শিরোনামের এই প্রসঙ্গ চলতি লকডাউনে বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। চারপাশে যেসব চিত্র দেখা যাচ্ছে, তাতে এখন নিজের মনেও সন্দেহ ঢুকে যাচ্ছে। লকডাউনের মধ্যে আমরা যা করছি, তাতে এটাই প্রতিভাত হচ্ছে যে আমরা এবারের লকডাউনকে বেশ অন্যভাবে নিয়েছি। হয়তো মনে মনে মনকলা খাওয়ার মতো করেই মনে মনে মাস্ক পরছি, মনে মনে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখছি ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে কি মনের লকডাউনই বড় লকডাউন?
এই প্রশ্নের সঠিক ও গবেষণালব্ধ নির্ভুল উত্তর পাওয়া কঠিন। অন্তত এ দেশের প্রেক্ষাপটে এমন কোনো মৌলিক গবেষণা হয়েছে বলে খবর পাওয়া যায়নি। তবে সময়ও তো শেষ হয়ে যায়নি। এমন গবেষণা হতেই পারে এবং দিন দিন তার প্রয়োজনীয়তা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে।
কেন তীব্র হচ্ছে, তা নিয়ে এবার কথা বলা যাক। গবেষণা করার তীব্রতা বুঝতে অবশ্য ‘ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিলেই’ হয়। এরপর চারদিকে ‘চক্ষু মেলিলেই’ পুরো বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়ে যায়। সবাই যে যাঁর ইচ্ছেমতো ঘুরছেন, সেখানে সামাজিক দূরত্বের তেমন বালাই নেই। উল্টো রাস্তায় হাঁটতে গেলে যেভাবে মানুষের গায়ের সঙ্গে ধাক্কা লাগছে, তাতেই অনুভব করা যাচ্ছে লকডাউনের এসব দিনে বাড়িতে না থাকা জনমানুষের জনঘনত্বের বিষয়টি।
ওদিকে মাস্ক এখন আর জীবন বাঁচানোর অংশ হিসেবে পরিহিত হচ্ছে না। মর্যাদা হারিয়ে মাস্ক বরং হয়ে যাচ্ছে এসএসসি বা এইচএসসির ঐচ্ছিক বিষয়ের মতো। এক যুগের বেশি সময় আগে এসব পরীক্ষায় অংশ নেওয়া হয়েছিল আমার। ঐচ্ছিক বিষয়ের পরীক্ষাগুলোর আগে যে হালকা বা উচাটন মনোভাব মাথায় ভর করত, সেটিই হয়তো এখন মাস্কের বিষয়ে অধিকাংশ মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছে। অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধির কথা আর নাই–বা বলি।
তবে আরেকটি ব্যাপারও ঘটে থাকতে পারে। সেটি হলো, আমরা হয়তো জাতীয়ভাবে মেনেই নিয়েছি যে শারীরিকভাবে নয়, মানসিকভাবে লকডাউন মানাটাই মূল বিষয়। তাই মনে মনে আমরা মাস্ক পরছি, তবে তার ফিতা দুটি আমাদের কান থেকে শারীরিকভাবে ঝুলে থাকছে না বা থাকলেও নাক–মুখ ঢেকে রাখার বদলে চোখ বা থুতনির লজ্জা নিবারণ করছে। হয়তো মানুষ ভাবছে, মাস্ক নাকে–মুখেই আছে!
নিজের মনে প্রবল কল্পনার জগৎ তৈরি করে নেওয়াকে বিজ্ঞানের ভাষায় বলে ‘প্যারাকোজম’। ১৯৭৬ সালের দিকে বিষয়টি প্রথম পাদপ্রদীপের আলোয় আসে। এমন পরিস্থিতি হলে একজন মানুষের মনের মধ্যে...
অন্যের শারীরিক উপস্থিতিও হয়তো আমরা টের পাচ্ছি না। গাদাগাদি বা ধাক্কাধাক্কি আমাদের শরীর স্পর্শ করলেও, মন স্পর্শ করতে পারছে না। ফলে মনের লকডাউন চলছেই, তাতে কেউ বাগড়া দিতে পারছে না। আর যে লকডাউন দেখা যায়, তা তো আমাদের কাছে গুরুত্বের অংশই নয়!
এভাবে মনের লকডাউনের মতো আমরা কি একটি কল্পিত পরিবেশ সৃষ্টি করে নিয়েছি? সেখানে হয়তো রাস্তাঘাট সুনসান, সবাই স্বাস্থ্যবিধি মানছেন, যেখানে সেখানে কফ–থুতু ফেলছেন না, অন্যের ঘাড়ের কাছে রকেটের গতিতে হাঁচি দিচ্ছেন না, রাস্তায় একজনকে ধাক্কা দিয়ে বা গা ঘেঁষে চলতে না পারলে হাঁটাটাকেই ‘ব্যর্থ অভিযান’ বলে মনে করছে না ইত্যাদি ইত্যাদি।
এভাবে নিজের মনে প্রবল কল্পনার জগৎ তৈরি করে নেওয়াকে বিজ্ঞানের ভাষায় বলে ‘প্যারাকোজম’। ১৯৭৬ সালের দিকে বিষয়টি প্রথম পাদপ্রদীপের আলোয় আসে। এমন পরিস্থিতি হলে একজন মানুষের মনের মধ্যে একটি সম্পূর্ণ কল্পনার জগৎ গড়ে ওঠে। তবে প্যারাকোজম যাঁর মধ্যে সৃষ্টি হয়, তার পক্ষে বাস্তবের সঙ্গে সেই কল্পিত জগতের পার্থক্য আর নির্ধারণ করা সম্ভব হয় না। ফলে কোনটা বাস্তব আর কোনটা কল্পনা, তা বোঝা দুষ্কর হয়ে যায়।
তবে কি আমাদের দেশের মানুষের গণহারে প্যারাকোজম হলো? আরে, এই প্রশ্ন উঠবে বলেই তো বহু আগে নিবিড় গবেষণার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছিলাম হে!
গবেষকেরা অবশ্য বলে থাকেন, প্যারাকোজম পরিস্থিতি যাঁদের তৈরি হয়, সেটি তাঁদের শৈশবের সৃজনশীলতা, সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা ও সার্বিক বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক।
হ্যাঁ, বিষয়টি কিন্তু ঠিকই আছে। আশা করি আপনারাও আমার সঙ্গে অন্তত এ বিষয়ে একমত হবেন। একবার বুকে হাত দিয়ে উত্তর দিন তো, আমাদের কি সৃজনশীলতা নেই? থুতনিতে মাস্ক পরার বিষয়টি কি সৃজনশীলতা নয়?
বাকিটা আপনাদের বিবেচনার ওপরই ছেড়ে দিলাম। আমি বরং এই ফাঁকে মনের লকডাউন থেকে একটু ঘুরে আসি!