বিরিয়ানির পিৎজা ও কাঁচা মরিচের মিষ্টি—অদ্ভুত এই খাবারগুলো আদতে খেতে কেমন?

বিরিয়ানির পিৎজা
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

গরুর মাংস দিয়ে পায়েস খেয়েছেন কখনো?

না না, আমি খাইনি। অমন ডাগর ডাগর চোখ করে আমার দিকে তাকাবেন না।

তবে এক বন্ধু খেয়েছে বলে শুনেছি।

‘প্লেটের এক পাশে পায়েস নিবি। আরেক পাশে খানিকটা ঝোল ঝোল গরুর মাংস। এক টুকরো গরু পায়েসের সঙ্গে মাখিয়ে মুখে দিলেই অবাক হয়ে যাবি। ঝাল আর মিষ্টি মিলে অদ্ভুত স্বাদ কিন্তু!’—আমার সেই বন্ধুর বর্ণনা শুনে আমরা হাঁ করে তাকিয়ে ছিলাম ঝাড়া দেড় মিনিট।

ভাগ্যিস, এই আলাপ হচ্ছিল বন্ধুদের এক আড্ডায়। আমার বন্ধুটির যদি ভ্লগিংয়ের প্রতি ঝোঁক থাকত, যদি সে ফেসবুকের কোনো ভিডিওতে এই অদ্ভুত খাবার মুখে দিয়ে বলত, ‘খুবই ট্যাশ’, নিশ্চয়ই রাতারাতি সেটা ভাইরাল হয়ে যেত। হোমপেজ ভরে যেত গরুর মাংস ও পায়েস–সংক্রান্ত ট্রল, মিম আর পোস্টে।

যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়ার অধ্যাপক ও লেখক জোনাহ বারগার একবার বলেছিলেন, ‘ভাইরাল হওয়াটা কোনো কাকতালীয় ব্যাপার, জাদু কিংবা ভাগ্যের বিষয় নয়। এটা একটা বিজ্ঞান।’ অর্থাৎ এই যে বিরিয়ানির পিৎজা, মরিচের মিষ্টি, চকলেটের ফুচকা কিংবা কাঁচা আমের জিলাপির মতো অদ্ভুত খাবারগুলো কদিন পরপর ভাইরাল হয়, আবার হারিয়েও যায়—এটাই সায়েন্স। পরীক্ষা–নিরীক্ষা তো বিজ্ঞানেরই অংশ। তাই ভাবছিলাম, ভাইরাল হওয়া ২–১টা খাবার চেখে দেখলে কেমন হয়?

এই পরীক্ষায় গিনিপিগ হতে হবে নিজেকেই। ফলে পথঘাটের দোকানের ওপর ঠিক ভরসা করা গেল না। কদিন আগেই তো ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে ধরা পড়ল, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া কাঁচা আমের জিলাপি বস্তুটি স্রেফ নিম্নমানের রং আর কৃত্রিম গন্ধের খেল। অতএব আমরা রন্ধনশিল্পী জেবুন্নেসা বেগমের শরণাপন্ন হলাম। আমাদের অনুরোধে তিনি রাঁধলেন বিরিয়ানির পিৎজা আর কাঁচা মরিচের মিষ্টি।

বিরিয়ানির পিৎজা
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

একজন অভিজ্ঞ সংগীতশিল্পীকে যদি বলা হয়, ‘একটা বেসুরো গান গেয়ে শোনান তো’—তিনি যেমন বিব্রত হবেন, জেবুন্নেসা আপাও অনেকটা তেমন বিপদেই পড়েছিলেন। আমরা যেদিন গিনিপিগ হয়ে তাঁর বাড়িতে পা রাখলাম, ম্লান হেসে বলছিলেন, ‘ফেসবুকে যেগুলো ভাইরাল হয়েছে, সেগুলো কীভাবে বানায় জানি না। আমি আমার মতো করে রেঁধেছি।’

খাসির মাংস, মসলাদার পোলাও, হালকা মিষ্টি স্বাদের রুটি—সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত খানা
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

জেবুন্নেসা বেগম পাকা রাঁধুনি। পরিবেশনের কৌশলও তাঁর জানা। অতএব প্রথম দর্শনে বিরিয়ানির পিৎজা আর মরিচের মিষ্টি—দুটোই বেশ আকর্ষণীয় মনে হলো। ‘আমি শুধু পিৎজার ডো–টার ওপরে বিরিয়ানি সাজিয়ে দিয়েছি। ওভেনে দিইনি। দিলে রাইসটা একটু শক্ত শক্ত হয়ে যাবে। আর চিজ ছাড়া তো পিৎজা ভাবাই যায় না। নিচে কার্বোহাইড্রেট, ওপরেও কার্বোহাইড্রেট—এটা খেতে কেমন লাগবে জানি না,’ জেবুন্নেসা আপার কথা শুনে মনে হলো, নিতান্ত অনিচ্ছায় তিনি এই ‘ফিউশন’ তৈরি করেছেন।

ফিউশন নিয়ে কনফিউশন দূর করতে ভাবলাম ‘বিরিয়ানিৎজা’ দিয়েই শুরু করা যাক। এক স্লাইস কেটে ভয়ে ভয়ে কামড় বসালাম। সত্যি বলতে, মন্দ না। যদিও বিরিয়ানির মসলার দাপটে পিৎজার ডোর স্বাদটা প্রায় হারিয়ে গেছে মনে হলো। খাসির মাংস, মসলাদার পোলাও, হালকা মিষ্টি স্বাদের রুটি—সব মিলিয়ে এই অদ্ভুত খানাকে ‘খুব ট্যাশ’ বলা না গেলেও খেতে মন্দ না বলাই যায়।

কাঁচা মরিচের মিষ্টি
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

পরীক্ষার্থীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন জেবুন্নেসা বেগম। ভালো লেগেছে—বলায় তিনি যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন। বললেন, ‘রুটির সঙ্গে বিরিয়ানির ধারণাটা কিন্তু নতুন না। পাকিস্তানি পর্দা বিরিয়ানি বলে একটা খাবার পাওয়া যায়। পুরো বিরিয়ানিটাই রুটির ভেতর দম দিয়ে বানানো হয়। ওটা অবশ্য আমি কখনো ট্রাই করিনি।’

এবার কাঁচা মরিচের মিষ্টির পালা। বাজারে মিষ্টির দোকানগুলোয় আজকাল যে মরিচের মিষ্টি বিক্রি হচ্ছে, তার ভেতরে কী দেয়, কে জানে। তবে জেবুন্নেসা আপা মূলত বানিয়েছিলেন ছানার মিষ্টি। চিনির শিরার মধ্যে কয়েক ফালি কাঁচা মরিচ দিয়েছিলেন স্রেফ ঘ্রাণের জন্য। মিষ্টির ভেতরে মরিচ পুরে দেওয়ার দুঃসাহস তিনি করতে পারেননি।

নামে মরিচের মিষ্টি হলেও আদতে চিনির শিরার মধ্যে কয়েক ফালি কাঁচা মরিচ দেওয়া হয়েছিল স্রেফ ঘ্রাণের জন্য
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

চামচ দিয়ে এক টুকরো ভেঙে মুখে দিলাম। বাহ্, এটা খেতে বেশ। মিষ্টির সঙ্গে মরিচের ঘ্রাণটা বেমানান লাগল না একদমই।

বিজ্ঞানীরা বলেন, পৃথিবীর প্রতিটা মানুষের আঙুলের ছাপ যেমন আলাদা, তেমনি জিবের ছাপও আলাদা। এমনকি জিবের ছাপ বায়োমেট্রিক পদ্ধতি হিসেবে ব্যবহার হতে পারে কিনা, সেটা নিয়েও গবেষণা করেছেন একদল বিজ্ঞানী। জিবের ধরন, টেস্ট বাড আলাদা বলেই একেকজন একেক খাবারে একেক ধরনের স্বাদ পায়। অতএব সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ: যদি এই ‘বস্তু’ খেতে চান, নিজ দায়িত্বে খাবেন।