকম পোশাক তিনি পরেন, তাই বলে ট্র্যাকস্যুট! এসব কী হচ্ছে? ধপ করে বিছানায় বসে চিন্তা করতে লাগলেন তালুকদার সাহেব। গত রাতে তিনি ছিলেন ঢাকার একটা ক্লাবে। খাওয়াদাওয়ার পর সামান্য মদ্যপানের ব্যবস্থা ছিল। এরপর তার আর কিছু মনে নাই। আবছাভাবে মনে পড়ছে, জায়ান্ট স্ক্রিনে আর্জেন্টিনার খেলা চলছিল। ছোটবেলা থেকেই তালুকদার সাহেব ম্যারাডোনার দলের সমর্থক। কিন্তু এখন সে দলের একি অবস্থা! এত দূরে বসেও তিনি ঠিকই বুঝতে পারছিলেন, দলটায় ভালো ম্যানেজারের বড় অভাব। উত্তেজিত হয়ে হাত নেড়ে তালুকদার সাহেব বলেছিলেন, ‘কী খেলে এরা? কোচটা কে? খেলার কিছু বোঝে ও ব্যাটা? আমি কোচ হইলে আর্জেন্টিনা এর চেয়ে অনেক ভালো খেলত। সবগুলারে সোজা করে ফেলতাম। শালা, ক্লাবে তো ঠিক ভালো খেলে একেকটা। জাতীয় দলে আসলে তোদের গায়ে চর্বি হয়ে যায়, তাই না? আমি হইলে এমন টাইট দিতাম...।’

কোলাজ: একটু থামুন

তারপর আর কিছু মনে নাই তালুকদার সাহেবের। সকালে উঠে দেখেন এই অবস্থা। সত্যি সত্যি তিনি আর্জেন্টিনার কোচ হয়ে গেছেন। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে পরিচিত কোনো দৃশ্যই চোখে পড়ল না তার। ঝকঝকে রাস্তা। উঁচু অট্টালিকার সারি, ফাঁকা রাস্তা দিয়ে প্রায় নিঃশব্দে ছুটে যাচ্ছে চকচকে সব গাড়ি।

‘আমি কোথায়?’ ভাবলেন তিনি, ‘আর্জেন্টিনায় নাকি? কী অবিশ্বাস্য ব্যাপার! আমি এখানে এলাম কী করে!’

ভয়ে ভয়ে দরজা খুলে রুম থেকে বেরোলেন তালুকদার সাহেব। তাকে দেখেই তটস্থ হয়ে ‘গুড মর্নিং কোচ’, ‘হাই কোচ’ বলে সম্মান দিতে শুরু করল খেলোয়াড়েরা। ব্যাপারটা তার ভালো লাগল। ছেলেগুলো আদবকায়দা জানে তাহলে। যদিও কোনো জবাব দিলেন না তালুকদার সাহেব। তিনি এমডি, মানে কোচ। দলের প্রধান। অধস্তনদের সম্ভাষণের জবাব দিলে এরা মাথায় উঠে বসতে পারে।

কোত্থেকে এক স্বর্ণকেশী তরুণী এসে স্প্যানিশ ভাষায় বলল, ‘স্যার, ৫ মিনিট পর টিম মিটিং।’

‘কয় কী!’ চমকে উঠলেন তালুকদার সাহেব। তিনি বাংলাতেই বলছেন, কিন্তু মুখ দিয়ে বের হচ্ছে স্প্যানিশ! কী তাজ্জব ব্যাপার! একটু কেশে ধাতস্থ হয়ে নিলেন তালুকদার সাহেব। তিনি বুঝে গেছেন, রহস্যের সমাধান হওয়ার আগপর্যন্ত আর্জেন্টিনার কোচ হয়েই থাকতে হবে তাকে। গলায় গম্ভীর স্বর আনার চেষ্টা করে তিনি বললেন, ‘মিটিং? কিসের মিটিং? টিম মিটিং হবে, অথচ কোচ হয়ে আমিই সেটা জানি না? কী হচ্ছে এসব?’

ছবি: পেক্সেলস

‘স্যার, আপনিই তো গতকাল মিটিং কল করলেন।’ জবাব দিল তরুণী।

তালুকদার সাহেব অদ্ভুত দৃষ্টিতে তরুণীর দিকে তাকিয়ে রইলেন। হাতে ধরা ক্লিপবোর্ডটা বুকের ওপর তুলে ধরল তরুণী।

লিফটে ঢুকে ভেতরের সবাইকে বাইরে বের করে দিলেন তালুকদার সাহেব। কোচ লিফটে উঠেছে, এমনিতেই তো সবার বের হয়ে যাওয়ার কথা। এরা দেখি কিছুই জানে না! লিফট থেকে বেরিয়ে টিম মিটিংয়ে ঢুকেই তালুকদার সাহেব দেখলেন, তার ঠিক সামনেই বসে আছেন মেসি। বিগলিত হয়ে ছুটে গিয়ে মেসিকে জড়িয়ে ধরলেন তিনি, বারবার হাত মেলাতে লাগলেন হেসে। কোচের এই আচরণে একটু অবাকই হলেন মেসি। লোকটার সমস্যা কী? গতকাল এত রাগারাগি করল, আবার আজকে সকালেই দরদ উথলে পড়ছে! আমাদের কোচগুলো এমন হয় কেন?

‘কোচ, কাজের কথায় আসি, কি বলেন?’ বললেন মেসি।

‘ও হ্যাঁ হ্যাঁ। ঠিক। একদম ঠিক বলেছ তুমি।’ দ্রুত নিজেকে সামলে নিলেন তালুকদার সাহেব। বোর্ডের দিকে যেতে যেতে মনে মনে বললেন, ‘তালুকদার, ভুলে যাইয়ো না, তুমি এখন আর্জেন্টিনার কোচ! তালুকদার গ্রুপের এমডি না।’

হোয়াইট বোর্ডের একটু কাছে এসে পাই করে খেলোয়াড়দের দিকে ঘুরলেন তালুকদার সাহেব। একে একে সবার মুখের দিকে তাকাল তার কৌতূহলী চোখ। সবাই তার দিকেই তাকিয়ে আছে, কেবল গোলকিপার আরমানির মনোযোগ অন্যদিকে।

কোলাজ: একটু থামুন

‘এই ছেলের মনোযোগ সব সময় কম, আমি আগেও খেয়াল করেছি। এ জন্যই সহজ বলগুলো ধরতে পারে না। একে টাইট দিতে হবে।’ ভাবলেন তালুকদার সাহেব। তাকে এখন একটা বক্তৃতা দিতে হবে। কিন্তু বক্তৃতার বিষয় সম্পর্কে কিছুই জানেন না তিনি। ঠিক করলেন, অফিসের মিটিংয়ে যা বলেন, তা–ই বলে দেবেন এখানে। সব মিটিং আসলে একই। দ্রুত কেশে গলা পরিষ্কার করে তিনি কথা শুরু করলেন। ‘তো শুরু করা যাক। সবাই আছে দেখছি। মেসি, আগুয়েরো, ডি মারিয়া...। সবাইকে শুভেচ্ছা। আশা করি ভালো ঘুম হয়েছে তোমাদের। কী, হয়েছে না?’

‘হয়েছে কোচ।’ সমস্বরে বলল খেলোয়াড়েরা।

‘কিন্তু আমার ঘুম হয়নি। তোমাদের পারফরম্যান্সে আমি হতাশ। কিচ্ছু হচ্ছে না। কোনো সমন্বয় নাই, ছন্দ নাই—এসব কী? এভাবে একটা দল চলতে পারে না। কারও মধ্যে ভালো কিছু করার চেষ্টা নাই। নতুন কিছু করার চেষ্টা নাই। নাই নতুন কোনো আইডিয়া। এভাবে চলতে থাকলে তোমাদের সবাইকে বাদ দিয়ে নতুন লোক রিক্রুট করতে হবে আমাকে। তাই আমি কঠিন পদক্ষেপ নিচ্ছি। এখন থেকে তোমরা কে কতক্ষণ প্র্যাকটিস করছ, কতক্ষণ জিম করছ, স্কিল নিয়ে কাজ করছ—সব রিপোর্ট লিখিতভাবে আমাকে ই–মেইল করবে। আর এক মাসের মধ্যে কীভাবে দলের পারফরম্যান্স ভালো করা যায়, সে জন্য তোমাদের কার কী ভূমিকা, তা নিয়ে প্রত্যেকে একটা প্রেজেন্টেশন দেবে। মেসি, তুমিও দেবে।’

তুমি মুখে মুখে তর্ক করছ কেন? নিজেকে কী ভাব তুমি? দু–তিনটা ব্যালন ডি’অর জিতে একেবারে মাথা কিনে নিয়েছ? ওসব অ্যাওয়ার্ড আমি গুনি না।

খেলোয়াড়েরা পরস্পরের মুখের দিকে তাকাতে শুরু করল। কোচ এসব কী বলছেন? কিছুই মাথায় ঢুকছে না। মেসি অধিনায়ক, দলের সবার পক্ষ থেকে মুখ খুললেন তিনি।

‘কোচ, আপনার কথা ঠিক বুঝলাম না। ই–মেইল, প্রেজেন্টেশন...এসব কী বলছেন? আপনি যে স্ট্র্যাটেজি দিচ্ছেন, সে অনুযায়ীই তো আমরা খেলছি। প্র্যাকটিস করছি।’

‘আরে! এটা তুমি কী বললা, মেসি!’ বিস্মিত হলেন তালুকদার সাহেব, ‘তোমার কাছ থেকে এমন ঔদ্ধত্য আশা করি নাই। আমি তো স্ট্র্যাটেজি দেবই, কিন্তু তোমরা নিজেরা কিছু ভাববা না? করবা না? সব কি আমাকে বলে দিতে হবে? এত দিন ধরে তোমরা খেলো, তোমাদের তো বোঝা উচিত, কখন কী করতে হবে।’

‘গত ম্যাচে আপনি পরিকল্পনা করলেন রাইট উইং দিয়ে অ্যাটাক হবে। কিন্তু ওই পাশটা ওরা কড়া গার্ড দিয়েছিল, তখন আমরা লেফট সাইড দিয়ে অ্যাটাক করলাম। পরে আপনিই আবার বললেন, এটা কার সিদ্ধান্তে করলা? আমাকে জানিয়েছ? আবার এখন বলছেন নিজেরা করতে।’

ছবি: এএফপি

‘তুমি মুখে মুখে তর্ক করছ কেন? নিজেকে কী ভাব তুমি? দু–তিনটা ব্যালন ডি’অর জিতে একেবারে মাথা কিনে নিয়েছ? ওসব অ্যাওয়ার্ড আমি গুনি না। দলের জন্য কী করেছ, সেটাই আসল। ক্লাবে তো এক সিজনে ৩০টা গোল দাও। এখানে?’

‘কোচ, মেসি একা কী করবে?’ পাশ থেকে বললেন আগুয়েরো।

‘একা কী করবে মানে? আমি একা এত কিছু দেখি, ও পারবে না কেন? শোনো মেসি, কোম্পানির স্বার্থে শুধু অ্যাটাক করলেই হবে না। প্রয়োজনে ডিফেন্সও করতে হবে।’

‘কোম্পানি?’ মেসির কণ্ঠে বিস্ময়!

‘মানে ওই আরকি...দল। প্রতিটি দল একেকটা কোম্পানির মতো। আর শোনো, আরেকটা কথা। বিশ্বে আমাদের ফ্যান–ফলোয়ার কমে যাচ্ছে। এগুলোর খবর রাখো? তোমাদের ব্যক্তিগত ফলোয়ার তো অনেক। অথচ দলের ফলোয়ার বাড়াতে তোমাদের কোনো ভূমিকা নাই। এখন থেকে প্রতিদিন সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবি পোস্ট করবা। ভিডিও করবা। ফ্যানদের সঙ্গে ইন্টার‌্যাক্ট করবা। দলের জার্সির সেল কেমন, সেল বাড়াতে কী কী করা যায়, এসব প্ল্যান তো তোমাদেরই করতে হবে।’

আজও বুয়েনস এইরেসের রাস্তায় ছেঁড়া ট্র্যাকস্যুট পরা একটা লোককে প্রলাপ বকতে দেখা যায়। বাংলা, ইংরেজি ও স্প্যানিশে একটু পরপর লোকটা বলে, ‘আমি আর্জেন্টিনার কোচ না, আমি তালুকদার গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রির এমডি।’ কেউ তার কথায় পাত্তা দেয় না।

‘আশ্চর্য! এগুলো আমরা কেন করব? আমাদের আর কাজ নাই? এগুলোর জন্য সোশ্যাল মিডিয়া আর মার্কেটিং টিম আছে।’

‘খরচ বাঁচাতে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এসব টিম আর রাখব না। তোমরা তো সারা দিন সোশ্যাল মিডিয়ায় পড়ে থাকো। দলের সবাই মিলেমিশে তোমরাই সোশ্যাল মিডিয়া চালাবে। এটা এমন কী কঠিন কাজ? মনে রাখবে, দলে থাকতে হলে আমি যা বলব, তা করতে হবে। এটাই সায়েন্স। মিটিং শেষ।’

তালুকদার সাহেব হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন। যাক, খারাপ হয়নি একেবারে। এত বড় কোম্পানি যখন চালাতে পারেন, এ রকম দুয়েকটা টিম চালানো তার কাছে কোনো ঘটনাই না। সবই তো বিজনেস। ব্যাপারটা আস্তে আস্তে উপভোগ করতে শুরু করলেন তিনি।

ছবি: এএফপি

কিন্তু আর্জেন্টিনা দল উপভোগ করছিল না একেবারেই। খেলোয়াড়েরা জিম, প্র্যাকটিস করে সবকিছুর হিসাব দিতে দিতে ক্লান্ত। ওদিকে সোশ্যাল মিডিয়া, মার্কেটিংও করতে হচ্ছে তাদেরকেই। সব মিলিয়ে তাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠল। প্রভাব পড়তে লাগল খেলাতেও। দুর্বল দলের কাছে হারতে লাগল মেসির দল। একপর্যায়ে রাগে–অভিমানে অবসরের হুমকি দিলেন মেসি। তাকে সমর্থন দিলেন আগুয়েরোও। সব দেখে আর্জেন্টিনার মানুষ গেল খেপে। বায়ো বাবল ভেঙে তারা হোটেলে ঢুকে ধরে আনল কোচ তালুকদার সাহেবকে। তালুকদার সাহেব ভয় পেয়ে গেলেন। যতই বোঝান তিনি আসলে বাংলাদেশের তালুকদার, আর্জেন্টিনার কোচ না; কেউ বিশ্বাস করে না তার কথা। জনগণ খেপলে যা হয়, তা-ই হলো।

আজও বুয়েনস এইরেসের রাস্তায় ছেঁড়া ট্র্যাকস্যুট পরা একটা লোককে প্রলাপ বকতে দেখা যায়। বাংলা, ইংরেজি ও স্প্যানিশে একটু পরপর লোকটা বলে, ‘আমি আর্জেন্টিনার কোচ না, আমি তালুকদার গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রির এমডি।’ কেউ তার কথায় পাত্তা দেয় না। মাঝেমধ্যে কোনো হৃদয়বান পথচারী দুয়েকটা কয়েন ছুড়ে দেয় তার সামনে।

আর্জেন্টিনা থেকে বহুদূরে বাংলাদেশে তখনো নিখোঁজ ব্যবসায়ী মনোয়ার তালুকদারের খোঁজে কঠোরভাবে কাজ করে যাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। গঠিত হয়েছে তদন্ত কমিটি।